বঙ্গাব্দ নয়, ত্রিপুরাব্দকে ঘিরেই বৈসু উৎসব উদযাপন করে ত্রিপুরারা

Looks like you've blocked notifications!

ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো ও নানান করণের (রিচ্যুয়াল) মধ্য দিয়ে শুরু হলো বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসু উৎসব। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, রাজবাড়ীসহ আরো বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বসবাস। এক যুগে ত্রিপুরারা ত্রিপুরাব্দ বর্ষের বৈসু উদযাপন করে থাকে।

আজ (১৩ এপ্রিল) ১৪২৬ ত্রিপুরাব্দ ও ১৪২৩ বঙ্গাব্দ বর্ষের ৩০ চৈত্র। এ হিসেবে আজকে ত্রিপুরাদের হারি বৈসু। অর্থাৎ বৈসু উৎসবের প্রথম দিন। এ দিনে ত্রিপুরারা ফুল আর পাতায় ঘরবাড়ি সাজায়। ত্রিপুরাদের ঘরের দরজা এখন নিমফুল, বেতপাতাসহ নানা ফুলে সাজানো হয়েছে। গৃহপালিত প্রাণীকেও ফুলের মালা পরানো হয় এ দিনে। তিন দিনব্যাপী বৈসু উৎসবে পালন করা হয় নানান করণ। এদিনের মধ্যে গাছের ফল, শাকসবজি, তরিতরকারি তুলে রাখতে হবে। কারণ, দ্বিতীয় দিন বৈসুমাতে কোনো ধরনের কাটা মারা ছিঁড়া যায় না।

করণ (রিচ্যুয়াল)

ফুল দিয়ে গঙ্গা পূজা, হলুদ, ঘিলা ও কুচাই (তেঁতুলের মতো শুকনো একটি জংলি ফল) একত্রে বেঁটে তা একটি বাঁশের চোঙায় ভরে, তারপর তিন বা সাত বাড়ির চালে পানি ঢেলে ছাউনি থেকে পড়ন্ত পানি চোঙা পেতে ভরতে হবে। শেষে গঙ্গার (প্রবহমান নদী) পানি মিশিয়ে শুদ্ধিকরণ পানি তৈরি করা হয়। এ পানি দিয়ে বাড়ির সকল সদস্যকে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ফলমূল গাছেও ছিটানো হয় এ পানি। এ করণটি করে থাকে ত্রিপুরা পুরুষরা। আর নারীরা করে ফুল দিয়ে গঙ্গা পূজা। বৈসু উৎসবে তিন দিন নদীর স্নানঘাটের উজান ফুলেল হয়ে ওঠে।

ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, এ পানি ছিটালে পুরোনো বছরের গ্লানি, অশুভ শক্তি দূর হয়, বন্ধ্যা ফল গাছে ফল ধরবে। বৈসুতে নারী-পুরুষের এ করণগুলো তিন দিনব্যাপী হয়ে থাকে।

বৈসুমা বা আতাদাক

ত্রিপুরা বৈসুর দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা বা আতাদাক বলে থাকে। এ দিনেও প্রথম দিনের মতো করণ সম্পন্ন করা হয়। এদিন, ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা স্নান শেষে নতুন জামাকাপড় পরে বাটিতে করে ধান হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে। বাড়ির উঠানে ধান ছিটিয়ে ওই বাড়ির বয়স্কদের প্রণাম করে আরেক বাড়িতে চলে যায় ছেলেমেয়েরা। উঠানে ধান ছিটানোর উদ্দেশ্য হলো, গৃহপালিত হাঁস-মুরগির খাদ্য দান করা।

তারপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানাহার করার পালা। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গন্দ (লাব্রা), পিঠা, পায়েস, সেমাই ইত্যাদি ভোজনে ব্যস্ত থাকে সব বয়সের মানুষ। তবে, বয়স্ক পুরুষরা মদ্য পানীয় বেশি গ্রহণ করে থাকে বৈসুতে। এদিন কোনো মাছ-মাংস ভোজন করা চলে না। সম্পূর্ণ নিরামিষ।

