গল্প পড়ার গল্প
আপসহীনতাই শিখিয়েছেন মানিক
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প পড়তে পড়তে আমি বেড়ে উঠেছি। মানিকের লেখা গল্প এবং মানিকের জীবনের গল্প আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিল একটি বার্তা, কেন লিখতে এলাম। মানিকের ‘লেখকের কথা’ বইটি ছিল আমাদের কাছে নতুন কথা। তিনি যেন ইশতেহার লিখেছিলেন সেই বইয়ে। লেখক হলেন কলম পেষা মজুর, মানিকই শিখিয়েছিলেন। মানিকের মৃত্যু, কমিউনিস্ট পার্টি এবং মানিক- এসব নানা কাহিনী এখনো পল্লবিত। আমি এইটুকু আন্দাজ করতে পারি, মানিককে ধারণ করতে পারেনি সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টি। না পেরেই যেন মানিককে বিব্রত করেছে পার্টি আমলারা।
মানিক ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত লেখক, আমাদের সাহিত্যে এমন বিরল প্রতিভা আর আসেনি। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, তিন রকম। মানিক হলেন সম্পূর্ণ নাগরিক মননের এক লেখক, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাস হাতে যে লেখক প্রবেশ করলেন আমাদের জীবন পাঠের ভিতর, তাঁর সাহিত্যবোধ আমাদের সাহিত্যে ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক থেকে কুষ্ঠরোগীর বৌ, সমুদ্রের স্বাদ, শিল্পী, ছোট বকুলপুরের যাত্রী... কত গল্প আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে একসময়। এখনো যদি নিয়ে বসি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প, টের পাই জীবনের এমন ভাষ্য কখনো ফুরায় না। মানিকের গল্প আমাদের অন্তর্গত রক্তের ইতিহাস যেন। আবার মানিকের গল্প আমাদের সব না পাওয়া, সমস্ত অপমানের ইতিবৃত্তও। মানিকের ‘মদন তাঁতীর গল্প’ ( শিল্পী ) সেই আরম্ভের দিনে শিখিয়েছিল যে শিল্পী আর শিল্পের দর্শন, তা হয়তো কোথাও এখনো বেঁচে আছে। শিল্পীর আপসহীনতাই শিখিয়েছেন মানিক।
আমি তাঁর উত্তরকালের গল্প সংগ্রহ খুলে ‘যাকে ঘুষ দিতে হয়’ পড়তে আরম্ভ করি। মানিক যে সময়ে লিখছেন, সেই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভাতের অভাব, কাপড়ের অভাব, কালোবাজারি, অনৈতিকতার ভিতরে ডুবে গিয়েছিল এই দেশ। পার্টিশন, উদ্বাস্তুস্রোত, দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত মানুষের কাছে স্বাধীনতার স্বাদ ছিল তেতো। ‘যাকে ঘুষ দিতে হয়’ তিন পাতার গল্প। এই গল্পের তিন চরিত্র- সুশীলা, সুশীলার স্বামী মাখন ও উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা দাস সায়েব। আর আছে মাখনের নতুন কেনা গাড়ির ড্রাইভার ঘনশ্যাম। মাখন ছিল সামান্য ঠিকাদার। কয়েক বছরের ভিতর হয়ে উঠেছে ধনী কনট্রাকটর। সুশীলাকে নিয়ে মাখন বেরিয়েছে বৈকালিক ভ্রমণে। ধীরে ধীরে গাড়ি চলছে মসৃণ রাজপথের ওপর দিয়ে। তারা বিত্তের সুখ আহরণ করতেই যেন বেরিয়েছে। ড্রাইভার বিরক্ত