কুরোসাওয়া কথা

ছিঁচকাঁদুনের দ্বিতীয় জার্নাল

Looks like you've blocked notifications!

ভূমিকা

জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।

আমার বেড়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা রাখা দ্বিতীয় গোপন শক্তিটি ছিলেন কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক—তাচিকাওয়া সেইজি। আমি কুরোদায় বদলি হয়ে আসার বছর দুয়েক পর, মিস্টার তাচিকাওয়ার প্রগতিশীল শিক্ষামূলক মূলতত্ত্বগুলো স্কুলটির প্রিন্সিপালের রক্ষণশীল মূলতত্ত্বের সঙ্গে সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে; এবং আমার শিক্ষকটি চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তাঁকে শিক্ষকতা করানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় গিউসেই প্রাইমারি স্কুলে; সেখানে প্রচুরসংখ্যক মেধাবী মানুষের বিকাশ ঘটানোর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

মিস্টার তাচিকাওয়া সম্পর্কে আমার বলার অনেক কিছুই আছে; তবে আমি এমন একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করতে চাই, যেটি ঘটেছিল সেই সময়ে—যখন আমি সমবয়সী অন্য ছাত্রদের তুলনায় বুদ্ধিমত্তা বিকাশের বিচারে পিছিয়ে ছিলাম, এবং এ নিয়ে ছিলাম ভীষণ সন্ত্রস্ত। আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন মিস্টার তাচিকাওয়া এবং জীবনে প্রথমবারের মতো, আত্মবিশ্বাস নামের জিনিসটাকে আমি অনুভব করতে সক্ষম হলাম। ঘটনাটি ঘটেছিল আর্ট-ক্লাসের সময়।

তখনকার দিনে, যখন আমি ছাত্র ছিলাম, আর্ট শিক্ষার অবস্থা ছিল ভয়ানক বিশৃঙ্খল। নমুনা হিসেবে জাহির করা হতো কিছু রুচিহীন ছবি; আর আমাদের কাজ ছিল স্রেফ সেটিকে অনুকরণ করা। যে ছাত্রটি অরিজিনাল ছবিটির সবচেয়ে কাছাকাছি পর্যায়ের অনুকরণ করে ড্রয়িং করতে পারত, সেই সব সময় পেত সর্বোচ্চ নম্বর। কিন্তু মিস্টার তাচিকাওয়া এ রকম নির্বোধ কিছু করাননি। তিনি স্রেফ বলতেন, ‘যা মন চায়, আঁকো।’ সবাই ড্রয়িং পেপার আর রং-পেনসিল বের করে, আঁকতে শুরু করে দিত। আমিও আঁকতে শুরু করতাম : কী আঁকছিলাম, তা আর মনে পড়ে না এখন; তবে যা আঁকছিলাম, নিজেকে উজাড় করে দিয়েই আঁকছিলাম। পেনসিল এত জোরে চাপ দিয়েছিলাম যে, ভেঙে গিয়েছিল; এবং তারপর নিজের আঙুলের ওপর থুথু লাগিয়ে, রংগুলো লেপে দিয়েছিলাম চারপাশে; ফলে শেষ পর্যন্ত আমার হাত ভরে গিয়েছিল নানাবিধ রঙের বর্ণছটায়।

আমাদের আঁকা যখন শেষ হলো, মিস্টার তাচিকাওয়া প্রত্যেক ছাত্রের কাছ থেকে একটা একটা করে ছবি তুলে নিয়ে, মেলে ধরলেন ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। প্রত্যেকবারই ছাত্রদের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে মতামত জানতে চাইলেন তিনি; এবং যখন আমার ছবিটির পালা এলো, তখন সবাই শুধু একটা সাড়াই দিয়েছিল—জোরসে অট্টহাসি! কিন্তু হাসতে থাকা ছাত্রদের দিকে রাগী চোখে তাকালের মিস্টার তাচিকাওয়া এবং আমার ছবিটিতে থাকা আকাশের প্রশংসা করতে শুরু করলেন। তিনি ঠিক কী কী বলেছিলেন, এখন আর মনে নেই। তবে যতটুকু মনে করতে পারি, তা হলো, থুথু-ভেজা আঙুল দিয়ে আমি যেভাবে রংগুলো লেপ্টে দিয়েছি, সেটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তারপর তিনি আমার আঁকা ছবিটির ওপর উজ্জ্বল লাল কালি দিয়ে তিনটি বড় বড় সমক্রেন্দ্রিক বৃত্ত আঁকলেন : সর্বোচ্চ নম্বর! এ ঘটনাটি আমার হুবহু মনে রয়েছে।

