গল্প পড়ার গল্প
ঘটনাপুঞ্জের লেখক নন সতীনাথ ভাদুড়ী
সতীনাথ ভাদুড়ীকে আমরা প্রথম চিনি ‘জাগরী’ উপন্যাসে। তারপর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানসে’। আমার অসম্ভব প্রিয় উপন্যাস ‘অচিন রাগিনী’। সতীনাথ থাকতেন বিহারের পূরণিয়া জেলায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়েছেন, জেল খেটেছেন। হিন্দি ভাষার বড় লেখক ফনীশ্বরনাথ রেনুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে জেলেই। ফনিশ্বরনাথ রেনুজির সংস্পর্শে এসে তাঁর সাহিত্য সাধনার সূত্রপাত। সতীনাথের ‘জাগরী’ উপন্যাসে নিজের জীবনের ছায়া আছে। উত্তর বিহারের ওই অঞ্চলের অচ্ছুৎ ধাঙড় সম্প্রদায়ের জীবন কথা, তাৎমাটুলীর কাহিনী ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি উপন্যাসের একটি। ভারতীয় সাহিত্যে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ একটি বড় জায়গা নিয়ে আছে। নিম্নবর্গের মানুষ বোধ হয় এমন ভাবে আগে আর আসেনি। হ্যাঁ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ে এর সূচনা হয়েছিল সত্য, সতীনাথ তাকে দিয়েছেন মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি।
আত্মার আত্মীয় করে গড়ে তুলেছেন নিম্নবর্গের মানুষকে। সতীনাথ অসম্ভব সব গল্প লিখেছেন তাঁর দেখা কত রকম মানুষ নিয়ে। গ্রাম-ভারতের আত্মাকে তাঁর গল্পে ধরা যায়, যেমন ধরা যায় তাঁর উপন্যাসে। ‘চখাচখী’ গল্পটির কথা মনে করুন। সেই দেহাতি দম্পতির ছিল অসামান্য প্রেম। কিন্তু তাদের বিয়েটাই হয়নি। পুরুষটির মৃত্যুর সময় নারী তাকে ছেড়ে গিয়ে আড়াল থেকে দ্যাখে, বুড়ো তার ছেলের হাতের জল পাবে, আগুন পাবে। এমন প্রেমের গল্প বিরল। গণনায়ক গল্পে দেশভাগ, স্বাধীনতা এমন বিচিত্রভাবে আসে, যে তার অসারতাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। জটিল মন আর আলোকময় মানুষের কত গল্প লিখেছেন সতীনাথ। অনেক গল্পের কথা বলা যায়। সতীনাথ শুধু কাহিনী কথক ছিলেন না। তাঁর গল্প জীবনবোধে সিক্ত। ঘটনাপুঞ্জের লেখক নন তিনি, ঘটনাকে ছাড়িয়ে আরো দূরে ব্যপ্ত হতো তাঁর গল্পের চরাচর।
‘বৈয়াকরণ’ গল্পটিতে এক সংস্কৃত পণ্ডিত তুরন্তলাল মিশ্রের কথা আছে। পণ্ডিতজি জেলা স্কুল থেকে অবসর নিয়ে এক বালিকা বিদ্যালয়ে যোগদান করেছে। তার সঙ্গী এক মৌলবী সাহেব। সে পড়ান উর্দু। এই বিদ্যালয়ে আর কোনো পুরুষ শিক্ষক নেই। মৌলবী সাহেব জীবন রসিক। তার দাড়ি গোফ কালো কুচকুচে। খুব শিগগির আর একটি বিবি আনবে ঘরে। আর পণ্ডিত তুরন্তলাল মিশ্র নিষ্ঠাবান, শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ। পূজা-আহ্নিক করে, কুক্কুটান্ড, মুরগির ডিম দেখলে তার গা গুলিয়ে ওঠে। মেয়ে স্কুলে এসে নিজেকে কুয়ো থেকে জল তুলে ঘটি করে আলতো করে পান করতে হয়। আগের জেলা স্কুলে তেওয়ারি নামের চাপরাসিটি তুলে দিত। এখানে এই ইস্কুলের তেমন কর্মচারী হলো দাঈ, নারী। তাদের তিনি গলা তুলে ডাকতে পারে না। সে মিথিলার ব্রাহ্মণ। দাঈদের হাতের জল খাবে কী করে? আসলে পণ্ডিতজির খুব সংস্কার। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গেলে তার মনে আগলে সব আটকে যায়। ক্লাসে গিয়ে তার নাতনির বয়সী ছাত্রীদের দিকেও সরাসরি তাকাতে পারে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। লীলা নামের কুরূপা মেয়েটির কাছে সে স্বচ্ছন্দ। বিচিত্র মানুষের মন। লীলাকে নিগৃহিত করেও সে স্বস্তি পায়। নিগ্রহ মানে পড়া না বলতে পারলে বকাবকি। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী মেয়েটি, মালবিকা তাকে প্রায় মানেই না। তার মনের সংকট টের পেয়ে হাসাহাসি করে সারা ক্লাসই। জেলা স্কুলেও এমন হতো। কিন্তু ছাত্রদের কাছে সে ছিল স্বাভাবিক। এই গল্প একটি মৃত্যুকে ঘিরে।
দুই মাস আগে তার বাড়ি এসেছিল তার শ্যালক ও তার স্ত্রী। সঙ্গে এনেছিল স্টোভ। সেই স্টোভের আগুন শাড়িতে লেগে শ্যালকের স্ত্রী শালাজ পুড়ে যায়। তার সুন্দর মুখখানি ব্যতীত দেহের সমস্তটাই দগ্ধ হয়ে যায়। তখন মালবিকা মেয়েটি তার মায়ের করে দেওয়া এক মলম এনে দিয়েছিল দগ্ধস্থানে লাগাবার জন্য। দরজা বন্ধ করে দগ্ধস্থানে সেই মলম লাগিয়ে দিত পণ্ডিতের স্ত্রী। সেই সময় তুরন্তলাল মিশ্র, পণ্ডিত শুনেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী সেই দগ্ধ বধূর একটি বাক্য। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বধূর কথা হচ্ছিল। সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী। দগ্ধবধূ বলছিল তার আর বেঁচে থাকার দরকার নেই... ছি ও কথা বলতে নেই... আমার মরে যাওয়াই ভাল...। সেই কথোপকথনের ভিতর শালাজ বলেছিল, ‘ওরা কি ওই চায়!’ ওরা শব্দটি নিয়েই গোলমাল। তুরন্তলাল মিশ্র ব্যকরণতীর্থ। টোলে পড়ার সময় সেখানকার পণ্ডিত মশায় তাঁকে বলেছিলেন, তুরন্ত, ব্যকরণ পড়, কাব্য পড়ে কী হবে? মনকে চঞ্চল করে ও জিনিশ। ইন্দ্রিয়াশক্তির অবলম্বনেই কাব্য বেঁচে থাকে। তিনি সমস্ত সময় নিষ্কলঙ্ক চরিত্র হয়ে বেঁচে থাকতে চান। মুমূর্ষু নারীর মুখের ওই ওরা শব্দটিই তাঁকে নিয়ত পীড়ন করছে। জটিল এক মানব মনের গল্প এইটি। সংস্কৃত পণ্ডিত ভাবছে তার কি স্খলন হয়েছে কোথাও? ওরা অর্থাৎ আর সব পুরুষ। তার স্ত্রীকে যখন বলছিল কথাটি, তার অর্থ খুবই পরিষ্কার।