হচ্ছে গাড়ি শ্লথ গতিতে চালানোর হুকুম পেয়ে। এমন নতুন গাড়িতে গতি তুলতে তার খুব ইচ্ছা। তার তো এইটুকুই ক্ষমতা। সুশীলা সুখের আলস্যে রাস্তা দ্যাখে। বাসে বাদুড় ঝোলা হয়ে মানুষ ফিরছে। কিছুদিন আগে মাখনও অমনি ফিরত। সুশীলার কষ্ট হয় পথের মানুষ দেখে। এই সময়ে তাদের গাড়ির গতি রোধ করে অন্য একটি গাড়ি। দাস সায়েব। এই সায়েবের কাছে খুব কৃতজ্ঞ মাখন। ঘুস দিয়েছে বটে, কিন্তু বড় বড় কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছে অনেককে টপকে। আর তাতেই সে হয়ে উঠেছে বিত্তশালী। দাস সায়েব নিজের গাড়ি ছেড়ে তাদের গাড়িতে উঠে আসে। সুশীলার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি। তাঁর চোখ চিনতে পারছিল সুশীলা। অস্বস্তি হচ্ছিল ভিতরে। দাস সায়েবের কাছে লাখ টাকা ঘরে আসার একটি কাজ আছে। তা বাগাতে পারছিল না মাখন। দাস সায়েব সেই কাজের আলোচনা করতেই মাখন ও সুশীলাকে তার বাড়িতে ডাকে। তারা আপ্লুত হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় বসে তারা সেই কাজের আলোচনা করতে থাকে। সুশীলা নীরব দর্শক। আসলে যাকে ঘুস দিতে হয় সোজা সাপটা গল্প। কিন্তু ভয়ানক গল্প। ঘুস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা মাখনকে কাগজপত্র দিয়ে আর একজনের কাছে পাঠিয়ে দাস সায়েব বুঝিয়ে দেয়। মাখন তার ড্রাইভারকে জোরে চালাতে বলে। সুশীলাকে দাস সায়েবের কাছে রেখে লাখ টাকার ঠিকাদারি পাকা করতে ছুটল সে। এই গল্প পড়লে গা ঠান্ডা হয়ে আসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরকালে, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর যে লেখাগুলো লেখেন, তাতে এই রকম ঝাঁজ।
‘টিচার’ গল্পটি মনে করুন। ইস্কুলে ইস্কুলে টিচারদের বেতন প্রায় বন্ধ। আর বেতন এত কম যে তারা জোট বেঁধে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। রায়বাহাদুরের রাজমাতা হাই ইস্কুলেও তার ছায়া পড়েছে। ক’দিন আগে ছাত্ররা বিক্ষোভ জানিয়েছে ছাত্রদের ওপর পুলিশে গুলি চালানোয়। রায়বাহাদুর এতে বিরক্ত। ইস্কুলের সেক্রেটারি সে। ইস্কুলে এসে টিচারদের সামনে শিক্ষকের কর্তব্য নিয়ে বড় বক্তৃতা দেয়। স্বার্থ ভুলে, বিলাসের লোভ জয় করে, স্বেচ্ছায় দারিদ্রকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে যারা, বুনো রাম্নাথ যাদের গর্ব ও গৌরব, সামান্য কটা পয়সার জন্য তারা নিজেদের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেবে? অসভ্য মজুর ধাঙড়দের মতো ধর্মঘট করবে! রায়বাহাদুরের বক্তৃতার পর কেউ কোনো কথা বলে না। সদুপোদেশ শুনে প্রৌঢ় হেডমাস্টার শশাঙ্ক মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, গত মাসের বাকি মাইনেটা পেলে... সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
