জ্যঁ পল সার্ত্রে, এখনো প্রাসঙ্গিক

বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রের জন্মদিন আজ। ১৯০৫ সালের এই দিনে প্যারিসে জন্ম হয়েছিল তাঁর। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অস্তিত্ববাদ নিয়ে দার্শনিক আলোচনার জন্য তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার বর্জন করে জন্ম দেন এক চিরস্থায়ী বিতর্কের। ২০১৪ সালে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জ্যঁ পল সার্ত্রের কাজ ও প্রভাব নিয়ে একটি বিশেষ রচনা, লিখেছেন স্টুয়ার্ট জেফ্রিস। সেটির ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে এই লেখাটি।
এখন এমন একটা সময় যে সবারই পুরস্কার থাকতে হয়। এখন পুরস্কার জয়ী সব লেখক জানেন যে অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আগে কখন আর কীভাবে ফটোশুট করতে হবে, কোন ভঙ্গিতে ট্রায়াল করতে হবে, বইটা জ্যাকেটের সঙ্গে চেপে ধরতে হবে কি না, দেয়ালের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে কি না, পেছনে স্পন্সরের ছবিটা কীভাবে থাকবে-এসব আর কি!
তবে সবার ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন না, কারো কারো ক্ষেত্রে একেবারেই অন্যরকম। মনে করুন ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবরের কথা। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার কী অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করলেন জ্যঁ পল সার্ত্রে। ‘আমি সব সময়েই দাপ্তরিক সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছি।’ এ নিয়ে পরে ব্যাখ্যা করেছেন সার্ত্রে। ‘একজন লেখকের কখনোই নিজেকে কোনো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া উচিত না। যে লেখক রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সাহিত্যিক ক্ষেত্রে অবস্থান তৈরি করেন; তাঁর কেবলমাত্র নিজস্ব এবং একান্ত বিষয়েই স্থির থাকতে হয় আর তা হলো শব্দ। হাতে লেখা শব্দ।’
সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে সারা জীবনই এক ধরনের যন্ত্রণায় ভুগতেন সার্ত্রে। এ বিষয়ে ১৯৪৭ সালে ‘হোয়াট ইজ লিটারেচার’-এ বলেছেন অনেক কিছু। যে বছর তিনি নোবেল প্রত্যাখ্যান করেন, সে বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর চমকপ্রদ আত্মজীবনী। শেষের দিকে লিখেছিলেন, ‘অনেক দিন ধরে আমি আমার কলমের দিকে এভাবে তাকিয়েছি যে, ওটা যেন একটা তলোয়ার, তবে আমি এখন জানি যে আমরা কতটা ক্ষমতাহীন!’ তাঁর কথায়, কবিতায় কিছু হয় না, রাজনৈতিক চেতনার সাহিত্যেও এর চেয়ে উন্নত কিছু নয়। নোবেল প্রত্যাখ্যান করার পর আরেকটা বিষয়েও আশঙ্কা জানিয়েছিলেন সার্ত্রে। তাঁর মতে, এ পুরস্কারটা ‘পশ্চিমের লেখক কিংবা পূর্বের বিদ্রোহী’দের জন্য সংরক্ষিত!