ওরার ভিতরে সেও আছে। স্ত্রীর উত্তর সে শুনতে পায়নি দরজায় কান রেখে। কিন্তু মনের ভিতরে এক অন্ধকার তো ঢুকে গেছে। মৌলবী সাহেবের নির্দোষ কথার ভেতরও সে যেন বিদ্রুপের ছায়া খুঁজে পায়। ক্লাসের মেয়েরা তার ব্যাকরণ উচ্চারণ বিয়াকরণকে যখন বিয়া-করণ উচ্চারণ করে শব্দটি ভেঙে দিয়ে, হো হো হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। স তৌ তে, ‘তে’ মানে ওরা। ‘তে’ শব্দটির সঙ্গে ইংরেজি they শব্দটির অদ্ভুত মিল। ‘তে’ বহুবচন। পণ্ডিত ক্লাসে বোঝাতে বোঝাতে থেমে গেছে। সতীসাধ্বী মৃত্যুর আগে ‘তে’ ব্যবহার করল কেন? বহুবচন। ওরা বলতে কি নিজের স্বামীর কথাই ভেবেছিল সে? না কি সমগ্র পুরুষজাতি? ওই কথা যে ভুল তাকি জানত না শালাজ? তাঁর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কত নিষ্ঠাবান সংযমী পণ্ডিত! তা ভুলে গিয়েছিল সে? নাকি স্বামীর সম্পর্কে ওই রকম তীব্র মন্তব্য করছে বয়স্থা ননদের কাছে, তাই বহুবচন করে দেওয়া? নিজের স্বামীর সম্পর্কেই বা অমন ধারণা হলো কেন তার? সামান্য একটি বাক্য, তার ভিতরে একটি শব্দ পণ্ডিতজির নিদ্রা হরণ করেছে যেন। ইস্কুলের দাঈ একটি চিঠি নিয়ে ঢুকল তাঁর ক্লাসে। খুব সাবধানে নিল সে। দাঈয়ের আঙুলে আঙুল যেন না ছোঁয়। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করে সে পরস্ত্রী নিয়ে এত শুচিবাই কেন তার?
সেই মৃতপত্নীক শ্যালক আবার বিয়ে করছে। দুই মাসের ভেতরই আবার বিয়েতে বসা, মনটা খারাপ হয়ে গেল। পণ্ডিতজির মন থেকে সেই দগ্ধ বধূর কথাটি সরছে না। ‘ওরা’ শব্দটির ভিতরে মৃত শালাজ কাউকে বাদ দেয়নি। তার মতো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকেও না। ‘তে’-ওরা বহুবচন। পণ্ডিতজি ক্লাসের কুরূপা মেয়েটি লিলিকে জিজ্ঞেস করে, বহুবচন অনেকজন উল্লেখের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, কিন্তু কখন একজনের ক্ষেত্রে তা উল্লেখ করা হয়? লিলি পারে না। কেউ জানো? কেউ না। মালবিকা ক্লাসে থাকলে পারত। পণ্ডিতজি ব্ল্যাক বোর্ডে বড় করে লিখল, গৌরবে বহুবচন। স্ত্রীর উক্তিতে পতির সম্বন্ধে উল্লেখের সময় সম্মানার্থে বহুবচনের ব্যবহার হতে পারে। মালবিকা ক্লাসে ঢোকে একদম শেষ দিকে। অনেক সময় বাইরে কাটিয়ে এলো সে। তাকে কড়া ধমক দিতে গিয়েও পারে না পণ্ডিতজি। সে বড় সুন্দর। মেধাবী। তাকে জিজ্ঞেস করে বিম্বোষ্ঠ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গে কী হতে পারে? এত সহজ প্রশ্ন? বিম্বোষ্ঠা, বিম্বোষ্ঠি... মালবিকা উত্তর দিতে পণ্ডিতজির মনে মনে হলো তাঁর বিচ্যুতি ঘটেছে। ক্লাসের মেয়েরা কি তা টের পায়নি? মনের কুহেলির ভিতরে সে ওরা শব্দের অর্থ টের পাচ্ছে। বৃথাই সে একটি অলঘু বিষয়কে লঘু করতে চাইছে গৌরবে বহুবচন সূত্র দিয়ে। ব্ল্যাক বোর্ড থেকে গৌরবে বহুবচন বাক্যটিকে মুছে দিল। সে নিজেকে চিনতে পারছেন। চিনে গেছে সবাই তাঁকে। সতীনাথ ভাদুড়ীর এই গল্প শেষ অবধি কোথায় যে নিয়ে যায়, মনের কোন অন্ধকারে, তা গল্পটির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তাঁকে প্রণাম।