এ সময়টির পর থেকে, যদিও তখনো স্কুল আমি পছন্দ করতাম না, তবু যেদিন আমাদের আর্ট ক্লাস থাকত, অন্তত সেদিন স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের তাড়া অনুভব করতে লাগলাম। সেই তিনটি বৃত্তের সেই মার্কিং—সেটি আমাকে ছবি আঁকা উপভোগ করতে শেখাল। যা মন চাইত, তাই আঁকতাম। আর ড্রয়িংয়ে সত্যিকার অর্থেই ভালো ছাত্র হয়ে উঠলাম। একই সঙ্গে অন্য বিষয়গুলোতেও আমার নম্বর প্রাপ্তির উন্নতি ঘটতে শুরু করল হঠাৎ করেই। মিস্টার তাচিকাওয়া যখন কুরোদা ছেড়ে চলে যান, আমি তখন আমাদের ক্লাসের প্রেসিডেন্ট [বা, ক্যাপ্টেন]; নিজের বুকে তখন বেগুনি ফিতা-অলা একটি ছোট্ট স্বর্ণের ব্যাজ পরতাম আমি।

কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় মিস্টার তাচিকাওয়ার সঙ্গে আরেকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত ছিল আমার। একদিন, আমার ধারণা তখন হ্যান্ডিক্র্যাফটসের ক্লাস চলছিল, তিনি মোটা কাগজের একটি বিশাল বান্ডিল সঙ্গে নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকলেন। আমাদের দেখানোর জন্য যখন সেটি মেলে ধরলেন, দেখি, নানা রাস্তার ড্রয়িং আঁকা একটি মানচিত্র। তারপর তিনি আমাদের দেখিয়ে দিলেন, যেন আমরা এই রাস্তাগুলোর ওপর নিজেদের বাড়ি বানিয়ে নিতে পারি, এবং বানিয়ে নিতে পারি নিজের শহর। প্রত্যেকেই ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে আঁকতে শুরু করলাম। অনেকগুলো আইডিয়া বেরিয়ে এলো, এবং শুধু প্রত্যেক ছাত্রের যার যার স্বপ্নের বাড়িটির ভেতর দিয়েই এটির শেষ হলো না, বরং তারসঙ্গে জুড়ে গেল গাছে ভরা রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, প্রাগৈতিহাসিক সব বৃক্ষ—যা কিনা ফুলে ফুলে ভরা। চমৎকার এক শহর হয়ে উঠল এটি, এবং ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠল ক্লাসের প্রত্যেক ছাত্রের একান্ত ব্যক্তিত্বের সৃজনশীলতা। আমাদের প্রজেক্টটি সমাপ্ত হওয়ার পর, আমাদের চোখ চকচক করে ওঠল, আমাদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং নিজেদের হ্যান্ডিওয়ার্ক দেখে আমরা গর্ববোধ করতে শিখলাম। সেই মুহূর্তটির অনুভূতি আমার স্মৃতিতে এতই টাটকা যে, মনে হয় যেন গতকালেরই ঘটনা।

তাইশু যুগের [১৯১২-১৯২৬] শুরুর দিকে, যখন আমি স্কুলে যেতে শুরু করেছি, তখন ‘শিক্ষক’ শব্দটি ছিল ‘আতঙ্কজাগানিয়া ব্যক্তি’র সমার্থক। ঘটনা হলো, এমন সময়েই আমি সৃজনশীল প্রেরণা জোগানো এমনতর মুক্ত ও অভিনব শিক্ষার দেখা পেয়েছি, মিস্টার তাচিকাওয়ার মতো এমন এক শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি—যা বিরল সৌভাগ্য মেনে নিয়ে, অতি সযত্নে পুষে রেখেছি নিজের মনে।

