সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
মাঘ মাইস্যা সেই দিন-কয়টা মংলার মায়ের বড় জ্বালার ভিতর দিয়া যায়। জ্বালা হয় জুলেখার মায়রে নিয়া। সেয় ক্যান জানি- কেমুন না-বুঝপনা করতে থাকে।
কোন বিষয় নিয়া বেবুঝের লাহান কর্ম শুরু করে সেয়?
ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় আনা-যানা নিয়া।
জুলেখার হারানির পরে এতাগিলি বচ্ছর ধইরা সেয় যা করে নাই, অখন এই মাঘ মাইস্যা দিনে আইয়া সেইটা করা ধরছে মাতারিয়ে।
জুলেখার মায় খালি গিয়া অই ঘাটলায় পইড়া থাকতে চায়! যখন-তখন ঠাকুরবাড়ির দিগে ধুছমুছাইয়া মেলা দেয়! মংলার মায় তো বলতে গেলে অখন জুলেখাগো বাড়িতেই নিজের ঠাঁই গাইড়া লইছে। থাকাথাকি, ভালাবুরা সব করে সেয় এই ভিটিতেই। কোনো প্রকারে সেই কয়টা ঠেকার কাম সাইরা, সেয় আইয়া বইয়া থাকে এই বাড়িতেই।
তো, মংলার মায়ের চক্ষের উপরে সর্বনাইশ্যা কারবার ঘটবো, আর সেয় কী সেইটা চাইয়া চাইয়া দেখবো! অই রাঁড়ি-বেওয়া, আভাগী মাতারিরে কোন পরানে সেয় একলা যাইতে দেয় ঠাকুরবাড়িতে?
অল্প এট্টু ঘুরান দিতে সেইখানে যায়, তখন গেলো নাইলে একলা। দৌড়ের উপরে গেলো দৌড়ের উপর আইলো। কিন্তু জুলেখার মাওয়ের অখনকার বাসনা তো সেইটা না। সেয় অখন গিয়া বহুতখোন বইয়া থাকতে চায়।
দোপোর নাই, সকাল নাই, বৈকাল নাই; দিলো মেলা সেইদিগে। গিয়া, যতখোন মোনে ইচ্ছা হয়; ততখোন বইয়া থাকে!
তো অখন, খোদার দিগে চাইয়া দশজোনে কউক—অমুন কুসাইধ্যা, ছাড়াবাড়িতে একটা মানুষরে একলা যাইতে দেওন যায় কি না! যে কি না মাইনষের পয়দা, সেয় এইটা হইতে দিতে পারবো না। মংলার মায় গরিব হইতে পারে, কিন্তুক সেয় আমাইনষের ছাও না।
এই কথাটা তার অন্তরে খোনে খোনে কামড় থাকে। সেই কামড়ের জ্বালার কারোণেই তো মংলার মায়রেও যাইতে হয়—জুলেখার মায়ের পিছে পিছে।
ভোমরার ডাকের ভালা-মন্দের বিষয়টা জুলেখার মায়ের স্মরণে না আহুক, তার তো স্মরণে আইছে! ভোমরার বার্তা হাছা না মিছা, তা মংলার মায় কইতে পারে না। কিন্তুক যুদি হাছা হয়, আর যুদি এই মাতারির কোনো অনিষ্টি ঘটে, তাইলে মংলার মায় খোদার কাছে কী জব দিবো! সেয় কী এগো বাড়ির নুন খায় নাই?
এই পদের শতেক ভাবনা মাথায় নিয়া, মাঘ মাইস্যা দিনকয়টা ভইরা, মংলার মায়ও গিয়া জুলেখার মার লগে বইয়া থাকে ঘাটলার ভাঙ্গা সিঁড়িতে। বইয়া সে থাকে চুপচাপ, কিন্তু মনে তার কতো কথা যে ওঠা-পড়া করতে থাকে!
সেয় খেয়াল কইরা দেখে যে, দিনের অন্যসোম যেমুন-তেমুন; সকালে গিয়া অই ঘাটলায় বইলেই তার ভিতরে কথার ঝাপটা-ঝাপটি য্যান হিসাবছাড়া, বেশি রকম হয়!
