মঞ্চ
তির্যকের ঈদিপাস, দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য
সোফোক্লিসের ‘রাজা ঈদিপাস’ নাটকটি নিয়ে বিশ্ব নাট্যাঙ্গনে এমন এমন প্রযোজনা হয়েছে যে, যেকোনো দল বা নির্দেশকের জন্য এই নাটক একাধারে লোভনীয় হয়েও যথেষ্ট দ্বিধান্বিত হওয়ার মতো পাণ্ডুলিপি হয়ে দাঁড়ায়। লোভনীয় এই কারণে যে পাশ্চাত্য নাটকের ইতিহাসে এই নাটকটির মতো সর্ববিষয়ে সার্থক সৃষ্টি আর নেই বলেই বেশির ভাগ নাট্যজন স্বীকার করেন। আর দ্বিধান্বিত হওয়ার কারণ এই যে সম্ভবত এই নাটকটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি নিরীক্ষা হয়েছে, কি প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে। কাজেই এই রকম একটি বিখ্যাত পাণ্ডুলিপির মঞ্চায়নে বাংলাদেশের নিয়মিত দর্শক কিংবা প্রাজ্ঞ নাট্যজনদের সন্তুষ্ট করা এটা তো একটা চ্যালেঞ্জ বটেই। প্রযোজনাটি দেখতে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার আগে এ বিষয়টি বারবার মনে হচ্ছিল যে, তির্যক সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, আহমেদ ইকবাল হায়দারের নির্দেশনায় নাটকটি করেছে। অনেক আগের প্রযোজনা হলেও ব্যক্তিগতভাবে আমার দেশে অনুপস্থিত থাকার ফলে প্রযোজনাটি দেখা হয়নি। এবার সুযোগ হলো। দলটির ৪০ বছর পূর্তি উৎসবের সমাপনী উপলক্ষে আয়োজিত প্রযোজনাটির ১০১তম মঞ্চায়ন হলো গত ৫ জুন, জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে।
নাটকটির যে বিষয়টি সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য বলে মনে হয়, তা হলো পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা। সৈয়দ আলী আহসান আর শম্ভু মিত্রের অনুবাদ থেকে বেশ অকপট মিশেল করেছেন নির্দেশক আহমেদ ইকবাল হায়দার যেখানে কাব্যময়তায় এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ভেদটি গোচরে আসে না। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে অবশ্য এই নির্দেশক তার মুনশিয়ানার জন্য (একাধারে নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে) ব্যাপক পরিচিত অনেক আগে থেকেই। মূলত নাটকটির সম্পাদনার জন্যই সাধারণ দর্শকের কাছে নাটকটি অনেক দীর্ঘ বলে অনুভূত হয় না। অবশ্য অভিনয় ও অন্যান্য বিষয় তো এর সঙ্গে রয়েছেই। আরেকটি বিষয়ে ধন্যবাদ জানাতে হয় নির্দেশককে। তা হলো একটি ক্ল্যাসিক টেক্সটকে তিনি যে জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে। ক্ল্যাসিককে ভেঙে ‘নিরীক্ষণ’ নাম দিয়ে আমরা আজকাল অনেকেই সমকালের সঙ্গে এর সম্পর্ক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই যা সৃজনকর্মটিকে অনেকটা হালকা করে দেয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। তা তিনি করেননি। আমরা বুঝতে পারি নির্দেশক তা ইচ্ছে করেই করেননি কারণ তিনি জানেন, ক্ল্যাসিকের একটি নিজস্ব শক্তি আছে। ইডিপাসের সেই শক্তিতেই তা সমকালের হয়ে ওঠে মানুষের বৌদ্ধিকতার গোপন প্রকোষ্ঠে।
প্রযোজনার প্রায়োগিক কিছু বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যাক। মঞ্চসজ্জা ও ব্লকিংয়ে নির্দেশক একধরনের অ্যাসিম্যাট্রিকাল ব্যালেন্সের দিকে গিয়েছেন যা দৃষ্টিগ্রাহী। তবে মঞ্চের কেন্দ্রে যে প্ল্যাটফর্মের অবস্থান তা পুনর্বার বিবেচনার যোগ্য বলে মনে হয়। কেন্দ্রের প্লাটফর্মটি প্রাচীন গ্রিক অর্কেস্ট্রায় অবস্থিত ‘থিমিলি’র কথা মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দেয়। সেই জন্যেই কি এর ব্যবহার? প্রাচীন গ্রিক ট্র্যাজেডি