সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
১৩৩০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে যে জুলেখায় হারানী গেছিলো, তারে শেষমেশ ফিরা পাওয়া যায়!
কবে ফিরা পাওয়া গেলো তারে? না, ঠিক পাঁচ বছর পরে!
তার সন্ধান পাওয়া গেলো ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের পইল্লা দিনে।
সেই যে সক্কাল বেলা, ঠাকুরবাড়িতে কাউয়াপক্ষীগো ভোগ দিয়া ফিরত আওয়ার সময়, জুলেখার মায়ের তার বাম চক্ষের তেছরা নজর দিয়া আলগোচ্ছে দেখছিলো—ঘাটলায় বওয়া দিয়া আছে এক মাতারি!
সেইটা কে আছিলো?
সেইটাই জুলেখায়!
কেমনে জুলেখার মায়ে এতো বচ্ছর বাদে ঠিকঠাক রকমে চিনলো নিজের ঝিয়েরে! কেমনে চিনলো! সেইটা এক মস্ত বিত্তান্ত!
জুলেখার মায় তো দেখলো, ভাঙ্গা ঘাটলায় আউলা রকমে বসা-দেওয়া আছে কোন এক মাতারি। কেটায় এইটা? কোনো আগলা-পাগলা ফকিরনী?
দেওভোগ গেরাম এমুনই নিরালা, এমুনই দুনিয়াছাড়া এক জায়গা—সেইনে কোনো কারণেই কোনোদিন কোনো পাগলে আইসা হাজির হয় নাই। সেই গেরামে কোনো ফকির-মিসকিনে পর্যন্ত পারতে পাও দেয় না। এইনে ফকির নাইলে বষ্টুমেরা ভিক্ষা করতে আসে ছয় মাসে একবার।
রাস্তা নাই, পথঘাট বলতে নাই, চলা-চলতির কোনো প্রকার সুবিধা নাই। গেরামের নানাদিগের নানান জাতের ঢাল বাইয়া, বারো-চৌদ্দ ঘর গিরস্থের দরজায় খাড়া হইয়া, ভিক্ষা যা পাওয়া যায়; তার তেনে দ্বিগুণ বেশি কাহিল হইয়া যায় ফকিরগো হাত-পাও!
লাভের তেনে তাগো হইয়া যায় লোকসান বেশি। সেই কারণে এই গেরামে গেরামে আনা-যানাটা ফকিরগো কোনোমতেই পোষায় না। আর, অই মাতারিরে মিসকিন বইল্লা কোন কারণে মানবো জুলেখার মায়! কোনো ফকির-মিসকিনেই তো এমনে একলা অই ঘাটলায় আইসা বওয়া দিয়া থাকোনের বান্দা না!
আবার তারা কোনো সোমই একলা আসে না। বেটা কি মাতারি যেই ফকিরই হউক, আসে দুই-তিনজোনে একলগে। সব ঘর তেনে ভিক্ষা লয় একলগে, ফিরত যায়ও গা একলগে।
তাইলে অইটা কে? জুলেখার মায়ের পরান ধক্ক কইরা ওঠে। সেয় কি চক্ষে ভুল দেখে, নাকি কোনো অশৈলী বিত্তান্ত এইটা! ঠাকুরবাড়ির অশৈলী বেপার নিয়া কথা তো কম শোনা যায় না!
দেখো বিষয়খান! কী জ্বালার জ্বালায় পড়লো জুলেখার মায়ে! সেয় সোন্দর মতোন ভোগ দিয়া ফিরতি যাইতাছে। তার অখন পিছে ঘুরানি দেওন যেমুন মানা, তেমুন পিছের দিগে ঘাড় ফিরানিও পুরা নিষেধ। তাইলে অই যে কারে জানি ভাঙ্গা সিঁড়িতে দেখা যায়, সেইটার মীমাংসাটা সেয় করে কী প্রকারে!
তার একমোনে কয়, যা খুশি তা থাকুক গা—কিছুই তার দেখোনের কাম নাই! অদিগে তার আরেক মোনে হায় হায় কইরা ওঠে! কয় যে, বিষয়টা সেয় ফায়সালা না কইরা এক পাওও বাড়াইবো না!