অইসোম সেয় বইসাও সারে না—হঠাৎ কইরাই তার পরান হায় হায় করা ধরে। তার মোনে হইতে থাকে, কী জানি একটা লোকসান হইয়া যাইতাছে!
এমুন কইরা ঠায় আজাইরা বইয়া থাইক্কা থাইক্কা সেয় নিজের এক মস্ত লোকসান নিজে করতাছে!
হাতে তো তার কামের কোনো শেষ নাই।
দুপুরের আগখান দিয়া নানা পাতরের তেনে তারে ধুমধুমাইয়া নানা জাতের শাক টোকাইতে হয়। তার বাদে সেই শাক তরাতরি নিয়া নানান বাড়িতে দিয়া আসতে হয়। সময়ের জিনিস সময়ে না দিলে মাতারিরা দুনিয়ার চোপা করতে থাকে।
চোপা তো করবোই মাইনষে! শাক রান্ধনে কী কম হ্যাপা!
সেটিরে কোটা-বাছা আছ। পুষ্কুনীতে নিয়া আছাড়ি-পিছাড়ি দিয়া ধোওয়া-ধুওয়ি করা আছে। তবে তো সেটি রান্ধনের উপযুক্ত হয়! চুলায় আগুন ধরাইয়া ফালাইলে, মাতারিরা চুলা সামলাইবো, না শাক বাছতে বইবো!
দেরিতে শাক নিয়া দিলে এই কারণে তারা গোস্বা হয়। মংলার মায় তাগো কেউইরেই চেতাইতে চায় না। হেগো কাছ তেনে যা কিছু সেয় পায়, অইই তার নিজের সম্বল। এই দিয়াই নিজের পান-দোক্তার খরচা সামলানি দেয় মংলার মায়! ঘইট্টা তো বেচে সেয় নাতি-নাতকুঁড়ের মোখের দিগে চাইয়া।
দেওভোগের প্রায় ঘরেই একটা-দুইটা বুড়া দাদি-চাচি আছে। সেইসব ঘরের দরকারের শাক অই বুড়ারাই নানান ক্ষেতের তেনে তুইল্লা আনে। তয় এমুনও সংসার আছে যেইনে বুড়া কেউই নাই। সেই ঘরের বৌ-ঝিয়েরা সারা দিনে এমুন আজাইরটা পায় না যে, নিজেরাই গিয়া ক্ষেতের তেনে হাবিজাবি শাক তোলে। তাগো অখন ভরসা এই মংলার মায়। তারা যেমুন ফরমাইশ দেয়, মংলার মায় সেই মতে কর্ম করে। এমনেই যাইতাছে তার দিন।
তয়, আর বুঝি সেইটা করার উপায় পাইবো না সেয়! এই যে জুলেখার মাওয়ের জ্বালায় তারে পড়তে হইছে! তার পিছে পিছে হাঁটোন লাগতাছে মংলার মায়রে! এর তো কোনো বিহিত দেখে না মংলার মায়!
এই যে বইন-জুলেখার মা, তার শোকতাপের শইল। সেই শইল্লের গাছতলাই কি আর বাঁশতলাই কি! তার একলা পেট। কোনোমতে চইল্লা যায়। এমুন যখন-তখন কোনোদিগে গিয়া হাত-পাও ছড়াইয়া বইয়া থাকলে পোষায় তার।
কিন্তু মংলার মায়ের কি সেইটা করলে হয়! এই পোড়াকপালির সংসার তো একজোনের না।
পুত মংলায় ছুতানাতা যা কাম করে, তা দিয়া পোলার বৌয়ের খোরাকিও কোনোরকমে জোটে না! নাতি কয়টার খাওন আহে কইত্তেনে! এই যাতনা সামলানি দেওনের লেইগাই না মংলার মায়ে এতো দিগে লৌড় পারে! এমনে এমনে বইয়া থাকোনের নসিব নি তার!
