রম্য
ভীতিকর
১.
একেকজনের ভয় একেক জায়গায়।
একজনের কাছে যেটা প্রীতি, অন্যজনের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো ভীতি।
আমার যেমন উচ্চতা-ভীতি।
উঁচু ভবনের ছাদ বা বারান্দা থেকে নিচে তাকালে বুক ধরাস ধরাস করে। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাব। স্বাভাবিক হতে দুই গ্লাস পানি খেতে হয় নগদে।
বিমানযাত্রায় অবস্থা হয় আরো কাহিল।
মাঝ-আকাশে বিমান যখন বাম্পিং করে, তখন হার্টে পাম্পিং করার জোগাড় হয়।
এ জন্য মাঝে-সাজে যখন বিমানে ওঠার সুযোগ হয়, তখন উঠেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প দূরত্বের যাত্রায় সেটা সম্ভব হয় না।
একবার অভ্যন্তরীণ রুটের এক বিমানে চড়ে কান ধরেছিলাম। না, নিজের কানই।
বিমান সম্পর্কিত সব উচ্চ ধারণা সেদিন ধূলিসাৎ হয়েছিল।
বিমান মানেই ধরে নিয়েছিলাম ঝা চকচকে সবকিছু। পরিপাটি। চেয়ার হবে নরম তুলতুলে। শরীর এলিয়ে দেওয়ামাত্র চোখের দুই পাতায় ঘুম চলে আসবে।
একেবারে খারাপও যদি হয়, তাহলে ন্যূনতম সেলুনের চেয়ার তো হবেই। এর চেয়ে নিচে নামতে পারে না।
কিন্তু বিমানের সিট যে মতিঝিল টু আবদুল্লাহপুর রুটের ৬ নম্বর বাসের সিটের চেয়েও করুণ হতে পারে, সেদিন বুঝেছিলাম।
তার ওপর সিটের নিচে একটা স্ক্রু ছিল ঢিলা। বিমান একটু উনিশ-বিশ করলে সিট করে আটত্রিশ-চল্লিশ।
বাসের মতো এই বিমানের নামও ‘মায়ের দোয়া’ পরিবহন হওয়া উচিত ছিল। মায়ের দোয়া না থাকলে সে যাত্রা নির্ঘাত শেষ যাত্রা হয়ে যেত।
তবে একটা মাত্র কারণে বিমান আর ৬ নম্বর বাসের পার্থক্য করা গেছে।
বাসে যাত্রীদের কাছে কন্ডাক্টর আসে। বিমানে এলো আধা সুন্দরী এক বিমানবালা।
মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
হাসিটা লজ্জার নাকি আনন্দের, প্রথমে তা বোঝা গেল না।
কাছে আসতে বুঝলাম, হাসিটা লজ্জার নয়। লজ্জার হাসিতে শরম মেশানো থাকে। এই হাসি দায়িত্বের। সফটওয়্যার হাসি। ফরম্যাটেড।
ঠোঁটে নির্দিষ্ট পরিমাণ হাসি ঝুলিয়ে রেখে একটা ট্রে হাতে এগিয়ে এলো বিমানবালা।
তাতে কিছু প্রাণ মিল্ক ক্যান্ডি।
সঙ্গে কোনো বাচ্চা ছিল না। তাই প্রথমে মিল্ক ক্যান্ডি দেওয়ার কারণ ধরতে পারলাম না।
কারণ বুঝলাম খানিক পরে। দুধ খাও, এগিয়ে যাও।
আল্লাহর নামে চলিলাম।
বিমান ঝাঁকি দিয়ে উঠল।
পাইলট ইঞ্জিন চালু করে দিলেন।
প্রায় একই সঙ্গে আমরা, মানে যাত্রীরা চালু করলাম যার যার মুখ।
ইয়া আল্লাহ...ইয়া রহমানুর রাহিম। এই যাত্রায় মাটিতে নামতে পারলে সারা দিন মসজিদে পড়ে থাকব। কিছুক্ষণ পরপর সমস্বরে এই চলতে থাকল বিমানের ভেতর।
ওই বিমানের পাইলট নির্ঘাত বেহেশতে যাবেন।
যাত্রীরা যেভাবে আল্লাহর নাম নিচ্ছিলেন, তাতে করে যাত্রীপ্রতি সোয়াবের পাঁচ পারসেন্টও যদি পাইলটের ভাগে যায়, তাতে করে তাঁর জান্নাত গমন কেউ আটকাতে পারবে না!