সার্ত্রের জন্য বিষয়গুলো আরো উৎকট হয়ে উঠেছিল। ‘ফিগারো লিতরেখ্’-এ তিনি পড়লেন, তিনি পুরস্কারের তালিকাতে ছিলেন-এটা জানতে পেরে কর্তৃপক্ষকে জানান যে, তিনি এই পুরস্কার চান না। এ নিয়ে সার্ত্রে বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না যে, যখন কেউ পুরস্কার পান, তাঁর মতামত ছাড়াই নোবেলের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এখন বুঝি, সুইডিশ অ্যাকাডেমি যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, চাইলেই সেটা নিমেষে বদলাতে পারে না।’
আফসোস ছিল কী? কিছু তো ছিল- অন্তত অর্থকড়ির বিষয়ে। সে সময়কার প্রায় আড়াই লাখ ক্রোনার, যেটা তিনি প্রাইজমানি হিসেবে পেতে পারতেন। প্রত্যাখ্যান বক্তব্যে তিনি জানান যে, এ অর্থ তিনি লন্ডনের ‘অ্যাপার্থেড কমিটি’তে দিতে পারতেন, যাদের সহায়তা বেশ দরকার ছিল।
‘সমসাময়িক কালে সুদূরপ্রসারী প্রভাব’-এর স্বীকৃতিস্বরূপ সার্ত্রেকে নির্বাচিত করেছিল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। আসলেও কি তাই? সংগ্রামী ছাত্রদের কাছ থেকে বিশাল সম্মাননা পেয়েছিলেন প্যারিসে, ১৯৬৮ সালের মে মাসের ঘটনা। কিন্তু দার্শনিক হিসেবে তাঁর সুনাম ততদিনে পড়তির দিকে। তাঁর অস্তিত্ববাদ তত্ত্বে ঝলকানি তখন কাঠামোবাদী (যেমন ক্লদ লেভি-স্ত্রস এবং লুই আলথুজার) এবং উত্তর কাঠামোবাদীদের (যেমন জাক দেরিদা এবং গিল দেলুজ) ছায়ায় ঢেকে গেছে।
এই সময়ে তাহলে সার্ত্রের লেখাকে কেমনভাবে যাচাই করা যায়? মেধা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় নিয়ে তাঁর সংগ্রাম এবং কাজের গুরুত্ব এখনো প্রাসঙ্গিক। যখন আমরা ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’-এ ‘ব্যাড ফেইথ’ বিভাগটি পড়ি, তখন ও ওয়েটারের দাঁড়ানোর বা মুখভঙ্গি দেখে চমকে না গিয়ে উপায় থাকে না। এই প্রতিমূর্তির প্রভাব তো আমাদের এখনকার সমাজেও সুস্পষ্ট। যখন আমরা তাঁর নাটক ‘হুইস ক্লোস’ দেখি, তখন বুঝতে পারি যে মানুষে মানুষে আমাদের সম্পর্কের জায়গাটা এখন কতটা বাজে হয়ে উঠেছে। নিজেদের কাজ সমাধার জন্য আমরা তাদের ব্যবহার করি, নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে তাদের ব্যবহার করি। মানুষ কী কী করতে সক্ষম, সে বিষয়ে আমরা যখন তাঁর মতগুলো পড়ি, তখন মানুষ হিসেবে অনেক বিষয়ে আমাদের দায়িত্বটা বুঝতে পারি। এই দায়িত্বগুলো আমরা পালন করতে পারি চিন্তাভাবনায় এবং কার্যক্রমের যুথবদ্ধতায়, পরিবর্তন করতে পারি আমাদের ভাগ্যের।
সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রগাঢ় প্রতিজ্ঞা, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হিসেবে সার্ত্রের অবস্থান স্পষ্ট, জীবন্ত। যেমন ধরুন ‘ইন্টিমেসি’ নামে তাঁর একটি ছোটগল্পের কথা। এমন একটি চরিত্রকে আমরা দেখি, যে স্বাধীনতা নিয়ে আতঙ্কিত, যে সব সময় চায় যে তার সিদ্ধান্তগুলো তার হয়ে অন্য কেউ নিয়ে নিক। নিজের মধ্যে থাকা, অন্যের অস্তিত্বের জন্য থাকা, সবার অস্তিত্বের জন্য থাকা- এই জটিল মারপ্যাঁচে আমরা বুঝে উঠি যে মানুষ আসলে কী! কারো বা সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে বা সঠিক আত্মপরিচয় তুলে ধরতে আজন্ম-আকাঙ্ক্ষিত একটি সত্ত্বা।
অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের আজন্মের সংশয়, দ্বিধা, উদ্ভট চিন্তা, রাজনৈতিক দায়িত্ব-এসব সার্ত্রে চিহ্নিত করেছেন নিখুঁতভাবে, আর তার ব্যাখ্যা এখনো স্পষ্ট। আমরা যা করেছি, সোজা একটা পথ বেছে নিয়েছি, ওগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সার্ত্রে সেটা করেননি, এটা মোটেও বিস্ময়কর ছিল না, বিশেষ করে সার্ত্রের জন্য। অন্যরা যে বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেটা তিনি মেনে নিতে পেরেছিলেন খুব সহজভাবেই।