মংলার মায় ভিতরে ভিতরে একলা একলা এতোরকম ঘ্যানঘ্যানায়, কিন্তু জুলেখার মাওয়ের পিছ ছাড়ে না।
না না! যতো ঝামেলায়ই তারে পড়োন লাগুক না ক্যান, সেয় এই মাতারিরে অখন ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় একলা যাইতেও দিবো না। একলা থাকতেও দিবো না। সেয়ও তাইলে ঠ্যাটা দিয়া বইয়া থাকবো জুলেখা মায়ের লগে।
এমনে এমনে জুলেখার মাওরে নানামতে পাহারা দিয়া মাঘ মাসের দিন কয়টা পার করে মংলার মায়ে। কোনোরকম অঘটনই ঘটে না। সোন্দর সায়শান্তি হালে মাঘ মাসটা যায় গা।
আহে ফাল্গুন মাস। দেখো রে; দিনে দিনে সেই মাসও সুভালাভালিই যাইতে থাকে।
জুলেখাগো ভিটির গাছের আগায় আগায় ধুন্দুলের ফুল যেমুন ডগমগানি দিতাছিলো, তেমুনই দিতে থাকে। ফুলে ফুলে ভোমরারা যেমুন গরজানি, পুনপুনানি, সুরেলা ঝমঝমানি দিতাছিলো আগে; তেমনই দিতে থাকে।
কোনো বিপদ-বালাই কি কোনো বেরাম কি কোনো প্রকার খোশখবরির বিষয়—জুলেখাগো বাড়িতে কিছুই ঘটে না। দিন যাইতে থাকে সাদাসিদা ধরনে। এমন থাকারেই তো ভালা থাকা কয়, নাকি!
যতো কিনা দিনেরা ভালাভালি যায়, ততো মংলার মায়ের মোন ফাঁপোড়ে হাঁসফাঁসায়। বিষয় কী! পুরান কালের মুরুব্বিরা কি তাইলে ভোমরাগো ডাকের বিষয়ে মিছাকথা কইয়া গেছে! মংলায় মায় কি তাইলে হুদা কামেই চিন্তায় জারেজার হইতাছে! হুদা কামে?
হায় হায়! এই মংলার মা বেকুবে কি তাইলে আরেকজোনের লেইগা বিপদরে ডাক পাইড়া আনতাছে! মাইনষে হোনলে তো কইবো যে, জুলেখার মায়ের ভালাই দেইক্ষা চোখ টাটায় কি না মংলার মায়ের; সেই কারণে এমুন কুচিন্তা আইতাছে এই ফকিরনির মোনে!
ভিতরে ভিতরে শরমাইতে শরমাইতে মংলার মায় আবার নিজেই নিজেরে ধন্যি দিতে থাকে। কপালগুণে যে সেয় অই ভোমরার ডাক নিয়া ডরানের কথাখান জুলেখার মায়রে কইয়া দেয় নাই! বুদ্ধি কইরা যে সেয় কয় নাই! কতো একটা ঠিক কাম করছে সেয়! নাইলে কেমুন শরমের তলে পড়তো!
এই ত্তো দেহো—কিছুর মিদে কিছুই তো হয় নাই! কোনো বালা-মুসিবত কিছু হইতাছেও না। তাইলে সেই নাই-ডরের কথা শোনলে জুলেখার মায় কী মোনে করতো! তোবা তোবা!
এতো সকল কথা নিজের লগে নিজে কওয়া-বুলি করে মংলার মায়; আর এই মতে সেই মতে ফাল্গুন মাসে জুলেখার মাওয়েরে পাহারা দেওয়ার কর্ম করতে থাকে সেয়।
ক্রমে দেখো ফাগুন মাসও প্রায় যায় যায়।
মাসখান যাইতে আর কেবল দিন দুই বাকি।
এমুন সোমে জুলেখার মায় কয়, আউজকা তার অন্তরটা য্যান টুকরা টুকরা হইয়া যাইতে চাইতাছে! ঘরে আর একদণ্ড থাকতে পারতাছে না তার দেহখান। সেয় ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় গিয়া বইয়া থাকবো। তবে আউজকা দেখো জুলেখার মায়—নিজের হাতে-পাওয়ে কোনোই বল পাইতাছে না! একলা যে সেয় যাইবো ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায়, সেই শক্তি য্যান নাই তার! মংলার মায় নি তারে এট্টু দিয়া আইবো, অইনে?’