কী আছে দুনিয়ায়! কী আছে এই জিন্দিগিতে! অখন সেয় জ্যাতা থাকলেই কী আর গেলেগাই বা কী! দুনিয়ার লগে তার আর কোনো মায়ার গিট্টু আছেনি? কিচ্ছু নাই। কেউই নাই।
এই ভাবনা যেই মোনে আহে, অমনেই জুলেখার মায়ের মোন শক্ত হইয়া ওঠে। না না! সেয় তো এমনে এমনে বিষয়টা ফালাইয়া থুইয়া যাইবো গা না! কিছুতেই যাইবো না! ঘটনাটা বিশদ দেইক্ষা, তয়, যুদি সেয় বাড়ির পোথ ধরে!
অই ত্তো দেখা যায়—তার আগে আগে মংলার মায় গেছে গা অনেকখানি পোথ। তারে নিয়া তো আর চিন্তা নাই জুলেখার মায়ের। সুভালাভালি বিপদ-বালাইয়ের রাস্তা পার হইয়া গেছে গা ভালামানুষটায়! অরে আর বিপদের রাস্তায় ডাইক্কা কাম নাই! যা করোনের একলা জুলেখার মায়ই করবো এখন।
ঘাড়-ঘুরানির নিয়ম ভাঙ্গবো সেয়। ভাঙ্গবো সিঁড়ির ঘটনাখানের ফায়সালা করোনের লেইগা। অখন নিয়ম ভাঙ্গনের কারোনে আপদ-বালাই যা আওনের আসুক! সেইটা আসুক কেবল জুলেখার মায়ের উপরে। মংলার মা আভাগীরে এইর তেনে দূরে রাখুক খোদায়!
এই মতে চিত্তি বাইন্ধা জুলেখার মায় করে কী, বাড়ির পোথ ফালাইয়া থুইয়া সেয় ঘুরান দিয়া হাঁটা শুরু করে ঠাকুরবাড়ির ভাঙ্গা ঘাটলার দিগে।
তবে নিয়ম ভাইঙ্গা সেয় ঘুরানি দিলেও, চোখ কিন্তু কোনো অবস্থাতেই উপরে তোলে না জুলেখার মায়। সেয় খেয়াল রাখে যে, কোনোমতেই য্যান তার চোখ অই বকুল বিরিক্ষির দিগে না যায়! ভোগ দেওনের পর আর ভোগ-স্থানের দিগে কোনো প্রকারেই দিষ্টি দিতে নাই!
ঠেকার কামে না হয় তারে ঘুরতে হইছে, কিন্তু নিজ দিষ্টিটারে তো সেয় সামলানি দিয়া রাখতে পারে! অই একটা বিধি অন্তত পালনি করুক সেয়—এই ঠেকার কালে!
মাটির দিগে দিষ্টি বিছাইয়া থুইয়া কতোখানি জায়গা পার হয় জুলেখার মায়। তার বাদে সেয় ঘাটলায় পাও দেয়। তার বাদে ধীরে ধীরে একটা একটা কইরা সিঁড়ি বাইতে বাইতে ঘাটলার একেবারে নামার দিগে গিয়া খাড়ায়। যা দেখছিলো সেয়, হাছাই দেখছিলো না মিছা!
ও খোদা! হাছাই তো কেটায় জানি বওয়া নামার দিগের একটা সিঁড়িতে! অই যে—একবারে পানি-লাগোয়া সিঁড়িখানে বইয়া রইছে এক মাতারি! ইয়া গাফুরুর রহিম! কেটায় এই মাতারি!
জুলেখার মায় আরো তিনটা সিঁড়ি আলগোচ্ছেই নামে। তয়, যতো আলগোচ্ছ পাওয়েই সেয় সিঁড়ি বাইয়া নামুক না কেন; তার হাঁটা-চলার তো কিছু হইলেও আওয়াজ হইতাছে! সেই আওয়াজ য্যান অই মাতারির কানেও যাইতাছে না!
