সত্যজিৎ রায় ও কলকাতা

Looks like you've blocked notifications!

ভূমিকা

উপমহাদেশের কোনো পরিচালককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার প্রিয় তিনজন পরিচালকের নাম বলুন। তাহলে নিঃসন্দেহে সেই তিনজনের মধ্যে শীর্ষে থাকবেন সত্যজিৎ রায়। তৎকালীন নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তিনি যেভাবে ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপুর সংসার’-এর মতো ছবি নির্মাণ করেছেন, তা বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয়। আজ এই গুণী নির্মাতার ২৫তম প্রয়াণ দিবস। লস অ্যাঞ্জেলেস পত্রিকায় ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে পিটার রেইনার একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেটারই অনুবাদ এখানে দেওয়া হলো।

আমি একবার মাউন্টেন ভ্যালি ঘুরতে গিয়েছিলাম, নিজেকে তখন জন ফোর্ডের ওয়েস্টার্ন সিনেমার চরিত্রে কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা সফল হয়নি। এরপর আমি ‘ভার্টিগো’ ট্যুরে সানফ্রান্সিসকো যাই; কিন্তু সেখানেও কিছু বোধ করিনি। আসলে আপনি যা-ই করেন না কেন, সিনেমার মাধ্যমে আপনি যতই কোনো নির্দিষ্ট জায়গা বা সময়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, সব চলচ্চিত্রই আসলে কল্পনার ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়। বিশেষভাবে বিখ্যাত ছবিগুলোর ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি দেখা যায়। যদি চলচ্চিত্র দেখে আমরা প্রকৃত স্থানে যাই, তাহলে আমাদের হতাশ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সে সময়ের কোনো আত্মা নই, আমরা নিছক ভ্রমণকারী মাত্র।

এই চিন্তা-ধারণা আমার মনে গেঁথে ছিল, পাঁচ বছর আগে আমি যখন কলকাতায় রাজ্য বিভাগের আয়োজনে রাষ্ট্রদূতদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাই তখনো। সেখানে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টিগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। আলোচনার একপর্যায়ে আমার কি মনে হয়েছিল, আমি সত্যজিৎ রায়ের বিশাল মহাকাব্যের কোন চরিত্র? তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতি আমার কতটুকু ভালোবাসা, ভারতের প্রতি ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে?

আমি রাতে দেরি করে বাসায় ফিরি এবং টিভিতে সিএনএন খুলে শুনতে পাই যে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। ভোরে আমি দেখতে পাই, রাস্তায় হিন্দি ঢঙে সবাই বারাক ওবামার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আনন্দ উদযাপন করছে। ১৩ মিলিয়ন জনগণের সঙ্গে এটিই আমার পরিচয়ের শুরু। যাঁদের কাছে আছে এমন এক শহর, যাকে সমানভাবে ডাকা হয় ‘সিটি অব ড্রেডফুল নাইট’ এবং ‘সিটি অব জয়’ হিসেবে।

জো লিন্ডনার, যিনি ‘মোশন পিকচার একাডেমি’র জন্য পদ্ধতিগতভাবে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলো পুনরুদ্ধার করছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমি অধ্যাপক হিসেবে তখন কলকাতায় দুই সপ্তাহের জন্য ছিলাম। পাশাপাশি আমি বিভিন্ন স্থানীয় কলেজের বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব দেখছিলাম। সেটা আমার ভারতে প্রথম আগমন ছিল। সেই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিনিময়। তাই আমি বেশ কিছু হলিউড সিনেমা প্রদর্শন করছিলাম, যেগুলো কথা সত্যজিৎ রায়ের লেখায় এসেছে বা কোনোভাবে তাঁকে প্রভাবিত করেছে।

‘আ নাইট অ্যাট দি অপেরা’ কি আপনি বিশ্বাস করেন? এই ছবি দেখার সমস্ত অভিজ্ঞতা ফিরে আসছিল, যখন সান্টা মনিকার আইরো থিয়েটারে ২১ অক্টোবর রাতে একাডেমির উদ্ধার করা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের একটি চমৎকার সিরিজ দেখার সৌভাগ্য হয়। সত্যজিৎ রায়, যিনি কলকাতায় জন্মেছেন ও মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কলকাতার সবচেয়ে সম্মানিত সন্তান। আমার কাছে তিনি শ্রেষ্ঠ, আর চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁকে ছাড়া চিন্তাই করতে পারবেন না।

তাঁর কাজের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো তিনি জীবনের চারপাশের উপাদান নিয়ে কাজ করেছেন। আর কেউ তাঁর মতো করে নারীদের জীবন, শিশুদের জীবন, মানুষের কর্মজীবনকে সাধারণ গাম্ভীর্য কোমলভাবে ফ্রেমে বন্দি করতে পারবে না। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিলাসী নির্মাতা এবং এখন পর্যন্ত তিনিই মানুষের জীবনধর্মী কৌতুকগুলোকে শব্দায়মান উপলব্ধি দিতে পেরেছেন। তিনি একজন মানবতাবাদীর চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন : তাঁর চলচ্চিত্র এমন এক উপলব্ধি থেকে নির্মিত, যেখানে মানুষ পরিশুদ্ধ এক বিষয়।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে দুটি সৃষ্টিকর্ম সব সময় এগিয়ে থাকবে : ‘অপু ত্রয়ী’, যা ৬ অক্টোবর প্রদর্শিত হয়েছিল এবং তিন খণ্ডের ‘থ্রি ডটার্স’, যা ১০ অক্টোবর প্রদর্শিত হয়েছিল। যার মধ্যে প্রথম ছিল ‘দ্য পোস্টমাস্টার’। এই সৃষ্টির সৌন্দর্যের সঙ্গে শুধু চ্যাপলিনেরই তুলনা চলে। চ্যাপলিন ছিলেন রায়ের আদর্শ।