‘শইল যহন এতো বেজুত ঠেকে, তহন আর অইনে যাওনের কী কাম!’ মংলার মায় জুলেখার মায়েরে আটকানির চেষ্টা করে। ‘আউজকা থাউক বুজি। যওনের কাম নাই।’
ওম্মা! যেই না সেয় মংলার মাওয়ের সেই কথাখান শোনে, অমনেই য্যান তার শইল্লে কোরোধ বলকানি দিয়া ওঠে। সেয় কি না তখন একলা একলাই ঠাকুরবাড়ির দিগে হাঁটা দেয়। মংলার মায় আর তবে কী করে সেইসোম! সেয় কপালে মাইরা জুলেখার মায়ের পিছে পিছে যাইতে থাকে নিত্যিকার লাহানই।
ঘাটলায় গিয়া তো আর করোনের কিছু নাই। থির মতোন ঘাটলার সিঁড়িতে বইসা, জুলেখার মায় নিত্যি যেমুন পুষ্কুনীর পানির দিগে চাইয়া থাকে; সেইদিনও তেমুনই ঠাটার মরার লাহান তবদা বসা দিয়া—পানির দিগে চাইয়া থাকে।
অন্য অন্যদিন মংলার মায়ে এই ঘাটলায় বইসা একটা বড়ো রকমের আরামের কর্ম সাইরা লয়। সেয় বইসা বইসা ঝিমায়। ঝিমাইতে থাকে ঝিমাইতে থাকে। সময় সোন্দর যায় গা।
আউজকা বইনে আলা কতখোন বইবো, কে জানে! বইনের বওয়া বইনে দেউক, মংলার মায়ের ঝিমানি আইলে সেয় ঝিমানি দিয়া লইবো নে! ঝামেলা নাই তো কোনো! এই মোনে নিয়া মংলার মায়ে সিঁড়িত হাত-পাও ছাবড়াইয়া বসে।
বইয়া বইয়া মোনে মোনে নানান কথা লাড়তে লাড়তে সেয় এদিগে চায়, সেদিগে চায়। চাইতে চাইতে একসোম দেখে কী—ঘাটলার উত্তর মুড়ায় অই যে বুড়া ত্থুত্থুরা, ভোমা বকুলগাছটা—তার ডাইল্লার তেনে কিয়ে জানি একটা জোর ঝাটকি দিয়া বাইর হইলো!
কী বাইর অইলো এমুন! লাইলাহা ইল্লাল্লা—লাইলাহা ইল্লাল্লা—ডরে তার মুখ দিয়া আপনা-আপনি দোয়াদুরুদ বাইর হইতে থাকে।
খোদা খোদা! কী আবার আইলো শেষ-কাটালে! ডরের একটা শক্ত ধাক্কা খাইতে খাইতে সেয় দেখে, সেই উড়াল দেওয়া জিনিসটা ধুপ্পুর কইরা আইয়া নামছে তাগো দোনোজোনের নাক বরাবর।
দেখো দেখো! ডর কী জিনিস! কিয়েরে ডরাইছে তারা! না, একটা কাউয়ারে! অই ত্তো দেহো কাউয়াটা!
কাউয়া দেইক্ষা তাগো ডর নাই হইয়া যায় গা, কিন্তু লগে লগে তারা দোনোজোনে নিজেগো বুকে ধুম থুতু ছিটানি দিতে থাকে। এইটাই এমুন আঁতকা ডরের দোষ-কাটানি দেওনের একমাত্র উপায়। সেইটা না দিলে আবার বিপদ আছে!
‘মাগ্গো মা! কী ডরটা ডরাইলাম বুজি!’ মংলার মায় কয়।
‘আর কইস না! এমুনই আমাগো কইলজার তাগদ—কাউয়া দেখলেও কাঁপি!’ জুলেখার মায় ডর সামলাইতে সামলাইতে হাসে।
জুলেখার মায়ের কথা শুইন্না মংলার মায়ও হাইস্সা কুটপাট হয়। বুজির কথা তো মিছা না! হাসতে হাসতেই তারা দোনোজনে ভালা কইরা চাইয়া দেখে, তাগো সামোনে এট্টু ফাঁরাকে, যে কাউয়াটায় আইয়া বহা দিয়া রইছে, সেইটায় যেনতেন কোনো কাউয়া না!