সেয় বইয়া রইছে পানি-মুখী হইয়া, কিন্তু বওনের ভঙ্গিখান দেখো কেমুন জানি! দেওভোগ গেরামের কোনো মাতারি কি ছেড়ি এইমতে কোনোসোম বসে না।
ঘাটলায় লেট দিয়া বওয়া সেয়। কিন্তু তার মুখখান দেখোনের কোনো উপায় নাই। নিজের মুখেরে সেয় গুঁইজ্জা থুইছে তার দুই হাঁটুর মাঝখানে। মাথায় তার আঁচল তোলা।
মাতারির পিন্ধনের কাপোড়খানের অবস্থা দেখো! খোদা খোদা! এমুন পুরান, তেনাতেনা, ছিঁড়া কাপোড়—এই অঞ্চলের ফকিরনীরা সুদ্ধা পিন্ধে না! এই মাতারির এই হাল ক্যান! ছিঁড়া কাপোড়ের এই ফাঁক, সেই ছিদ্রি দিয়া দেখা যাইতাছে মাতারির ঘাড়-গর্দানের এট্টু-আট্টু, দেখা যাইতাছে মাথার চুল।
আরে বাপ্পুইস রে! দেখো মাতারির মাথার চুল! মাথা তার সামোনের দিগে ঝোঁকা। সেইখান তেনে মাথার চুল থোপ্পা খাইয়া নাইম্মা, পইড়া রইছে ঘাটলার পাকায়। মাতারির বাও হাত জুলেখার মাওয়ের নজরে আইতাছে না। কিন্তু ডাইন হাত—এইত্তো এইদিগে! মাতারির ডাইন হাতখান আছে ন্যাতা ন্যাতা কাপোড়খানের ছিঁড়া ন্যাড়ব্যাড়া আঞ্চলের বেড়ে। তয়, সেই বেড় দিয়া মাতারির ডাইন হাতের পুরাটা ঢাকা পড়ে নাই।
সেই হাতের দিগে চোখ যায় জুলেখার মায়ের। তগ-নগদ তার মোনে হইতে থাকে যে, অই হাতখানে তারে য্যান কী একটা জানানি দিতাছে! কী জানানি দেয়!
সেই হাতে য্যান জুলেখার মায়রে কইতে থাকে যে, যেয় এইনে বহা; সেয় মাতারি না! সেয় হইতাছে একটা জুয়ান ছেড়ি! এই হাত কোনো বুড়া মাতারির হাত না!
আর দেখো সেই ছিঁড়া তেনায় ঢাকা হাতখানের রূপের বাহার কী!
চৈত মাইস্যা বিয়ানের তাজা রইদে আইয়া ঝাপটাইয়া পড়তাছে সেই অচিন মাইয়ার ডাইন হাতের উপরে! আয় ছোবানাল্লা! কী রূপের রূপ অই হাতের! রঙের ঝলকটা কী তুক্ষার! চৈত মাইস্যা রইদে আর কী ঝালকা দেয়! মাইয়ার বন্নের ঝালকার কাছে য্যান অই রইদের বন্ন কিছু না! কিছু না!
যারে আল্লায় এই মাইয়া দিছে, তার আল্লার দরবারে ঢোক্কে ঢোক্কে শুক্কুর করোন লাগবো! না করলে নাদানি করা হইবো! নিজের মোনে মোনে এই কথা কয় জুলেখার মায়। আর, অই মাইয়ার মোখখান দেখোনের লেইগা তার মোনে বাসনা লাগতে থাকে।
কাগো বাড়ির জানি এই মাইয়ায়! কোন দুক্ষে না জানি সেয় আইয়া বইয়া রইছে এইনে! কেমনে আইয়া পড়ছে সেয় এই বান-বাতাসের থানে, এমুন পতিত বাড়িটাতে! না জানি কোন কষ্টে আছে মাইয়াটায়! পিন্ধনের ছিঁড়া বস্ত্রখানে তো কইতাছে; পেটের ভাতও নিত্যি জোটে না যেই সংসারে, সেইখানে বসত এই মাইয়ার! আহা! আল্লায় এরে শান্তি দেউক!
মাইয়াটায় যেইনে বহা, তার এক ধাপ উপরের সিঁড়িতে খাড়াইয়া খাড়াইয়া মোনে মোনে কতখোন অই অচিন মাইয়ারে দোয়া করে জুলেখার মায়। আল্লায় এর দিলে শান্তি দেউক!