রায়বাহাদুর খোঁজ নেয়, কে উসকানি দিচ্ছে টিচারদের। তার সন্দেহ সে গিরীন। কিন্তু গিরীন যে শশাঙ্কর জামাই। শশাঙ্ক রায়বাহাদুরকে বোঝায়, গিরীন পলিটিক্স করে না, ওসবে নেই, মিটিং ফিটিং হলে হয়তো কখনো শুনতে যায়। সেদিন সন্ধেয় গিরীনকে নিজের বাড়িতে দেখে অবাক হয় না রায়বাহাদুর। ভয় পেয়েছে নির্ঘাত। শাশাঙ্কই পাঠিয়েছে ঠিক। ক্ষমা চাইতেই এসেছে টিচার। কিন্তু গিরীন সে কথার ধার দিয়েও যায় না। সে এসেছে তার ছেলের অন্নপ্রাশনে রায়বাহাদুরকে নেমতন্ন করতে। তাতেও রায়বাহাদুর বোঝে, তাকে সন্তুষ্ট করতেই গিরীনের আসা। ইঙ্গিতে বোঝান যে সে কর্তার অনুগতই। রায়বাঁহাদুর তার অপারগতা জানালে গিরীন বলে, তাকে পায়ের ধুলো দিতেই হবে, একটু আশীর্বাদ করে আসতেই হবে, সামান্য ফল-মূল মুখে দেবে রায়বাহাদুর। না গেলে গিরীন মনে বড় আঘাত পাবে। না, কোনো উপহার নিয়ে যেন না যায় রায়বাহাদুর। তাদের বংশের সেই রীতি।
গিরীনের বাড়ি পরের দিন রায়বাহাদুর গিয়েছিল। আর প্রত্যক্ষ করেছিল তার ইস্কুলের টিচার গিরীনের সংসারের ভয়াবহ দারিদ্র। সেই নিদারুণ অবস্থা চেনাতেই যেন তাকে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনা। এমন দীনহীন মানুষের ঘরবাড়ি, সংসার হয়! রায়বাহাদুর এমনতর দ্যাখেনি আগে। এমন ঘরবাড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখেনি তো কোনোদিন। এই ধরণের মানুষ তাকে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনার সাহস পায়নি কখনও। ছেলের অন্নপ্রাশন তো একটা উৎসবের ঘটনা, কিন্তু উৎসবের কোনো চিহ্ন এখানে নেই। গিরীন জোড়হস্তে রায়বাহাদুরকে অভ্যর্থনা জানায়। বলে, যথাসাধ্য আয়োজন করেছে সে, দোষত্রুটি যেন ক্ষমা করে দেন রায়বাহাদুর। কী ভয়াবহতায় রায়বাহাদুরকে নিয়ে এল গিরীন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবরণে মেরুদণ্ডের ভিতরে হিমস্রোত যেন টের পাওয়া যায়। রায়বাহাদুর টের পায় সে ফাঁদে পড়ে গেছে। রুগ্ন বাচ্চা, ছেঁড়া কাপড়ে কোনোরকমে সম্ভ্রম বাঁচানো অতিশীর্ণ একটি বউ, ততধিক শীর্ণ একটি কিশোরী, কুণ্ডলী পাকানো ঘেয়ো কুকুরের মতো দলা পাকিয়ে বসে থাকা একটি জবুথবু বুড়ো, লোমওঠা বেড়াল…, ক্ষুধার্ত ও রুগ্ন একটি পরিবার দেখাতেই যেন গিরীনের এই ডেকে আনা। রায়বাহাদুর পরিত্রাণ পেতে গিরীনের ছেলের চিকিৎসার ভার নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১০ টাকা বেতন বাড়িয়েও দেওয়ার কথাও বলে এবং গিরীন তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যানও করে। অন্য টিচাররা বলবে গিরীন তার বাড়িতে রায়বাহাদুরকে ডেকে এই ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাতে সে দোষী হয়ে যাবে। ‘টিচার’ গল্পে পরের দিন গিরীন বরখাস্ত হয়। মানিক সত্যকে সত্য বলে চিনতেন। বাংলা গল্পের এই ধারা মানিককে চিরঞ্জীবী করে রেখেছে। তিনিই এর স্রষ্টা। নিজেকে বুঝে নিতে মানিকে নত করতে হয় মাথা।