মারে মা! এইটা কেমুন কাউয়া! এই তাগড়া তেজি—এই চুকচুকা কালা—এই বড়ো! এমুন জুয়ান, এমুন শক্তিঅলা শইল্লের দাঁড়কাউয়া তো কোনোসোম তাগো চক্ষে পড়ে নাই!
সত্য যে, গেরামে দাঁড়কাউয়া মোটের উপর দেহাই যায় না। গেরামে বারো মাস ঘোরাফিরা করে পাতি কাউয়ারা। গেরামেই তারা থাকে। গেরামেই খাওন জোটায়। গেরামের নানা বাড়ির গাছের ঠাইল্লায় বাসা বান্ধে। ডিম পাড়ে, বাচ্চা বড়ো করে। আর, সন্ধ্যা-মাদান কি ভোর-আন্ধার কালে ডাকাডাকি করতে করতে দেওভোগ গেরামরে কাঁপায় তারা পুরাটা বচ্ছর। পাতিকাউয়া তো দেওভোগ গেরামের ঘরের জিনিস। তাগো কথা কেউর মোনেও থাকে না, আবার ভোলেও না।
দাঁড়কাউয়া দেওভোগে আহে মাঝে সাঝে। আসে বহুত দিন বাদে বাদে। তবে তাগো কোনোটারে কোনো সোমই একলা আইতে দেহা যায় নাই। তারা সব সোম আহে জুড়ি-বান্ধা; থাকেও জুড়ি-বান্ধা। আইসা গাছের উঁচা কোনো ডালে থির বসা দিয়া থাকে।
ইচ্ছা লাগলে এট্টু গরর গরর আওয়াজ তুইল্লা কয়খান ডাক দেয়—কা কা কা! সেই ডাকের গমকে বাতাসও য্যান গমগমায়। লোকে সেই স্বর শুইন্নাই বোঝে, গেরামে দাঁড়কাউয়া আইছে।
তখন লোকে হাতের কাম হাতে লইয়া কতখোন সেই কা কা কা ডাক শোনে। শুইন্না বোজোনের চেষ্টা করে, আঁতকা আওয়া দাঁড়কাউয়ায় কী কোনো গুহ্যকথা কইতাছে? নাকি ওইটা এমনে এমনে হুদাহুদির ডাক! তবে কোনোদিনও এই গেরামের কোনো মাইনষে সেই বিষয়রে মীমাংসা করতে পারে নাই।
কেমনে পারবো? দুইটা-চাইরটা ডাক দিয়াই তো দাঁড়কাউয়ারা ডাক বন্ধ কইরা দেয়। তার বাদে তারা কোন অচিন দেশের দিগে জানি উড়াল দিয়া দেয়!
আসে তারা নিজের ইচ্ছায়, যায়ও নিজের ইচ্ছায়ই। মাইনষের দিগে খেয়াল দেওনের তাগো কোনো ইচ্ছা দেখা যায় না।
আজকা যে দেখা যায় বিপরীত আচার! দুই দুইটা মাতারির সামোনে, এই ভাঙ্গা ঘাটলার ভাঙ্গাচুরা সিঁড়িতে আচমকা নামলো যে দাঁড়কাউয়ায়? নামলো তো নামলো, নাইম্মা আবার থির বসা দিয়া আছে। দিষ্টি তার কোনদিগে?
আরে বাপ্পুইস রে! দাঁড়কাউয়ায় দেখো চক্ষের পলক না ফালাইয়া চাইয়া রইছে দুই মাতারির দিগে! এইটা কেমুন বেপার!
মংলার মায় ঘটনা দেইক্ষা এমুন ভেবলাইয়া যায় যে, জুলেখার মায়রে ফিসফিসাইয়া ইস্তক ডাক দেওয়ার হুঁশ পায় না। তবে ব্যাপারখানা দেইক্ষাই জুলেখার মায় বোঝে, এইর মিদে কিছু-একটা কিন্তু আছে! এইটা বিনা কারোণে ঘটতাছে না! একটা বিষম কোনো গুপ্তি বিষয় আছে এইর মিদে! জুলেখার মায় সেইটা বোঝোনের লেইগা আঁতিপাতি চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কিছুই ধরতে পারে না সেয়।
অদিগে, দাঁড়কাউয়াটায় তাগো দোনোজোনের দিগে চাওয়া দিয়া থাকে যে থাকেই!
