কুরোসাওয়া কথা

ক্যালিগ্রাফি

Looks like you've blocked notifications!

 

ভূমিকা

জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।

সারাদিনের হাঁটাহাঁটির এবং ঘৃণা করি— এমন এক শিক্ষকের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার ক্লান্তি নিয়ে বিকেলে পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সকাল বেলার রাস্তাটিকে সেটির প্রকৃত দূরত্বের তুলনায় তিনগুণ বেশি বলে মনে হতো, আর তা হয়ে উঠত দীর্ঘতর, কেননা, এরপর ক্যালিগ্রাফির পাঠ নিতে যেতে হতো আমাকে। বাবা ক্যালিগ্রাফি পছন্দ করতেন এবং আমাদের বাড়ির বিশ্রামস্থলের দেয়ালের খিলানযুক্ত কুঠুরিতে প্রায়ই ঝুলিয়ে রাখতেন ক্যালিগ্রাফির নানা স্ক্রল। তিনি পেইন্টিং বলতে গেলে ঝুলাতেনই না। যে স্ক্রলগুলো সাধারণত ঝুলিয়ে রাখতেন, সেগুলো হয় ছিল চীন থেকে আনা, কালির দাগে আঁকা অন্তর্লিখিত পাথুরে স্মৃতিস্তম্ভ, নয়তো তার পরিচিত চীনা কোনো মানুষের লেখা কোনো চরিত্র।

হানশান মন্দির [চীন] থেকে আনা একটি সমাধিস্তম্ভের এক সবিশেষ অ্যান্টিক রাবিং বা খোদাইকৃত লেখার কথা এখনো আমি মনে করতে পারি। পাথরটির যত্রতত্র চরিত্রগুলো হয় ভেঙে গিয়েছিল, কিংবা মুছে গিয়েছিল খোদাই; আর কিছু বাক্যের মাঝখানে ছিল ব্ল্যাঙ্ক-স্পেস। মুছে যাওয়া শব্দগুলো বাবা পূরণ করে নিয়েছিলেন এবং তা করতে গিয়েই আমাকে তাং রাজবংশের চীনা কবি চ্যাং চির ‘অ্যা নাইট স্পেন্ট বাই দ্য ম্যাপল ব্রিজ’ কবিতাটি শিখিয়েছিলেন। এখনো স্মৃতি থেকে পুরো কবিতাটি আমি আবৃত্তি করতে পারি এবং একটা ব্রাশ হাতে নিয়ে, খুব সহজেই এটি লিখে ফেলতে পারি। বছর কয়েক আগে একটি জাপানি-স্টাইলের রেস্টুরেন্টের এক সমাগমে আমি হাজির হয়েছিলাম; সেখানে চ্যাং চির এই কবিতাটির একটি চমৎকার হাতে লেখা স্ক্রল ঝোলানো ছিল। এটির কথা সাত-পাঁচ না ভেবে, দ্রুততার সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে পড়ে ফেলেছিলাম আমি। অভিনেতা কায়ামা ইয়ুজো আমার আবৃত্তি শুনে, অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘গুরু, আপনার এ গুণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।’

কায়ামা যে মুগ্ধ হয়েছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ‘সানজুরো’ [১৯৬২] ফিল্মটির স্ক্রিপ্ট উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনানোর সময়, সেখানে একটি পঙক্তি ছিল— ‘আস্তাবলের পেছনে অপেক্ষা কর’, আর তিনি ভুল করে ‘আস্তাবলের’ জায়গায় ‘বাড়ির বাইরে অপেক্ষা কর’ বলে ফেলেছিলেন— যদিও এটি বস্তুতপক্ষে ছিল অন্য এক চরিত্রের কথন। তবু তাকে আমি ১৯৬২ সালে নির্মিত এই ফিল্মটির একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে দিয়েছি এবং পরবর্তী সময়ে তাকে আবারও ‘রেড বিয়ার্ড’ [১৯৬৫] সিনেমায় নিয়েছি। কিন্তু এবার সত্যটা বলার সময় হয়েছে; ঘটনা হলো, শুধু হানশান মন্দির থেকে আনা স্মৃতিস্তম্ভে এটি লেখা ছিল বলেই এই কবিতাটি আমি মুখস্থ বলতে পারি। অন্য কোনো চীনা কবিতা আমাকে পড়তে বলা হলে, আমি স্রেফ তোঁতলাতে শুরু করব! যেমন ধরুন, আমার বাবার ঝুলিয়ে রাখা স্ক্রলগুলো অন্য যেসব চীনা কবিতা লেখা ছিল, সেগুলোর মধ্যে শুধু এই পঙ্‌ক্তিগুলোই আমার মনে রয়েছে :