আমার বেড়ে ওঠার পেছনে তৃতীয় একটি গোপন শক্তিও কাজ করেছিল। কুরোদায় আমাদের ক্লাসেই আরেকটা ছিঁচকাঁদুনে পিচ্চি পড়ত, তার অবস্থা ছিল আমার চেয়েও করুণ। এই শিশুটির উপস্থিতি ছিল অনেকটাই যেন আমার মুখের সামনে কোনো আয়না ধরে রাখার মতো ব্যাপার। ফলে ওকে দেখে নিজের শোচনীয় অবস্থা উপলব্ধি করতে বাধ্য হতাম। টের পেয়েছিলাম, সে আসলে আমার মতোই; এবং তাকে দেখে দেখে উপলব্ধি করেছিলাম, তার আচার-আচরণ এতটাই অগ্রহণযোগ্য যে, নিজেকে নিয়েই অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম আমি। যে শিশুটি আমারই মতো, এবং যে শিশুটি আমাকে আমারই প্রতিফলন নিজ চোখে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল, সেই ‘ছিঁচকাঁদুনের আদর্শ নমুনাটির নাম ছিল উয়েকুসা কেইনোসুকে; এর দীর্ঘকাল পরে সে আমার বেশ কিছু সিনেমায় কো-স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে কাজ করেছে। [এখন, এ কথা শুনে তুমি আবার রাগ করো না, কেই-চান। আমরা দুজনেই ছিঁচকাঁদুনে শিশু, তাই না? এখন তুমি কেবল একজন রোমান্টিক ছিঁচকাঁদুনে, আর আমি একজন মনুষ্যত্ববাদী ছিঁচকাঁদুনে হয়ে উঠেছি।]

এক ধরনের আজব নিয়তির খেলা উয়েকুসা আর আমাকে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল। দুটি উইস্টেরিয়া-ভিনসের মতো বেড়ে উঠেছি আমরা, পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থেকেছি যমজের মতো। আমাদের জীবনের এ সময়কালটির বিশদ বিবরণ খুঁজে পাওয়া যাবে উয়েকুসার লেখা এক উপন্যাসে। তবে উয়েকুসার দৃষ্টিভঙ্গিটা একান্তই ওর, আর আমারটা আমার। মানুষ যেহেতু নিজেদের একটি সুনির্দিষ্ট পথে নিয়ে যেতে চায়, ফলে তারা যে সে পথেই সত্যিকার অর্থে রয়েছে, সেই বুঝ নিজেদের দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি ডিস্টার্বিং প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে। আমি যদি উয়েকুসার সঙ্গে কাটানো নিজের শৈশবের কথা নিজে লিখতে পারতাম, তাহলে তার উপন্যাসটির সঙ্গে তুলনা টানা যেত; ফলে সত্যের আরো কাছাকাছি পৌঁছাতে পারতাম আমরা। ঘটনা হলো, আমার কথা উল্লেখ না করে নিজের শৈশবের বর্ণনা উয়েকুসার পক্ষে টেনে আনা সম্ভব ছিল না; ঠিক তেমনইভাবে আমিও তার কথা না টেনে নিজের শৈশবস্মৃতি লিখতে অক্ষম।

কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের যখন আমরা ছাত্র ছিলাম, উয়েকুসা ও আমার সম্পর্কে যখনই লেখার চেষ্টা করি, আমার কেবলই মনে পড়ে যায়, আমরা দুজন ছিলাম একটি ওরিয়েন্টাল ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিংয়ের মধ্যে মানব অবয়বের দুটি ছোট্ট বিন্দুর মতো। নিজেদের আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি স্কুলের মাঠে উইসটেরিয়া কুঞ্জের নিচে, বাতাসে দুলতে থাকা গুচ্ছগুচ্ছ ফুলের মাঝে। দেখি, আমরা হেঁটে যাচ্ছি হাত্তোরোজাকার ঢালুতে, কিংবা কাগুরাজাকা পর্বতের চূড়োর দিকে। দেখি, অতিকায় এক জেলকোভা গাছের নিচে খড়ের পুতুলের গায়ে প্যারেক ঠুকে আমরা মন্দ আত্মার ভূত ঝাড়ছি—ভোর ২টা থেকে ৪টার মধ্যে, আওয়ার অব দ্য অক্স-এর পবিত্র মন্দিরে যাওয়ার পথে। এ ল্যান্ডস্কেপটির প্রতিটি বিষয় বারবার মনে আসে উজ্জ্বল স্বচ্ছতায়; অথচ এ দুই বালকের [আমাদের] অবস্থা ছায়াচ্ছন্ন ছাড়া আর কিছুই হয়ে রয় না।