কতখোন আর কিছুই ঘটে না। অল্পপরেই দেখা যায়—দূরে, অই নিচের দিগের এই সিঁড়িতে-সেই সিঁড়িতে একটা-দুইটা কইরা পাতিকাউয়া আইসা—একে একে বইতাছে। সবটিই বইতাছে তাগো দুইজোনের দিগে মোখ কইরা। ভাবে বোঝা যায় যে, তাগো য্যান কিছু আলাপ-সালাপ আছে এই দুই মাতারির লগে।
‘কী আচরিত বিষয়রে!’ এই কথাখান আইসা একলগে মংলার মা আর জুলেখার মায়ের মোনে ঝামটা মারে। ‘কাউয়ারা কথা কইতে চায় মিনিষ্যির লগে! এমুন কথা কে কবে শোনছে! আর এমুন বিষয়ই বা কে কবে দেখছে যে, দাঁড়কাউয়া আর পাতিকাউয়া আইসা একলগে বসা দেয় মানুষের সামোনে!’ দুই মাতারি মোখে কথা কয় না, কিন্তু তাগো দোনোজোনের মোনে অই একই কথা লড়তে থাকে।
এমনে এমনে কতগুলা পক্ষী আর দুই মাতারি মুখামুখি বইসা থাকে অনেকখোন। শেষে জুলেখার মায়ের মোনে অয়, কতখোন আর এমনে বোবা মাইরা বওয়া দিয়া থাকবো হেরা!
কী করবো কিছুই না বুইজ্জা জুলেখার মায় এমনেই জিগায়, ‘কী গো কাউয়া পক্ষী! ক্যান এমনে আইয়া বইছো গো তোমরা ধন? আমি দুক্ষিণীরে দিয়া তোমাগো কোন কাম হইবো রে পক্ষী?’
জুলেখার মায় এই কথা জিগাইয়াও সারে না, তক্ষণ তক্ষণ অতিবুড়া বকুলগাছের পাতা-ঠাইল্লার ভিতর দিয়া শেষ ফাগুন-মাইস্যা বাতাসে করে কী জোর আনাযান শুরু করে। শনশনশন আওয়াজ তোলা বাতাস।
দেখো সেই আওয়াজের কেরামতি! এই না মোনে হইলো ওইটা বাতাসের আওয়াজ! এই দেখো সেই বাতাসে দাঁড়কাউয়ার কথা ভাসে। সে কয়, ‘শোনো গো মাও-জননী! ফাল্গুন মাইস্যা সংক্রান্তির দিন—দোপোরে—আমাগো ভোগ দিবা তুমি!’
‘কী ভোগ কী ভোগ চাও রে দাঁড়কাউয়া!’
‘মুড়ি চাই না গো, চিড়াও চাই না। ভাতও চাই না, বাতাসাও চাই না মা!’
‘হায়রে হায়! অভাগী মায় আর কিছু যে দেয়, সেই খ্যামতা নি তার আছে!’
‘আছে গো আছে! ক্ষীর দিবা ক্ষীর! আউখের যে গুড় আছে—সেই যে আউক্ষা মিঠাই—তার ঘন ক্ষীর রাইন্ধা দিবা আমাগো! মাটিত দিবা না। মাইট্টা খোরায়ও দিবা না। দিবা কলার পাতে পাতে গো!’
‘দিমু দিমু রে কাউয়াসগল!’
‘ভিটির দক্ষিণের ঢালে ঢালে সাত সাতখান কলার পাত পড়বো। ক্ষীরে ভরভরা সাত পাত গো মা জননী!’
‘দিমু দিমু বাবাসগল! তোমরা নি আমার মাইয়ার সন্ধান জানো!’ জুলেখার মায় ডুকরানি দিতে থাকে। তার মোখ দিয়া কথা আর আগ্গাইতে চায় না। এদিগে ভাবে বুঝা যায় যে, কাউয়াপক্ষীগো কথা শেষ হয় নাই অখনো।
শেষে না পাইরা মংলার মায় নিজ গলায় আঞ্চল জাবড়ানি দিয়া কয়, ‘আর কিছু কি কওনের আছে রে ধনেরা?’
‘চৈত মাইস্যা পয়লা দিনে আরো দিবা তিন পাত মিঠাই। তিন পাতে তিন টুকরা।’
‘থানের কথা খোলাসা করো রে ধন! দিমু কী ঘাটলায়?’
‘কিনারের বকুল বিরিক্ষির গোড়ে দিবা গো। দিবা বিয়ানে। পইল্লা রইদের ঝটকা খালি আইবো দুনিয়ায়, বিরিক্ষির গুঁড়িত ভোগের পাত তক্ষণ তক্ষণই বিছাইয়ো গো মা।’
কথাখান কইতে কইতে ঝুপ্পুস কইরা দাঁড়কাউয়ায় শূন্যে উড়াল দেয়। তার পিছে পিছে এক লগে ছোটে সবটি পাতি কাউয়ায়। চক্ষের পলকে ভাঙ্গা ঘাটলা যেমুনকার সুনসান, তেমুনই সুনসান ছনছনা হইয়া যায়।
তখন আচমকাই দুই মাতারির খেয়ালে আসে যে, আগা-মাথা কিছুই ধরা যাইতাছে না ঠিক, কিন্তু তাগো জিন্দিগিতে বড়ো একখান তেলেসমাতির ঘটনা ঘইট্টা গেছে! সেইটা খোবই আচুইক্কা বিষয়! তারে না যাইবো কেউইর কাছে কওন, না যাইবো কেউইরে বিশ্বাস করানো!
তাইলে তারা অখন কী করবো! চিন্তায় মংলার মায়ের বেদিশা বেদিশা লাগে।
এইবার জুলেখার মায় আসোল বুঝের কথাখান পাড়ে মংলার মাওয়ের কাছে, ‘এই ভেদের কথা গুপ্তি রাখিস মংলার মা! দশজোনের কানে দিতে যাইস না! সেইটা করতে গেলে না আবার কোন অনিষ্টি আহে কপালে!’
মাতারি দুইজনেরই শোনা আছে যে, কাউয়াগো ভোগের লেইগা যে ক্ষীর রান্ধন লাগে, তাতে দুধ দেওয়ার নিয়ম নাই। তাইলে দুই মুষ্টি আতপ চাইলে, এট্টুক আউক্ষা মিঠাই দিয়া ভোগ রান্ধতে আর কতখোন! তাও জুলেখার মায় অতি বন্ধে-ছন্দে, অতি তরিজুত কইরা, অতি ডরে ডরে সারা বিয়ান ভইরা সেই ক্ষীর রান্ধে।
রান্ধতে রান্ধতে সেয় যেমুন ডরাইতে থাকে, সঠিক মাপ-মতোন ভোগের কলাপাতা কাটতে কাটতে মংলার মায়ও তেমুন ডরাইতে থাকে। কী জানি কিয়ের তেনে না আবার কী হইয়া যায়!
ভোগ দেওয়া হইলে পরে কি করোনের বিধি?
বিধি হইলো—তার পর সেই যে তুমি ঘুরান দিয়া হাঁটা ধরবা, আর খবরদার কোনোমতেই পিছে চাইয়া দেখবা না। খবরদার না।
সেই কথা জুলেখার মায়ে যেমুন জানে। জানে মংলার মায়ও। দোনোজোনেই জানে যে, ভোগ সাজাইয়া দিয়া ধুছমুছ কদমে জায়গা ছাইড়া যাইতে হয়।
তারা এওও জানে, এই যে তারা কাউয়াপক্ষীরে ভোগ দিতাছে; এইটাতে ডরের কিছু নাই।
তাও দেখো মাইনষের মন কিমুন বেবুঝ!
ফাগুন মাইস্যা সংক্রান্তির দিনে, ঠিক দোপোরের সোমে, ভিটির দক্ষিণের ঢালে পরিপাটি কইরা ভোগের পাতা পাততে পাততে ডরে তাগো দোনোজনের দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাইতে থাকে।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)