     ‘তোমার তলোয়ারের জন্য, ব্যবহার করো পূর্ণচন্দ্রের নীলচে ড্রাগন ব্লেড

     তোমার পাঠের জন্য, পড়ো বসন্ত ও শরতের ইতিবৃত্তের ওপর তসো বর্ণনা।’

এটির প্রতি আমার আগ্রহ কমই।

আবার আমি বিষয়-চ্যূত হয়ে গিয়েছি। কথা হলো, আমি বুঝতে পারি না, আমার বাবা— যিনি কিনা ক্যালিগ্রাফি ভীষণ পছন্দ করতেন, কী করে তিনি আমাকে এমন ধরনের শিক্ষকের কাছে পড়তে পাঠালেন। এর কারণ হতে পারে, শিক্ষকটির স্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ির কাছে এবং কারণ, আমার ভাইয়াও সেখানে যেতেন। বাবা যখন আমাকে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন, শিক্ষকটি ভাইয়ার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন এবং বাবাকে জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ভাইয়াকে যেন আরো পড়ার জন্য এখানে আবারও পাঠানো হয়। দৃশ্যতই, ভাইয়া এখানে অনেক ভালো করেছিলেন। কিন্তু এই শিক্ষকটির ক্যালিগ্রাফির প্রতি কোনো আকর্ষণ আমি বোধ করতে পারিনি। বস্তুতপক্ষে তিনি ছিলেন কঠোর ও অবিচল; কিন্তু তার লেখার মধ্যে স্বাদ কিংবা সুবাস আমি খুঁজে পাইনি : এ যেন ছিল স্রেফ বইয়ে ছাপা হওয়া চরিত্রগুলোর মতো। যেহেতু আমার ওপর বাবার নির্দেশ ছিল, ফলে আমাকে প্রতিদিন সেই স্কুলটিতে যেতে হতো এবং শিক্ষকটির ক্যালিগ্রাফিকে নমুনা মেনে নিয়ে রাইটিংয়ের প্র্যাকটিস করতে হতো।

মেইজি যুগের ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আমার বাবা ও ক্যালিগ্রাফি শিক্ষক— উভয়েই নিজেদের মুখের ‘লোম’গুলো বড় করেছিলেন। তবে একজন মেইজি মুরুব্বি মুখপাত্রের মতোই আমার বাবার ছিল গালভর্তি দাঁড়ি ও গোঁফ; অন্যদিকে একজন মেইজি পেটি বুরোক্র্যাটের মতোই আমার ক্যালিগ্রাফি শিক্ষক শুধু গোঁফ রেখেছিলেন। কঠোর ভঙ্গিমা নিয়ে, ডেস্কের পেছনে অনড়ভাবে বসে থাকতেন তিনি। যেন ছাত্রদের তাদের ডেস্কের পেছন থেকে সারিবদ্ধভাবে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।