এতটা সময় পেরিয়ে আসার পর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যায়নের এই ঘাটতির ফলে কিংবা নিজ ব্যক্তিত্বের কোনো এক খুঁতের কারণে, আমি তা বলতে পারি না, কারণটা যা-ই হোক, এ দুই বালকের বৈশিষ্ট্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মরণ করতে হলে সবিশেষ খাটাখাটনির দরকার পড়বেই। আমি বরং ক্যামেরা থেকে ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্স খুলে নিয়ে, তার জায়গায় একটা টেলিফটো লেন্স বসিয়ে, এ বিষয়টির খানিকটা সমতুল্য ছবি ফুটিয়ে তুলে, তারপর ভিউফাইন্ডারে আরেকবার চোখ রাখতে পারি। যদিও তা যথেষ্ট পরিষ্কার ছবি দেবে না! আমার প্রয়োজন এ দুই বালকের ওপর নিজের সব লাইট ব্যবহার করায় মনোযোগ দেওয়া, এবং লেন্স স্টপ-ডাউন করা—যেন ওদের স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি।

অতএব, তারপর, আমার টেলিফটো লেন্সের ভেতর দিয়ে উয়েকুসা কেইনোসুকের দিকে তাকিয়ে এখন দেখতে পাচ্ছি, আমারই মতো, সেও কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের বাদবাকি ছাত্রদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এমনকি তার পোশাকও আলাদা : সিল্কের মতো এক ধরনের পতপত করতে থাকা কাপড়ের পোশাক পরে আসে সে, আর তার হাকামা-ট্রাউজারটিও স্বাভাবিক ডাক-ক্লথ নয়, বরং একটা নরম ফ্যাব্রিকে বানানো। সব মিলিয়ে তাকে একজন মঞ্চাভিনেতার শিশুসন্তান বলেই মনে হয়। যেন সে প্রেমিক পুরুষটির একটি অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ হিসেবে অবতীর্ণ—যাকে আপনি এক পলকা ঘুষিতেই কুপোকাৎ করে ফেলতে পারবেন।

ওকে ‘একটা’ ঘুষি মারার কথা তো বললাম, বস্তুতপক্ষে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র হিসেবে উয়েকুসা সব সময় পতনের মধ্যেই ছিল, আর খালি কাঁদত। মনে পড়ে, একবার বিস্তৃত এক সড়কে সে পড়ে গিয়েছিল, এবং শৌখিন জামাকাপড় নষ্ট করে ফেলেছিল। সারাটা রাস্তা সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল; আমি ওকে সঙ্গ দিয়েছিলাম তখন। আরেকবার খেলতে নেমে একটা কাদার ডোবায় পড়ে গিয়েছিল সে; আর ঝকমকে সাদা অ্যাথলেটিক আউটফিটটি হয়ে গিয়েছিল কালো; এরপর সে যখন কাঁদতে শুরু করে দিল, ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা আমাকে করতেই হয়েছিল।

কথায় আছে, একই ধরনের পালকের সব পাখি একসঙ্গেই ঝাঁক বেঁধে ওড়ে। ছিঁচকাঁদুনে বালক উয়েকুসা আর আমার মধ্যেও তেমনই কিছু মিল ছিল; পরস্পরের প্রতি টান ছিল আমাদের; এবং একসঙ্গে খেলাধুলা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ভাইয়া আমার সঙ্গে যেমন করতেন, ধীরে ধীরে উয়েকুসার সঙ্গে তেমন আচরণ করতে শুরু করে দিলাম আমি। উয়েকুসার উপন্যাসটিতে, খেলাধুলার একটি অনুচ্ছেদে আমাদের সম্পর্কটির কথা বেশ খোলাখুলিভাবেই বর্ণিত রয়েছে। খেলার সময় উয়েকুসা বারবরই দেরি করে আসত; আর দুর্বোধ্য এক কারণে, সব সময় দ্বিতীয় স্থানে থেকে দৌড় শেষ করত। আমি পেছন থেকে তাড়া দিতাম ওকে, আর চিৎকার করে বলতাম, ‘বাহ! বেশ! ছুটো! আরও ছুটো!’ আমরা একসঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে, ফিনিশিং-লাইন পেরিয়ে যেতাম—হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার তাচিকাওয়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