সেয় অরে দোয়া করে, আর নিজে উশখুশ করতে থাকে খোনে খোনে।
মাইয়াটার মোখটা এমুন গোঁঞ্জা ক্যান! কেমুন কারবার! ছেড়িয়ে নি তার মোখখান এট্টু তোলে! একটা মানুষ যে হের ধারেকাছে আইয়া খাড়াইয়া রইছে, এই ছেড়ির সেই হুঁশ নি আছে! জুলেখার মায়ের হাঁটা-নড়ার আওয়াজ তো তার কানে যাওনের কথা!
তাইলে মাথা তোলে না ক্যান সেয়! মাথা তোলে না ক্যান!
এইমতে কতোক্ষণ খাড়াইয়া থাকোন যায়! আর, কতখোনই বা অই ছেড়ির মোখ তুলুন্তির লেইগা বার চাওন যায়! জুলেখার মায়ের বুড়া হাড্ডি না! তার হাঁটু-পাও দেখো কেমুন চাবাইতাছে!
আবার ভিতরে ভিতরে জুলেখার মায়ের এট্টু কেমুন বেচইনও লাগা ধরে। ছেড়ির লক্ষণটা কেমুন জানি লাগতে থাকে তার! এইটা কোন কিসিমের বওয়া দিয়া রইছে এই মাইয়ায়!
অই চিন্তা মাথায় আওনের পরে জুলেখার মায়ের আর চুপ কইরা খাড়াইয়া থাকোনের ইচ্ছা থাকে না। বিষয়টা খোলাসা করোন তো লাগে! তখন সেয় মাইয়াটারে ডাক দেয়, ‘কেটায় গো আপনে, এইনে এমনে বইয়া রইছেন? কিগো মা, আপনে কেটায়?’
জুলেখার মায় ডাকের উপরে ডাক দেয়, দিতেই থাকে। কিন্তু সেই হাঁটুতে মাথা-গোঁজা মাতারি যেমুন নিঃসাড় বওয়া দিয়া আছিলো; তেমুনই বওয়া দিয়া থাকে। এট্টু লড়েচড়েও না।
জুলেখার মায় তখন আবার ডাকে, ‘কেটায় গো আপনে, মা-সগল? কোন বাড়ির গো আপনে? এইনে বইয়া রইছেন ক্যান গো মা? কিগো, হুমুইর দেন না ক্যান?’
মাতারি এইবারও কোনো জব দেয় না। যেমুনকার লেট মাথা তেমুনই গোঁজা থাকে তার দুই হাঁটুর ভিতরে।
আচানক কারবার তো! জুলেখার মায় এইবার তরাসে এট্টু কাঁইপ্পা ওঠে। এইটা কেমুন কথা! এতো ডাক পাড়তাছে সেয়, অই মাতারি ডাকের কোনো জব তো দিতাছেই না! তার উপরে দেহো মাথাটা তরি তোলতাছে না! বেপার কী!
‘তাইলে কি সেয় অখন মাতারিরে একটা হালকা ঠেলা দিবো? দিয়া দেখবো একবার—মাতারি মাথা তোলে না ক্যান?’ জুলেখার মায়ের চিত্তে ভাবনাখান আসে ঠিক, কিন্তু ক্যান জানি সেয় সাহস পায় না! ক্যান জানি তার হাত লড়তে চায় না।
থাউক গা যেমুনকার আপদ—তেমুন পইড়া থাউক! জুলেখার মায়ের কী! কথাখান মোনে আসে জুরেখার মায়ের।
তক্ষণ তক্ষণই তার মোনে তারে ডাক দিয়া কইতে থাকে যে, আর এমনে খাড়া দিয়া থাকার দরকার নাই। তার উচিত এক্ষণ বাড়ির রাস্তা ধরোন!
তবে মংলার মায় কেমনে জানি তার মোনের কথা ধইরা ফালাইয়া তারে ঝটপট থামানি দেয়। ভোগ দিয়া মংলার মায়ে ঠিকই গেছিলো গা গেরামের একেবারে কাছে। পিছে যে জুলেখার মায়ে আইতাছে না—এই খেয়ালখানও সেয় বহুতখোন করতেও পারে নাই। শেষে গেরামের সীমানায় পাও খালি দিবো, এমুন সোম কি একখান কথা কইতে জানি সেয় ডাক দেয় জুলেখার মায়রে। অম্মা! কই পাইবো জুলেখার মায়রে! কে দেয় মংলার মায়ের ডাকের সাড়া!
