উত্তর চর্থা থেকে নয়া রশেল : আলেয়া চৌধুরীর অদিসি

Looks like you've blocked notifications!

বর্তমান রচনাটি আমাকে লিখিতে হইয়াছিল আজ হইতে পঁচিশ বছর আগে—মোতাবেক ইংরেজি ১৯৯২ সনের মাঝামাঝি কোন একসময়। সেই সময় আমি উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগামী ছাত্র পরিচয়ে মার্কিন মুলুকে বসবাস করিতেছিলাম। সেখানেই আমার পরিচয় ঘটে কবি আলেয়া চৌধুরীর সহিত।

অবশ্য আগেও—১৯৭০ দশকের শেষাশেষি—দুয়েকবার ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কবিযশপ্রার্থী আলেয়া চৌধুরীর সহিত আমার দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছিল। অনেকদিন পর—১৯৯০ সালের দশকে—উত্তর আমেরিকায় তাঁহার সহিত নতুন করিয়া পরিচয় করাইয়া দেন আমার সেকালের প্রতিবেশী কবি আলম খোরশেদ। পরিচয়পর্বের পর জানিতে পারি, আমাদের কালের নায়ক আহমদ ছফার সঙ্গেও আলেয়া চৌধুরীর বেশ জানাশোনা ছিল।

উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত কয়েকজন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী তখন ‘শঙ্খচিল’ নামে একটি ক্ষুদে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়াছিলেন। তাঁহাদের অনুরোধে আমি আলেয়া চৌধুরীর কবিতা প্রসঙ্গে এই নাচিজ লেখাটি লিখিতে বসিয়াছিলাম। পঁচিশ বছর পর আচমকা লেখাটি আবার হাতে পড়িল। এখানে প্রকাশোপলক্ষে দুয়েকটি শব্দ এদিক-ওদিক করিয়া লইয়াছি। তবে মূল কাঠামোতে কোন ব্যয়-পরিবর্তন করি নাই। আলেয়া চৌধুরীর সহিত অনেকদিন আমার আর যোগাযোগ নাই। আশা করি তিনি আজও বাঁচিয়া আছেন।

—এপ্রিল ২০১৭

সামরিক অভ্যুত্থান সফল করে ক্ষমতা দখল করেননি আলেয়া চৌধুরী। যতদূর জানি, ছয় আগুন পিস্তল হাতে দৈনিক বাংলা ভবনে কাউকে চেপেও ধরেননি তিনি। তবু শামসুর রাহমান যে তাঁর এই চার নম্বর কবিতা সংগ্রহের একটি স্মরণীয় ভূমিকা লিখে দিয়েছেন তা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। ‘সহজ কথায় আবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা,’ শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘আলেয়ার আওতাধীন—এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য।’

‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ বইয়ের কবিতাগুলি পড়ে আমারও মনে হয়েছে শামসুর রাহমানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করার কোন প্রয়োজন নেই। রাহমান বলেছেন, ‘নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে তাঁর অধিকাংশ কবিতা’—এটিও বিলক্ষণ খাঁটি পর্যবেক্ষণ বিশেষ। কার কবিতাই বা না অভিজ্ঞতার! এমনকি স্তেফান মালার্মের পদ্যকেও অনভিজ্ঞতার চৌবাচ্চায় ধোয়া তুলসি পাতা বলা যাবে না। তবে আলেয়ার কবিতাকে এভাবে অভিজ্ঞতার লেবেল দেয়া কেন?

উত্তর চর্থা, জেলা কুমিল্লার আলেয়া চৌধুরী এখন উত্তর আমেরিকার প্রাণকেন্দ্র নিউ ইয়র্ক শহরের অদূরে নিউ রশেল নামক এক উপশহরে থাকেন। যতদূর শুনেছি তিনি কাজ করেন কোন শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে। একদা খবরের কাগজের হকার ছিলেন তিনি, ট্রাকচালকের কাজও করেছেন কিছুদিন। কিছুটা রাজনীতির সাথেও হয়তো তাঁর যোগ ছিল। তারপর তিনি শুদ্ধ মজুরের কাজ হাতে নিয়ে ইরানে যান, সেখান থেকে পশ্চিম এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশ হয়ে এয়ুরোপ, বিশেষ করে জার্মানি পর্যন্ত সফর করেন। তারপর বাহামা হয়ে বিনা দলিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজির হন। আলেয়ার এই বিস্তর ঝুঁকিবহুল জীবনের জলছবি আছে বলেই তাঁর কবিতা বিশিষ্ট—একথা বলা অবশ্য আমার উদ্দেশ্য নয়।

গত পনের কি দশ বছরে বাংলামুলুক থেকেও কিছু কম জনমজুর এই মার্কিন মুলুকে আসেননি, যাঁরা এসেছেন তাঁরা সকলেই কবি নন—একথা বলাই বাহুল্য। সংবাদপত্রের মধ্যস্থতায় আর নিউ ইয়র্ক শহরের বাঙ্গালি ঘেটো বা ঘেরাটোপের আশেপাশে কয়েক বছর ঘোরাফেরা করে আমার যেটুকু ধারণা সঞ্চিত হয়েছে তার জোরে বলতে পারি—বেশির ভাগ বাংলাদেশি মোহাজের মজুরের প্রাণেও মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির কূপমণ্ডূক মনই সক্রিয়—অনেকেই কালো, ‘ইস্পানিশ’ ও পূর্বেশীয় জনগোষ্ঠীর লোকজন সম্বন্ধে জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য করতে কসুর করেন না, মহান ‘শাদা’ জনগোষ্ঠী বা ‘মেইনস্ট্রীমে’ মিশে যাবার তাকিদে অনেকে লস এঞ্জেলেস দাঙ্গার অভিনব ব্যাখ্যা লেখেন।

আলেয়ার মন এসব ব্যাধি থেকে শুধু আশ্চর্যরকম মুক্তই নয়, তিনি সরাসরি আত্মীয়তা স্থাপন করেন কালো মানুষের প্রতীক মার্কিন লুথার কিং জুনিয়রের সাথে, কখনো ভাই কখনো পিতা কখনো বন্ধুর সম্পর্ক পাতেন জননায়ক লুথারের সাথে। নিখাদ শ্রমিক আন্তর্জাতিকতা আলেয়ার মনে জায়গা করে নিয়েছে। আমার মতে, এটাই আলেয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার মজদুর মাত্রেই ভাইবোন। এই উপলব্ধিই পড়ে পাওয়া দৈববাণী—নিগূঢ়তম সত্য তাঁর অভিজ্ঞতার।

মার্কিন মুলুকে কালো সম্প্রদায় ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির দুর্দশা, অহিতাবস্থা, শ্রমিক শ্রেণীর প্রাণধারণের লড়াই আলেয়া চৌধুরী দেখেছেন এবং নিজেকে তাদের সমতলে স্থাপিত দেখতে পেরেছেন। মধ্যবিত্তের ঠুলি পরা আর আর দশ বাঙ্গালি মজুর যে কথা লজ্জার বলে গোপন করতে প্রাণপণ, আলেয়া নিঃসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। আলেয়া কাজের কবি, কথার ব্যবসাদার মাত্র নন। তিনি অল্প কথায় চট করে বলে দেন কত ধানে কত চাল। ফোরাতের তীরে এখন মার্কিন সৈন্যরা বিজয় পতাকা ওড়াচ্ছে। আর তিনি কি করছেন?

 

তোমার দেশে—

মার্টিন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি

ভাতের খোঁজে—

জ্ঞানের খোঁজে—

ভালোবাসার খোঁজে—

দেখি কি ভয় এখানে?

 

আমেরিকার বাংলাদেশী মজুরগণের চিত্রও চমৎকার আঁকা হয়েছে তাঁর কবিতার পটে :

পায়ের তলার বরফ, রাতে অন্ধকারে গলায় ছুরি—

কালো-সাদা-ইস্পানিশ মাড়িয়ে কৃষি কাজ

গ্যাস-ইস্টিশনে ঝড় বৃষ্টি তুষার রোদ মাথায় করে—

ঝরেছে—যুবক সিঁথির মধ্যে মাথা চুল, শর্ষের তেল যা দিতে

ভুলতেন না দিনে একবার—চুল পড়ে যাচ্ছে

সে শরীর ভেঙ্গেছে, ঠোঁট থেকে দাঁত—উঁকি মারে হাসার আগে

এসব দুর্দশার হতাশার রোজ সকাল চল্লিশ বছরের

পিছে ফেলে আসা জীবন টাক মাথায় গালে হাত—...

 

কবিত্বের একটাই দোষ আলেয়া লাভ করেছেন, সম্ভবত গতের অনুগতিক ধারা থেকেই। যেখানে নিজের উপলব্ধি ও অস্মিতা থেকে যাচাই না করে তিনিও নিছক চলতি কথার কাব্য রূপান্তর করেছেন সেখানেই একটু আধটু দুর্বল হয়েছে তাঁর লেখা। ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ নামের মধ্যেও যে বোধ ভেসে বেড়াচ্ছে, বিদেশি শব্দে যাকে বলি ‘নস্টালজিয়া’—ইনি তাতেও বেশ সয়লাব।

বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা থেকে আলেয়া বেশ দূরে সরে এসেছেন—তাই বেশির ভাগ প্রবাসী মজুর-মধ্যবিত্তের মত তিনিও ঘূর্ণিঝড়ে নিহত দেশবাসীর জন্যে শোকে কাতর, দেশহিতান্তপ্রাণ। রাজনীতির ধূর্ততা, কৌটিল্যকৌশল যে তাঁর খুব আয়ত্তে নেই সে কথা আপসে-আপ বোঝা যায়। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন একটি দেশের, ‘একটি ভালোবাসা ও শ্রমের রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার। শিউরে উঠি যখন ভাবি আলেয়া চৌধুরী বড় হয়েছেন আলী কেনানের উত্থান-পতনের যুগে! শেখ মুজিবের জমানার সমাজতন্ত্র তাঁর মগজে মনে হচ্ছে আজও গেথেই আছে। এই বাষ্পটুকুর কথা বাদ দিলে ‘ভালোবাসা ও শ্রমের রাজতন্ত্র’ অনেক শতাব্দীর মনীষার স্বপ্ন বৈকি! আলেয়ার কাব্য সেখানে কোন বীজ বপন করেছে আমার জানা হয় নাই, তবে ফসল এসব ক্ষেত্রে বড় একটা ফলেনি।

ফের অভিজ্ঞতার গল্পে ফেরা যাক। শামসুর রাহমানের মন্তব্য এক অর্থে যথার্থই। আলেয়ার হাতযশ তাঁর মৌলিকতায়, পরানুকরণে নয়। তিনি লিখেছেন দশ মোহাজের মজুরের নিত্য অভিজ্ঞতার কথা:

 

সপ্তাহে একাশি ঘণ্টা

কাজ করে করে

আমার শরীর পায়ের জানু

ব্যথা টনটন।

 

ডাক্তারের পয়সা নেই

সবুজ কার্ড নেই—

যা ঘুরালে আসমানের তারার মধ্যে

একবার যেতে পারতাম—

তাও নেই আমার!

 

দশের অভিজ্ঞতায় বেদনা ও আপন জীবনের ব্যথার অভেদ কল্পনা করে আলেয়া চৌধুরী সোজাসুজি লিখেছেন:

 

শরীরে নেই চমক—

চার ফুট এগার ইঞ্চি

মানুষ আমি

শরীরের ওজন বেড়ে বেড়ে

বয়সের ভার ধরেছে

ঈশ্বরের দেওয়া কুৎসিৎ শরীর নিয়ে...

 

এই মহা নারীসাড়ার দিনেও খুব কম নারীই নিজের শরীরকে ‘কুৎসিৎ’ বলবেন। আলেয়া যা বলেছেন তাকে কোন অবিমৃষ্যকারী মর্ষকামীর স্বগতোক্তি মনে হয় না আমার—মনে হয়, বিষয়ী লোক বিষয়কে যেভাবে দেখেন তাঁর দেহদর্শনে তারই প্রতিফলন হয়েছে। মানুষের দেহটি তো বাগান মাত্র নয় যে তাতে কেবল ফুলই ফুটে থাকবে! প্রাণহীন দেহটি যখন শুয়ে থাকে তখন প্রাণটা কোথায় যায়?

আলেয়ার কবিতা আমার ভাল লেগেছে সৎ কবিতা বলে। এইগুলি হয়ত বর্তমান জগতের শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়, কিন্তু তাতে এদের মর্যাদার একটুকুও কমতি হয় না। বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত কবিদেরও বড়াই আছে, আছে শিল্পের বড়াই, আধুনিকতার বড়াই। আলেয়ার কবিতা তাঁদের কত ভাল লাগবে জানি না।

এয়ুরোপের চাঁদের আলেয়ায় যাঁদের মনোভুবন রোশনাই হয়ে আছে, তাঁরা নিজ নিজ জীবনের ক্ষতস্থানগুলোকেও লজ্জাস্থানের মতই পরম যত্নে ঢেকে আছেন। নইলে হয়ত তাঁরাও দেখতে পেতেন এ জীবন যেমন অজস্র শিল্পও তেমনি অপার। অবশ্য শ্রেণীভেদে শিল্পেরও ভেদাভেদ হয়। যদি তাঁরা মনে রাখতেন আত্মপ্রকাশের অধিকারই শ্রেষ্ঠ শিল্প তবে তাঁরাও অন্যান্য শ্রেণীর, অন্য মানুষের শিল্পকে ভালো বুঝতে পারতেন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের কবিপ্রতিভার জ্যোতিতে যাঁরা চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন তাঁদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। আমার ধারণা, আমাদের আলেয়া চৌধুরী অন্তত জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের চেয়ে বেহতর কবিতা লেখেন।

 

[১৯৯২/২০১৭]

 

দোহাই

১.       আলেয়া চৌধুরী, হৃদয়ে বাংলাদেশ (ঢাকা : ঢাকা প্রকাশন, ১৯৯২)।  

--------------

প্রথম প্রকাশ : শঙ্খচিল, আবু সাঈদ শাহীন সম্পাদিত, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৯৯, আগস্ট ১৯৯২, (পরিমার্জন : এপ্রিল ২০১৭)।