তার পেছন দিয়ে বাগানটি দেখতে পেতাম আমরা। প্রাচীন শাখা-প্রশাখা প্যাঁচিয়ে রাখা একগুচ্ছ বনসাই মিনিয়েচার বৃক্ষ ভরা বিশাল আকারের তাকগুলো মহিমা ছড়িয়েছিল বাগানটিতে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি বুঝে উঠতে পারতাম না, কী করে ছাত্রদের ডেস্কে এগুলো রাখা যেতে পারে। যখন কোনো ছাত্র অনুভব করতো, সে বেশ ভালোমতো কিছু লিখতে পেরেছে, তখনই কেবল সে ধুকপুক বুক নিয়ে শিক্ষকটির সামনে গিয়ে সেটি দেখানোর সাহস পেত। শিক্ষক সেটির দিকে তাকাতেন, এবং যে রেখাগুলো তার ভালো লাগেনি— লাল কালির একটি ব্রাশ নিয়ে সেগুলো কাটাকুটি করে দিতেন। এমনটা বারবার, বারংবার ঘটতেই থাকত।

অবশেষে শিক্ষকটি যখন ছাত্রটির রাইটিং স্যাম্পলটিকে অনুমোদন দিতেন, তখন সেটিতে এমন এক সিলমোহর তিনি সেঁটে দিতেন— সেই প্রাগৈতিহাসিক সিলমোহর-স্ক্রিপ্টটির কোনোকিছুই আমি পড়তে পারতাম না; ছাত্রটির সেই কাজটির এক কোনায় নীলরঙা একটি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিতেন তিনি। সবাই এটিকে ‘ব্লু সিল’ নামে ডাকত; এবং আপনি যখনই ব্লু সিল অর্জন করতে পারবেন, তখনই সেদিনের মতো বাড়ি যাওয়ার ছুটি পাবেন। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে, মিস্টার তাচিকাওয়ার বাড়িতে যেতে পারা ছাড়া আর কোনো আকাঙ্ক্ষাই আমার তখন ছিল না; ফলে শিক্ষকটির ক্যালিগ্রাফি নকল করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় নিজেকে মগ্ন করেছিলাম। তবে যে কাজটি আপনার ভালোলাগবে না, সেটিকে নিশ্চয়ই ভালোবাসতেও পারবেন না আপনি?

ছয় মাস এভাবে কাটানোর পর একদিন বাবার কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম, ক্যালিগ্রাফির পাঠ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে। ভাইয়ার একান্ত সহযোগিতায়, সেই অনুমতি পেতে সফল হয়েছিলাম আমি। ভাইয়া ঠিক কী কথাটি বলেছিলেন, এখন আর আমার মনে নেই; তবে শিক্ষকটির এই লেখন-প্রশিক্ষণ নিয়ে যে আমি একেবারেই সন্তুষ্ট নই, সে কথাটি বাবাকে বেশ যৌক্তিকভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আর নিজের যুক্তির শেষ টেনেছিলেন এই বলে যে, আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা স্বাভাবিকভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত। মনে পড়ে, আমি তখন অবাক হয়ে বসে ছিলাম, আর শুনছিলাম ভাইয়ার কথা— যেন তিনি অন্য কারো সম্পর্কে কথা বলছেন।

ক্যালিগ্রাফি স্কুল যখন ছেড়ে দেই তখনো আমি ব্লক-স্টাইল স্ক্রিপ্টে কাগজের বড় বড় শিটের ওপর চার-চরিত্রের কবিতাগুলো লেখার পর্যায়েই মাত্র উন্নীত হয়েছিলাম। এখনো আমি এ ধরনের ক্যালিগ্রাফিতে ভীষণ দক্ষ। কিন্তু আমাকে যদি এর চেয়ে ছোট কোনোকিছু কিংবা টানা-হাতে-লেখা স্ক্রিপ্টে চরিত্রগুলো লিখতে বলা হয়, তাহলে তা ঠিকমতো করতে পারব না।

পরবর্তী বছরগুলোতে সিনে-দুনিয়ার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, ‘কুরো-সানের লেখা কিন্তু স্রেফ হস্তলেখা নয়, বরং সাক্ষাৎ ছবি।’

(চলবে)