মংলার মায় খেয়াল করে যে, সেয় ঠিকই আইসা পড়ছে ভোগ-স্থান তেনে। আইয়া পড়ছেও মেলা ফারাকে। অখন আর ঘাড় ফিরাইতে কি পিছে চাইতে বাধা নাই!
সেয় তখন জুলেখার মাওয়ের খোঁজে ঝটতি ঘাড় ঘুরানি দেয়। কই জুলেখার মায়ে! নাই তো সেয় তার পিছে!
সর্বনাশরে! না জানি কোন বিপাক নামছে বইনের উপরে! মংলার মায় ধুছুর-মুছুর লৌড় দিয়া আবার ছোটে ঠাকুরবাড়ির দিগে।
আপদের কালে আর নিয়ম রক্ষার উপায় কী! একটা মানুষের জানের তেনে নি বিধিনিয়ম বেশি বড়ো! জানের তেনে বড়ো কিছু না।
আর কপালে দুর্গতি থাকলে সেইটা করবো ভোগ মংলার মায়ে! কিন্তু জুলেখার মায়েরে একলা বিপদে পইড়া থাকতে দিবো না সেয়। কোনোমতেই দিবো না। সেয় আবার আইসা হাজির হয় ঠাকুরবাড়িতে।
তয় ঠাকুরবাড়িতে আইয়া সেয়ও তার চক্ষু মাটির দিগেই নামানি দিয়া থোয়। এট্টু মান্যি তো করোন লাগে বিধিনিয়ম রে! আর, নাইলে না-ই চাইলো সেয় উপরের দিগে! ভেজাল তো নাই কোনো তাতে!
কিন্তু আড়েআড়ে এইমুড়া-সেইমুড়ায় তাকানি দেওন লাগবো তো তারে! সেইটা সেয় দেয়। দিয়া জুলেখার মায়রে বাইর করতে তার মোটের ওপর সময় লাগে না।
দূর তেনে বিত্তান্ত বুইজ্জা সেয় আস্তে পাওয়ে জুলেখার মায়ের ধারেকাছের সিঁড়িতে আইয়া খাড়ায়।
খাড়াইয়া মংলার মায়ও বার চাইতে থাকে। দেখি তো—অচিন মাতারি কোন জব দেয়! এই বুঝি ঘাড় তোললো মাতারি! এই ত্তো বুঝি কথা কইলো!
কিন্তু দেখো কেমুন তামশা! মাতারি ডাকের জব তো দেয় না-ই; মাথাটা তরি তোলে না!
বিষয়টা ভালা ঠেকে না য্যান তার কাছে! এই ঘাটলায় না একদিন নিঃসাড় পইড়া আছিলো জমিদার-বৌয়ে! ঘটনাটা ঘটছিলো তো, নাকি?
বিষয়টা লইয়া তো তাইলে আর এমনে খাড়া দিয়া থাকোন ঠিক কাম হইবো না! জলদি এইটার মীমাংসা করোন লাগবো!
মংলার মায় তখন তরাতরি হাঁকাহুঁকি কইরা জুলেখার মায়রে কয়, ‘আহেন বুজি! আপনে আমি দোনোজোনে মিল্লা দফায় দফায় ডাক দেই! লাগতাছে য্যান—মাতারিয়ে অমনে বইয়াই ঘোমাইয়া গেছে! ঘোমাইয়া গেছে দেইক্ষাই কোনো কথা হের কানে যাইতাছে না!’
‘এই যে! কেটায় গো, মা! কথার জব দেন!’ মংলার মায় জোর ডাক দেয়।
‘কে গো আপনে সোনা? এইনে এমনে বহা দিয়া রইছেন কোন কারণে?’ জুলেখার মায় জিগায়।
‘কিগো মা লক্ষ্মী! মাথা তোলেন!’ মংলার মায় আবার ডাকে।
‘কই গো মাতারি! আমাগো কথা হোনতাছেন? আপনে এইনে এমনে বহা আছেন ক্যান গো?’ জুলেখার মায় আবার ডাকে।
তার এইবারের ডাক য্যান সেই হাঁটুতে মাথা গোঁজা মাতারির কানে যায়!