বিমানের পাইলটের বেহেশত কনফার্ম হলেও বিমান কোম্পানির ভাগ্যে জোটে উল্টোটা।
তাদের লালবাতি কনফার্ম হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে।
২.
দুই নম্বর ভীতি ভূমিকম্প-ভীতি।
কারণ ছাড়াই কাঁপি।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।
আশপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলে হাসে।
তাই নাকি?
কই! টের পেলাম না তো।
দিনে দিনে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভূমিকম্প হয়েছে কি না, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি হলে সবাই আমার কাছে চলে আসে। কারণ সবার ধারণা, কেউ টের না পেলেও আমি টের পাব।
আর আমার ধারণা, ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেওয়ার সিস্টেম থাকলে সিগন্যাল থেকেই আমার কাঁপাকাঁপি শুরু হতো।
ভূমিকম্প বোঝার জন্য একটা সময় বালতিতে পানি জমিয়ে রাখা শুরু করি। বালতির পানি কাঁপলে বুঝি ভূমিকম্প হয়েছে। বাঘ না থাকলে গোলপাতা নড়ল কেন টাইপ অবস্থা।
আমার কাণ্ড দেখে অনেকে হাসে।
জ্বলন্ত উনুনের ভয়ে তো ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ছ মিয়া। পরিষ্কার পানি জমিয়ে রাখছ ঘরে। ডেঙ্গু হবে। ফলাফল কিন্তু তাইলে একই। এতেও মরণ ওতেও মরণ। আর মরতেই যদি হয়, তাইলে উষ্টা খাইয়া মরবা ক্যান! বিল্ডিংয়ের তলে পইড়া মরা বেশি সম্মানের না? ভাইব্যা দ্যাখো। তা ছাড়া আমরাও বুক ফুলাইয়া মানুষরে বলতে পারব।
মানুষের কথায় কান দিই না।
আমার অবস্থা, মরণ যেন হয় তোমার প্রেমের আঘাতে।
মশার আঘাত সইতে রাজি, তা-ও ভূমিকম্পের আঘাত মানতে রাজি না।
আমার বালতি সব সময় ভরাই থাকে।
বাসায় বুয়াকে বলা আছে। সকাল-বিকেল দুবেলা বালতিতে নতুন পানি তুলে রাখবে, যাতে ডেঙ্গু মশা সেখানে আসর জমাতে না পারে।
বুয়া আবার কিঞ্চিৎ ধার্মিক কিসিমের।
ভাইজান, অপচয় করন ভালা না। আল্লাপাক বলেছেন, অপচয়কারী ইবলিশের ভাই-বেরাদর।
তাতে তো তোমার কোনো ক্ষতি নেই বুয়া। ভাই হলে আমি হব। তুমি তো আর ভাই হতে পারবে না। তোমাকে হতে হবে শয়তানের বোন। তা ছাড়া কাজটা তো তুমি আমার কথায় করছ। ভাই হই আর ভায়রা হই, সেটা আমিই হব। তুমি নিশ্চিন্তে কাজ করো।
আমার রসিকতায় বুয়ার মন ভরে না। মুখ কালো করে সে চলে যায়। তবে দুবেলা বালতির পানি বদলানোর কাজটা ঠিকঠাক করে।
বালতির পানিই আমার ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র। রিখটার স্কেল।
তবে সমস্যা একটাই।
ভূমিকম্প নিয়তির ঝড়। বলে-কয়ে আসে না।
অবনমনের এই সময়ে উচ্চতা-ভীতি কোনো সমস্যাই না।
আমরা সবাই পাল্লা দিয়ে নিচে নামছি।
নামতে নামতে এতটাই নেমেছি যে নামার আর জায়গা নেই।
কিন্তু ভূমিকম্প?
বালতি দেখে বোঝার সুযোগ কি সব সময় পাওয়া যাবে?
হে রিখটার স্কেল, তুমি ছয়ের ওপর উঠো না প্লিজ...