খেলা যখন শেষ হতো, আমরা পুরস্কার পেতাম— রং-পেনসিল কিংবা পেইন্টস কিংবা এ জাতীয় কিছু; এবং তারপর ছুটে যেতাম উয়েকুসার অসুস্থ মাকে দেখতে। আনন্দে কেঁদে ফেলতেন তিনি; নিজের ছেলের পক্ষ থেকে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে থাকতেন। কিন্তু এখন সেদিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে টের পাই, ‘ধন্যবাদ আপনাকে’—এ কথাটি আমারই বলা উচিত ছিল; কেননা, এই দুর্বলচিত্তের উয়েকুসাই আমাকে তার জন্য সুরক্ষাদানকারী হিসেবে অনুভব করতে সাহায্য করেছে; এ সময়ে আমি কোনো-না-কোনোভাবে পরিণত হয়ে উঠেছি এমন এক মানুষে—যাকে জ্বালাতন করার সাহস আর রাখত না স্কুলের উৎপীড়ক কোনো ছাত্র।

আমাদের এই বন্ধুত্বকে মিস্টার তাচিকাওয়া বেশ প্রশ্রয়ের চোখেই দেখতেন বলে মনে হয়। ক্লাস প্রেসিডেন্ট হিসেবে একবার আমার পরামর্শ চাইলেন তিনি, ক্লাসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাকে নিযুক্ত করা যায়—সে ব্যাপারে। এ কথার মানে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নিশ্চয়ই দায়িত্ব পালনে খুব একটা সক্ষম নই; ফলে এক বিষণ্ণ, বিমূঢ় অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আমাকে। মিস্টার তাচিকাওয়া আমার এক্সপ্রেশনটি বুঝতে পারলেন; জানতে চাইলেন, কার নাম সুপারিশ করতে চাই। ক্লাসের একজন সেরা ছাত্রের নাম নিলাম আমি। মিস্টার তাচিকাওয়া জানালেন, এই পদটির জন্য তিনি তুলনামূলক কোনো কম আকর্ষণীয় ছাত্রের নামই শ্রেয় মনে করেন। তার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। বিস্তীর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, যে খুব একটা ভালো ছাত্র নয়, তাকে যদি আমরা এ দায়িত্ব অর্পণ করি, তাহলে তার পক্ষে নিজের উন্নতি ঘটানো এবং নিজেকে মূল্যবান হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হতে পারে। তারপর তিনি আমার সহপাঠীদের দেওয়া ডাকনামটি ধরেই ডাক দিলেন, ‘তাহলে, কুরো-চান, বলো তো, উয়েকুসার ভাইস প্রেসিডেন্ট তুমি হলে কেমন হয়?’ এ মুহূর্তটিতে আমি ব্যাপক মর্মস্পর্শী সচেতনতার ভেতর দিয়ে আমাদের দুজনের প্রতি মিস্টার তাচিকাওয়ার স্নেহের উষ্ণতা অনুভব করতে পেরেছিলাম।

গভীর এক অনুভূতি চোখে-মুখে প্রকাশ করে, তার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘ঠিক আছে, এটা চূড়ান্ত হয়ে গেল তাহলে।’ তিনি আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন, আর বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, খবরটা যেন এক্ষুনি উয়েকুসার মাকে আমি জানিয়ে আসি; তিনি জানতেন, ওর মা খুশি হবেন খুব। তারপর তিনি হাঁটা ধরলেন; মনে হলো, তার মাথার ওপর যেন এক ধরনের জ্যোতির্বলয় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এর পর থেকে লাল ফিতা-অলা একটা সিলভার বেজ নিজের বুকে লাগানো থাকত উয়েকুসার; এবং ক্লাসরুম ও স্কুলের মাঠ—সর্বত্রই সব সময় সে আমার পাশে পাশে থাকত। মুহূর্তেই পুরো ক্লাসটি তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শনাক্ত করে ফেলেছিল। ব্যাপারটা এমনই ছিল, যেন ক্লাসের ভাইস প্রেসিডেন্সির ফুলের টবটিতে সে চারা বুনেছে, আর সূর্যের আলোকে তা হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ। আর সে ফুলের কলি ফোটাতে শুরু করে দিয়েছে। মিস্টার তাচিকাওয়া যে তাকে ‘খুব একটা ভালোছাত্র নয়’ বলে অভিহীত করেছিলেন, সে বিষয়টি কোনো-না-কোনোভাবে হয়তো শুনতে নিন্দা বলেই মনে হয়েছিল; তবে বাস্তবতা হলো, আমার ধারণা, উয়েকুসার মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার দেখা নিজগুণে ঠিকই টের পেয়েছিলেন তিনি।

(চলবে)