মঞ্চের কোনো ধারণা বা মোটিফ যদি নির্দেশক ব্যবহার না-ই করেন, তাহলে অভিনয় ভূমির অনেকখানি অংশজুড়ে অভিনেতার চলনকে বাধাগ্রস্ত করার মতো এই প্ল্যাটফর্মটি কেন? উপরন্তু তার পেছনে কোনো অভিনেতা দাঁড়ালেও তার কোমর পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতে ট্র্যাজেডির কেন্দ্রীয় বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর ‘গ্রেইস’ নষ্ট হয় বলে মনে হয়েছে। আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্পট লাইট ব্যবহারের ধারণাটি সুন্দর হলেও বেশির ভাগ আলোই ‘ফুট’ থেকে কেন বোধগম্য নয়। ব্যাক লাইটে লাল আলোর প্রাধান্য যদিও প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত, তথাপি এর ব্যবহার সীমিত হলে এই আলোটি ব্যবহারের গভীর অনুভবটি আরো স্পষ্ট হতো বলে মনে হয়। যেমন যে মুহূর্তে দূতের কাছ থেকে পলিবাসের মৃত্যুর খবর আসে এবং একই সঙ্গে পলিবাস ইডিপাসের বাবা নন খবরটি পেয়ে জোকাস্টা আপ-স্টেজ-এর প্ল্যাটফর্মে উঠে যান সেই মুহূর্তটিতে জোকাস্টার ওপরে স্পটলাইট রেখে বাকি অভিনেতার আলোগুলো কমিয়ে দেওয়া যেত। তাতে জোকাস্টার কষ্টের অনুভূতিটি আরো স্পষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী হতো এমন ধারণা অমূলক নয়। এমন একটি প্রয়াস অবশ্য নির্দেশক নিয়েছেন, যখন দেখি মেষপালককে গলা চেপে কথা আদায়ের পর হঠাৎ ইডিপাস নিঃশব্দ একা শুধু একটি ফুট লাইটের আলোয়। মঞ্চের কেন্দ্রে, যেন পৃথিবীতে আর কিছু নেই, একটি শূন্য মুহূর্ত। সুন্দর এই মুহূর্তটি। দীর্ঘ লাল কাপড়ের ব্যবহারটি তেমন কোনো উদ্ভাস তৈরি করতে পারেনি, উপরন্তু এই ব্যবহার অতিপরিচিত, যা দর্শক হিসেবে আমাদের নতুনভাবে চমৎকৃত করে না।
অভিনয়ে কোরাস দলের অংশগ্রহণ প্রশংসার দাবি রাখে। তাদের সমবেত পদচারণা, সংলাপ বা গীত প্রক্ষেপণ সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের অনেক দলের জন্য অনুসরণীয়। দুর্বল মনে হয়েছে জোকাস্টা চরিত্রের অভিনেত্রী শায়লা শারমিনকে। ইডিপাস চরিত্রে আহমেদ ইকবাল হায়দার সাবলীল। চলনে বলনে অভিনেতা হিসেবে অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। তবে বাচিক অভিনয়ে শম্ভু মিত্রের একটি দূরবর্তী প্রভাব অনুধাবন করা কঠিন নয়। একই অভিনেতা দিয়ে অনেকগুলো চরিত্রে অভিনয় করানোর গ্রিক কৌশলকে সাধুবাদ জানাই। সংগীত বিষয়ে বক্তব্য এই যে, নির্দেশক আবহ নির্মাণে রেকর্ডেড মিউজিক ব্যবহার না করলেও কিছু মুহূর্তকে উচ্চকিত করার জন্য কোরাসের হামিং, যন্ত্রসংগীত কিংবা সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করতে পারতেন। কিংবা নৈঃশব্দের ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে এই নাটকটিতে। মাস্কের ব্যবহারের ধারণাটি সুন্দর তবে মাস্ক নির্মাণে আরো গবেষণার প্রস্তাব রইল, যদিও নাটকটির শততম মঞ্চায়ন হয়ে গেছে। তাতে কি, থিয়েটার তো প্রতিদিন নতুন কিছু ভাবার অবকাশ দেয় বলেই জানি।
সার্বিকভাবে, এই প্রযোজনাটি দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য এবং দর্শকদের এক ধরনের তৃপ্তি দিয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বলতে বাধা নেই, আমাদের দেশের এমন ক্রান্তিকালে আত্মপরিচয় অন্বেষণের, সত্য অনুসন্ধানের জন্য নির্ভীক মানুষের বড় অভাব। ভবিতব্যের প্রতিপক্ষে সত্য অনুসন্ধানের প্রত্যয় নিয়ে আমরা কজনই বা আজ ইডিপাসের কাতারে দাঁড়াতে পারছি। আমাদের এ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল তির্যক নাট্যদলের ‘ইডিপাস’।