ভারত ও বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা চৈত্রের ৩০, ৩১ ও বৈশাখের ১ তারিখে হারি বৈসু, বৈসুমা ও বিসিকাতাল উদযাপন করে থাকে বলে অনেকেরই ধারণা ত্রিপুরারা বঙ্গাব্দ বর্ষকে ঘিরে উৎসব উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বলে দাবি করেন বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক মুখ্য প্রযোজক ও বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক প্রভাংশ ত্রিপুরা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বঙ্গাব্দ থেকে ত্রিপুরাব্দ তিন বছরের বড়। ত্রিপুরাব্দই আগে শুরু হয়েছিল। মূলত ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দও পয়লা বৈশাখে নববর্ষ শুরু করেছিল।

বিসিকাতাল

পয়লা বৈশাখই ত্রিপুরাব্দের নববর্ষের শুরুর দিন। এদিন অন্যান্য রিচ্যুয়ালের সঙ্গে বাড়ির মাতা-পিতা, দাদা-দাদিদের স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় দান করা হয়। এদিন ত্রিপুরাদের প্রতিটি বাড়িতে মাছ-মাংসের আয়োজন চলে। এদিন নারীরাও মদপানে অংশগ্রহণ করে থাকে।

গরিয়া

ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো তাঁদের প্রধান দেবতা গরিয়া দেবের পূজার নৃত্য। গরিয়া পূজায় যাঁরা নাচে, তাঁদের বলা হয় খেরাবই। গরিয়া দেবের প্রতিমূর্তিকে বহন করে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় নৃত্য পরিবেশন করে খেরাবই দল।

ত্রিপুরাব্দের সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য

জানা যায়, স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজা হামতরফা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরাব্দ বা ‘তিপ্রা বিসি কাতাল’ প্রচলন করেন। তখন খ্রিস্টাব্দের বাস্তবিক বয়স ছিল মাত্র ৯০ বছর। এবং ভারতে তার অস্তিত্বও ছিল না। শকাব্দের বয়স তখন ৫১২ বছর এবং ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত অব্দ ছিল। শকাব্দের পরবর্তী বিভিন্ন অব্দের ন্যায় ত্রিপুরাব্দও শকাব্দের মাসকেই অনুসরণ করত। ত্রিপুরাব্দের মাসের সঙ্গে শকাব্দের মাসের যে সামঞ্জস্য ছিল, তার প্রমাণ ত্রিপুরা রাজাদের সনন্দ বা তাম্র শাসনে পাওয়া যায়।

২০০৮ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে প্রকাশিত ‘ট্রুথ অ্যাবাউট ত্রিং’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ বইয়ে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, বঙ্গাব্দ প্রচলনের তিন বছর আগে ত্রিপুরাব্দ প্রচলন হয়েছিল। অর্থাৎ ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দ প্রচলন করা হয়েছিল।

ত্রিপুরাব্দ বর্ষের মাস ও বারের নাম কেন বাংলায় রাখা হলো? এ ব্যাপারে লেখক ও গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা বলেন, ‘স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজারা বাংলা সাহিত্যেও অনুরাগী ছিলেন এবং সে সময় ককবরক (ত্রিপুরা ভাষা) লিখিত রূপের চর্চা ছিল না, এ কারণে শকাব্দের বার ও মাসকেই অনুসরণ করা হয়েছিল।’

বর্তমানে ত্রিপুরাদের কিছু সংগঠন ত্রিপুরাব্দ ক্যালেন্ডার নামে মাঝেমধ্যে যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে থাকে, এটা সর্বজনস্বীকৃত নয় বলেও অভিমত প্রকাশ করেন প্রভাংশু ত্রিপুরা। তাঁর দাবি, এটা ত্রিপুরা রাজ্যের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রচলন করা ক্যালেন্ডার। এই বিতর্কিত ক্যালেন্ডারটি খ্রিস্টধর্মের কিছু উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছিল বলেও তাঁর দাবি।

ভারতের গবেষক ড. অতুল দেববর্মার প্রস্তাবিত ককবরকে বার, মাস, ঋতুর নাম ব্যবহার করে ত্রিপুরাব্দ বর্ষ পঞ্জিকা প্রচলন করতে বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের প্রতি আহ্বান জানান।

পপেন ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি