গল্প পড়ার গল্প
প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়ে গল্প লিখতে শেখা
তিনি ১০০ বছর পার করেছেন অনেকদিন। আমাকে সেই ৩৭-৩৮ বছর আগে এক অগ্রজ বলেছিলেন গল্প লিখতে চাও, প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়। আমি গল্প যদি কিছু লিখতে শিখি, তা রবীন্দ্রনাথ, আন্তন চেখভ, প্রেমেন্দ্র মিত্রকে পড়ে কিছুটা শিখেছি। আসলে গল্প বলার ওপরই তো গল্পের ভবিষ্যৎ। প্রেমেন্দ্র পড়ে গল্প লেখা শেখা যায়। গল্পের আঙ্গিক, কীভাবে বলতে হবে গল্প। মনে করুন ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটির কথা। আপনি আমি পাঠক। আপনাকে গল্প কথক—লেখক নিয়ে যাচ্ছেন সেই বনবাদাড়, মজা পুকুর আর পুরনো এক ভেঙে পড়া দালান নিবাসিনী এক বৃদ্ধা আর এক ইটচাপা ঘাসের মতো হয়ে যাওয়া যুবতির কাছে। আপনিই হয়ে যাচ্ছেন গল্পের মূল চরিত্র। তারপর এক ঘটনা ঘটেছিল। সামান্য।
সেই যে অনূঢ়া কন্যাটি, তাকে বিবাহের কথা দিতে হয় মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধাকে। তাঁকে কথা দিয়ে আর আসেনি নিকটাত্মীয় একজন। আপনি সেই নিকটাত্মীয়র ভূমিকা ধারণ করেন। পরের দিন ফিরে আসেন। তেলেনাপোতা থেকে ফিরে আপনার হয় ম্যালেরিয়া। সব যেন কুয়াশায় আবছা হয়ে যায়। দিয়ে আসা কথা ভুলে যাওয়ারই কথা। আপনি ভুলেই যাবেন। প্রেমেন্দ্রর লেখায় কল্পনা ছিল। কল্পনার আর এক গল্প ‘হয়তো’। ঘোর বর্ষার রাতে সেতুর মুখে এসেছে যে অবগুণ্ঠনবতী, তার অতীত হয় তো এমন হতে পারে । একটি মেয়ের গল্প শুরু হয়। সে ঝড়ের রাতে সেতু পার হয়ে যাচ্ছে, অথবা নিজেকে শেষ করতে এসেছে। এমন গল্প আমাদের সাহিত্যে বিরল। মনে পড়ে যায় শুধু কেরানি গল্পের কথা। সেই যে তারা দুটিতে ঘর বেঁধেছিল পাখির মতো। সামান্য কেরানি আর তার নতুন বউ। তাদের সংসার করা। তাদের ভালোবাসা।আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হওয়া। একদিন ঝড় এসে তাদের পাখির বাসা যেন ভাঙল। কী আধুনিক আর কী মায়াময় গল্প লিখতেন তিনি। তাঁর কাছে একবারই গিয়েছিলাম ১৯৭৮ নাগাদ। মনে পড়ে সেই সহাস্য মুখ। অনেক কথা শুনেছিলাম গল্প লেখা নিয়ে। ঘনাদার গল্প, মেজকত্তার গল্প, শুধু কেরানি, তেলেনাপোতা আবিষ্কার, হয়তো, পোনাঘাট পেরিয়ে, সংসার সীমান্তে, বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে, সাগর সঙ্গমে, স্টোভ এসব গল্প নিয়ে গল্প। কত বিচিত্র সুন্দর গল্প পড়েছি তাঁর।
‘স্টোভ’ গল্পটির কথা বলি। পাম্প দেওয়া এক ভাঙা স্টোভ জ্বেলে বসে আছে বাসন্তী। তার স্বামীর কাছে এসেছে মল্লিকা রায়। তার জন্য চা বসাচ্ছে বাসন্তী। বিয়ের হয়েছে পাঁচ বছর। ফুল শয্যার রাতে ঘরে ঢোকার আগে মল্লিকার নাম বলে দিয়েছিল কূটনি মেয়েরা। মল্লিকার কাছ থেকে স্বামী শশীভূষণের মন সরিয়ে এনে আঁচলে তাকে বাঁধার কথা বলেছিল। সেই থেকে মল্লিকা নামটি এক পুরোনো ক্ষতের মতো লেগে আছে তার মনে। শশীভূষণের প্রেম ছিল, কিন্তু ভীরু শশীভূষণ সাহসী হয়ে মল্লিকার কথাটি তার মাকে বলতে পারেনি। তাই জাদুঘরে প্রাচীন শিলা আর উল্কাপিণ্ডের ভিতরে প্রেম গিয়েছিল ফুরিয়ে। পরে মল্লিকার মনে হয়েছিল, সে কেন অনায়াসে মেনে নিয়েছিল তার ভবিতব্য। সে শশীভূষণকে বলতেই পারত, মাকে বলতে পারে নি শশী, কিন্তু মল্লিকাকে কি শশীভূষণের মায়ের অনুগ্রহ ভিক্ষার ওপর বাঁচতে হবে ? মল্লিকার মনে হচ্ছে, ওই ভিজে সলতেয় সারাজীবন ধরে আগুন ধরিয়ে রাখার ব্রত ক্রমশ কি দুর্বহ হয়ে উঠত না?
বাসন্তী সেই ভাঙা স্টোভে পাম্প দিচ্ছে যখন, মল্লিকা এসে দাঁড়ায় দরজায়। তার পাশে এসে বসে। জ্বলে ওঠা স্টোভে জলের কেতলি চাপিয়ে বাসন্তী রান্না ঘরে গেল। স্বামী আর মল্লিকা গল্প করুক। স্টোভটা গর্জন করছে একটানা। সাইলেন্সার খারাপ। মল্লিকা মাথা নামিয়ে বসে আছে, অস্ফূট স্বরে বলে, এভাবে এসে বোধ হয় ভালো করেনি সে। স্টোভের কর্কশ শব্দে তার কথা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে গলা তুলেই বুঝি বলতে হয়। বলতে হয়, কেন যে এত দিন বাদে এ খেয়াল হলো তার, এই লাইনে কতবার নেমেছে, অপেক্ষা করেছে সে গাড়ি বদলের জন্য, চার পাঁচ ঘণ্টাও অপেক্ষা করেছে, তখনো জানত এখানেই আছে শশীভূষণ, কিন্তু আসেনি। ফিরে এল মল্লিকা। স্টোভটির আঁচ আচমকা নেমে যেতে পাম্প দিতে শুরু করে আবার। শশীভূষণ ভয় পায়। শঙ্কিত হয়ে বলে, স্টোভ ফেটে যেতে পারে। মল্লিকা বলে, ‘তাহলে ভয়ানক এক কেলেঙ্কারি হয়, না?’
ভাঙা স্টোভটি বিপজ্জনক। ব্যবহার হয় না। আজ অতিথি সৎকারের জন্য সেই স্টোভই কি না জ্বালিয়েছে বাসন্তী। ভীত শশীভূষণ বলে ওঠে, ‘ও কী, হচ্ছে কী? পাম্প দিও না, বিপদ হতে পারে।’ স্টোভটিকে ঘিরে দুই রমণীর মনের ভিতরে জ্বলে উঠেছে যেন তুষের আগুন। শশীভূষণের গলার আওয়াজে বাসন্তী ফিরে আসে রান্না ঘর থেকে। সে এসে মল্লিকার পাশে বসে। মল্লিকার জিজ্ঞাসার উত্তরে বলে, স্টোভ খারাপ হতে যাবে কেন, একটু পুরোনো হলেই কি অচল হয়ে যায়? তা শুনে মল্লিকা আবার পাম্প দিতে থাকে স্টোভে। কেতলির তলা থেকে নীল আগুনের শিখা হিংস্র গর্জন করে চার ধারে যেন ফণা তোলে। বাসন্তী তাকে বলে, থাক, ‘আপনি ওঘরে গিয়ে বসুন আমি চা নিয়ে যাচ্ছি।’
স্টোভ কর্কশ আওয়াজ করে জ্বলতে থাকে। তার সামনে বাসন্তী। স্টোভে কেতলির ফুটন্ত জল উথলে পড়ায় বাসন্তীর খেয়াল হয়েছিল। চাবি ঘুরিয়ে নেভাতে গিয়ে তার মনে পড়ে যায় মল্লিকাকে নিয়ে মনের ভিতরে জমে থাকা বিষের কথা। এই পাঁচ বছর সে ভিতরে পুড়ে পুড়ে খাঁক হয়েছে। মল্লিকাকে মনে মনে সে কল্পনা করেছে কত রকমে। সেই কল্পনার সঙ্গে এই বাস্তবের তফাৎ অনেক। মল্লিকার সেই রূপ নেই যা দিয়ে সে পুরুষের মনে অনির্বাণ আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারে। স্বামীর মুখে সে একবারও মল্লিকার নাম শোনেনি। এই আপাত নির্বিকার নীরবতা তাকে আহত করেছে। কতদিন বিছানায় চুপ করে শুয়ে থেকেছে লোকটা। তার ভিতর জ্বলেছে, স্বামী নিশ্চয় সেই মল্লিকার কথা ভাবছে।
এই গল্পে দুই নারী জ্বলতে থাকে, ফুঁসতে থাকে শশীভূষণকে ঘিরে। বাসন্তীর সময়ে সময়ে মনে হয়েছে স্টোভ ফাটিয়ে সে মরে। প্রাণপণে পাম্প দিয়েছে, কিন্তু মরেনি। ধীরে ধীরে সেই বাসনা গিয়েছিল, মনে হয়েছিল লোকটি অসহায়, তার উপর একান্ত নির্ভর। মল্লিকা এসেছে তার বাড়ি, তার পরিপূর্ণ সংসারের দিনে। মল্লিকাকে দেখার পর তার ভয় গেছে। বাসন্তী নানা কথা ভাবতে ভাবতে ভুলেই গিয়েছিল যে স্টোভ জ্বলছে। এই মুহূর্তে কি স্টোভ ফেটে যেতে পারে ? তাহলে কী ভুল ধারণাই না করবে মল্লিকা? ভাববে বহুদিনের নিরুদ্ধ বেদনাই ওই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ! তা হতে দেবে না সে। সে হবে মল্লিকার মিথ্যে গৌরব। বাসন্তী চাবি ঘুরিয়ে স্টোভ নেভাতে গিয়ে দ্যাখে চাবি ঘুরছে না। চাবিটা এঁটে গেল কী করে ? মল্লিকাই কি এমনটি করে দিল…? কিন্তু আজ কোনো দুর্ঘটনা হতে দেওয়া যায় না। তাহলে সে হেরে যাবে। পাঠক আপনার জন্য গল্পটি থাকল। এক ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছে লেখক গল্প থেকে কলম তুলে নিয়েছেন সুধী পাঠকের জন্য।