রায় কলকাতাকে বলতেন ‘এই অদ্ভুত, পরিপূর্ণ, বিস্ময়ের শহর’ এবং আমি অতিদ্রুত বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা একধরনের বোকামি হবে যদি আমি তাঁর চোখে, তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কলকাতা শহরকে দেখতে চাই। যে কলকাতা ৪০৫ ফ্রিওয়েকে ব্যস্ত সময়ে বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে পরিণত করে, তা সত্যজিৎ রায়ের অভিভূতকারী কলকাতা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। পশ্চিমা দেশের মানুষ হিসেবে কলকাতায় আমার শুধু ভিক্ষুকদেরই নজরে পড়বে। সঙ্গে থাকবে তাদের চোখ-মুখের মিনতি এবং অভিযোগ।

একজন অল্পবয়স্ক মা, যাকে দেখে একবার আপনার ১৮ ও ৮০ দুটোই সঠিক বলে মনে হবে না, আমাকে অনুসরণ করতে করতে আমি যে ব্লকে থাকি, সে ব্লকে চলে এলো যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তার শিশুর দিকে তাকিয়ে কিছু দান করছি। আমার ‘মাদার তেরেসা’ ধর্মশালায় ঢোকার সুযোগ হয়েছে, সেখানে আমি দেখেছি আধো অন্ধকারে গাদাগাদি করে তাঁরা শুয়ে আছেন। আমি চিতায় মরা পোড়ান দেখেছি। হাতের আঙুল এবং পায়ের আঙুল বের হয়ে থাকে। পোড়ানোর পর ছাইগুলো রীতি অনুযায়ী হুগলি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

কলকাতায় আধুনিক ধরনের রেস্তোরাঁ রয়েছে, যার নাম ‘ওহ কলকাতা!’ তার পাশেই রয়েছে অক্সফোর্ড নামের একটি বইয়ের দোকান। যা পার্ক স্ট্রিটের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। সেখানে থেকে আমি সত্যজিৎ রায়ের মোটা ভলিউমের গোয়েন্দা উপন্যাস এবং শিশুদের গল্পের বই (এর মধ্যে আবার কিছু কিছু অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল), এবং মিউজিক ওয়ার্ল্ড যেখানে মজুদ ছিল রায়ের দুষ্প্রাপ্য ডিভিডি এবং রাগপ্রধান সিডি। আমি বাড়তি একটা স্যুটকেস ভর্তি করে আমার কেনাকাটা থামালাম।

কলকাতায় দৃষ্টি দিলে আপনি সম্পদ এবং দারিদ্র্যের সহাবস্থান দেখতে পাবেন। নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনে তরুণ সত্যজিৎ রায় পড়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সত্যজিৎ এক কালজয়ী তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষালয় সত্যজিতের কাছে মন্দিরের মতো ছিল। কিন্তু এর পেছনের জানালা যদি খোলেন, তাহলে দেখবেন বিশাল ময়লা ফেলার জায়গা। রয়েল কলকাতা টার্ফ ক্লাবের পাশে রিকশা চালকরা বসে আছে, যাতে করে নাগরিকরা তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজকীয় সুবিধা উপভোগ করতে পারে।

আমি সব সময় আমার পশ্চিমা পদমর্যাদা এবং উপনিবেশ-উত্তর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে সংবেদনশীল ছিলাম। তবে আমি যখন স্থানীয়দের সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম, তখন আর ওই আবেগ কাজ করেনি। তবে আমি কল্পনা করেছি যে তারা ভাবছে, ‘কে এই বেয়াদব সাহেব?’

বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। যেখানেই আমি গিয়েছি, আমাকে মর্যাদাপূর্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। অধ্যাপকরা আমাকে সেই সকল বই এবং ভারতীয় সিনেমা জোগাড় করে দিয়েছেন, যা আমার পক্ষে খুঁজে বের করা কঠিন ছিল। যখনই আমি ক্লাসে প্রবেশ করেছি এবং আমার ছাত্রদের নজরে পড়েছি, তারা আমাকে সম্মান দিয়েছে। নিজেকে আমার তখন অ্যাডমিরাল মনে হতো।

কিন্তু সেখানেও আমি ধাক্কা খেয়েছি এই দেখে—খুব কম মানুষই আমার সঙ্গে সত্যজিৎ নিয়ে কথা বলেছেন বা তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্ক খোঁজখবর রাখতেন। স্পন্দিত বর্তমানের চেয়ে বরং তিনি তরুণদের কাছে ছিলেন এক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মাত্র। তরুণরা যেটা খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানে, সেটা হলো বলিউড দুনিয়া।