তারে এই পরথম কোনোরকমে, অতি আস্তে মাথা নড়াইতে দেখা যায়। মোখখান অতি ধীরে হাঁটুর তেনে তোলন দিয়া—অতি কষ্টে কোনো প্রকারে—য্যান সেয় তার ঘাড়টারে কাইত করে জুলেখার মা আর মংলার মায়ের দিগে।
‘এই ত্তো সোন্দর চাইছে!’ মংলার মায়ে কলবল কইরা ওঠে। ‘কেটায় গো আপনে?’
তবে এইবার আর জুলেখার মায় কিছু জিগায় না। ক্যান জানি তার শইল আপনার তেনেই ঝুঁইক্কা যাইতে থাকে অই অচিন মাতারির মোখের দিগে!
কিয়ের মাতারি! এইটা দেহি একটা জুয়ান মাইয়া!
কী ভরভরন্ত, ঝকমকাইন্না বাহারের তার মোখখান!
পয়পরিষ্কার, মাজ—ঝকপকা কাঁসার কলসির উপরে চৈত মাইস্যা রইদ আইয়া ঝাপটাইয়া পড়লে যেমুন ঝিলিক দেয়, মাইয়াটার মোখখান তেনে রূপ য্যান তেমুন ঝিলিক দিতাছে!
পিন্ধনে ছিঁড়া কাপোড় তার, কিন্তুক মোখের অই ঝলক য্যান কইতাছে—বড়ো সুখের ঘরের মাইয়া এইজোনে! অভাবী ঘরের না সেয়! অবস্থা দোষে তার গতরে ছিঁড়া বস্ত্র! কিন্তুক গরীবির কারণে তার বস্ত্র ছিঁড়া না!
জুলেখার মায় সেই অচিন মাইয়ারে ভালারকমে দেখবো কী, সেই মাইয়ায়ই তার দুই চোখ পাইত্তা দিয়া থোয় জুলেখার মাওয়ের দিগে।
নিপাটে জুলেখার মায়ের দিগে চাইয়া থাকে সেই মাইয়ায়। কিন্তু তার চক্ষে য্যান দুনিয়ার ঘুম। তার ঘোমে ঢুলুঢুল চক্ষের পাতা দুইটা য্যান কোনোমতে এট্টু খোলা দিয়া রাখতাছে সেয়।
আর চক্ষের দিষ্টি দিয়া সেয় জানি কী বোঝোনের, কী জানি চিনোনের—একটা তুফান চেষ্টা করতাছে লাগে!
কেটায় এই ছেড়ি! কী বোঝোনের চেষ্টা করে উয়ে! কী চিনতে চায় সেয়!
মোখটা কার মতোন! কার মতোন এই ছেড়ি! জুলেখার মায়ের অন্তরাত্মা ঝাঁকনি দিয়া ওঠে! জুলেখায় না? এইটা তার মাইয়ায় না?
মংলার মায়ের চক্ষেরাও য্যান সেই একই জোনেরে দেখে। দেইক্ষা তার শইল্লে কাঁটা দেয়। সেয় তখন মোনে মোনে বেধুম দোয়া পড়তে থাকে; লা ইলাহা ইল্লাল্লা! লা ইলাহা ইল্লাল্লা!
তাগো মোখে বাক্য ফোটোনের আগেই সেই ঘুম-ঢুলুঢুল চক্ষের মাইয়ায় জুলেখার মায়ের দিগে চাইয়া জবজবাইয়া কাইন্দা ওঠে। আর কয়, ‘মা! আমি আইছি!’
আয় ছোবানাল্লা! চৈত মাইস্যা আগুনের লাহান পলকে সংবাদখান দেওভোগ গেরামের সগলখানে ছড়াইয়া যায়।
কী চাও?
না, জুলেখারে পাওয়া গেছে!
কই পাওয়া গেছে দুঃক্ষিণী মায়ের মাইয়ারে?
না, ঠাকুরবাড়ির ভাঙ্গা ঘাটলায়!
(চলবে)