গল্প পড়ার গল্প
আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’
বাংলাদেশের লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাদের এই বঙ্গে তেমন পরিচিত নন। যেমন চেনা ওয়ালিউল্লাহ, ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক বা আবু ইসহাক। আলাউদ্দিন আল আজাদ কেন আড়ালে থেকে গেলেন আমি জানি না। ‘বৃষ্টি’ গল্পের কথা আমি আবছা শুনেছিলাম, সৎ মা ও সমবয়সী পুত্রের সম্পর্ক। চট্টগ্রামের বন্ধু মাসুদ করিম আমার জন্য একটি বাংলাদেশের গল্প সংকলন প্রথম খণ্ড এনেছিলেন। বৃষ্টি সেই সংকলনে পড়ি। দেশভাগ যে অপরিচয়ের গণ্ডী তুলে দিয়েছে, তা থেকে আমরা এত বছরেও মুক্ত হতে পারিনি।
বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক এপারে অচেনাই রয়ে গেলেন। ১৯৩২ সালের ৬ মে তিনি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রয়াণ ২০০৯ সালের ৩ জুলাই। তাঁর কথা বলতে, আমাকে বাংলাদেশের এক তরুণ বন্ধু, লেখক পারভেজ হাসান ‘কর্ণফুলী’ ও ‘২৩ নম্বর তৈলচিত্র’ নামের দুটি উপন্যাসের কথা বলেন। ‘২৩ নম্বর তৈলচিত্র’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে, অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বুলগেরীয় ভাষার কথা শুনলাম আরেক বন্ধু এমদাদ রহমানের কাছে। ‘বসুন্ধরা’ নামে ছবি হয়েছিল ওই উপন্যাস থেকে।
আর ‘বৃষ্টি’ গল্প হলো বাংলাদেশের ছোটগল্পে এক নতুন যাত্রা। এমন অনুভূতিময় গল্প খুব কমই পড়া হয়। এমন অপরূপ এর গদ্যশৈলী, এমন চিত্ররূপময় সেই যাত্রা, হাজি কলিমুল্লাহর প্রথম পক্ষের এক ছেলে খালেদ এবং তৃতীয় পক্ষের বিবি জোহরার ফেরা সেই পূর্ণিমা রাতে। নাইওর করে ফিরছে জোহরা, ২১ বছর বয়স। তার স্বামী হাজির বয়স ষাট। হাজির প্রথম পক্ষের বেটা খালেদ ২১-২২। এই গল্প বৃষ্টিহীনতার। সেই বছর বৃষ্টি ছিল না। ফাল্গুন গেল, চৈত্র গেল, আকাশ নির্দয়। বৈশাখ এলো তীব্র দাবদাহ নিয়ে। হাজি আগের বছর সুতোর চোরাই কারবার করে বেশ কিছু টাকা আয় করেছিল, তার অর্ধেক দিয়ে মেঘনার বন্দরে একটি গুদাম কিনেছে। বাকি অর্ধেক দিয়ে জমি। নিজে পাট মজুত না করতে পারলে গুদাম দিয়ে কী হবে? ভাড়া দিয়ে ক’পয়সা। কিন্তু হাজির জমিতে পাট চারা যে শুকিয়ে যায়। পাট চাষে অনেক ঢেলেছে সে এবার। সবই বুঝি গেল লোকসানে। বৃষ্টি না হলে ফসল বাঁচে না, কিন্তু বৃষ্টি হয় না কেন? নিশ্চয় কোনো গুরুতর কারণ আছে।
জুম্মার নামাজের পর কথা উঠল। মসজিদের মৌলানা বলতে লাগলেন, খোদার গজব তখন নামে, চারদিক যখন অনাচারে ভরে যায়। এখন তাই হয়েছে। ছেলে বাপের কথা শোনে না, জেনানা বেপর্দা, নামাজ নেই, রোজা নেই, হজ-জাকাত নেই...। মৌলানার কণ্ঠস্বরে মসজিদের ভেতরটা গমগম করতে লাগল, তিনি বলতে লাগলেন, সকলে মিলে মাঠে গিয়ে হাত তুলে আল্লার কাছে মোনাজাত করতে হবে, তাতে তাঁর যদি দয়া হয়। মাতব্বরদের ভিতর থেকে হাজি কলিমুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মৌলানার কথা সকলেই মান্য করবে, কিন্তু কুকর্ম যা হচ্ছে তারও বিচার দরকার। কেন অনাবৃষ্টি তা ভাবতে হবে, নিশ্চয়ই কোনো মেয়ে অবৈধ ভাবে গর্ভবতী হয়েছে, এদের তালাশ করে বের করতে হবে, এদের শাস্তি দিলেই এই অভিশপ্ত অবস্থা থেকে মুক্তি হবে।
এই আলোচনার পরই একদিন খর রৌদ্রের ভিতর দুপুরে খেলার মাঠে ‘মেঘের নামাজ’ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মৌলানা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় গাঁয়ের লোকের অনুরোধে হাজি কলিমুল্লাহ রাজি হলেন ইমামতি করার জন্য। তিনি নামাজ পড়ানোর সময় পূব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে অগুন্তি অসহায় মানুষ দেখে বুঝলেন, দুনিয়া এখনো জিন্দেগির অযোগ্য হয়ে ওঠেনি, আল্লার নামে হাক দিলে হাজার লোক এসে যায়।
গল্প সেই হাজি কলিমুল্লাহর। গল্প গাঁয়ের দরিদ্র নিঃসহায় মানুষের। কয়েকদিন ধরে দুপুরে তারা খেলার মাঠে হাজির হয়ে আল্লার রহম প্রার্থনা করে। অবোধ্য আরবি উচ্চারণ শোনে হাজির কণ্ঠে। নানা লোকাচার মান্য করে। আকাশ থেকে ঈশ্বরের করুণা বর্ষণ হয় না। মেঘ নেই আকাশে। হাজির মনে সন্দেহ গাঢ় হয়। নিশ্চয় কোনো অনাচার হয়েছে। কাজের মেয়ে জৈগুন খবর দেয়, বাতাসিকে দেখে মনে হয় পেট উঁচু। গর্ভবতী হয়েছে। বাতাসি গাঁয়ের প্রান্তে থাকে এক হতদরিদ্র রমণী। তার স্বামী মরেছে ন’মাসের মতো। তার কুটিরে আশ্রয় নিয়েছে অসুস্থ একটি লোক, সে তার মামাতো ভাই। গল্প এই অবধি অনেকটা সহজ।
কুসংস্কার আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক বিপযর্য়ের দায় মানুষের ওপর ফেলছে ক্ষমতাবান এবং হিংস্র পুরুষ। এই গল্প আর দুজনের। হাজির তৃতীয় পক্ষ জোহরা এবং হাজির পুত্র খালেদের। নাইওর থেকে নতুন বিবি ফিরবে, তাকে আনতে পাঠিয়েছিল ছেলেকে। হাজির শরীর ভালো ছিল না। জোহরার কোলে হাজির দ্বিতীয় পক্ষের বছর পাঁচের ছেলে। সে মাতৃহারা। নতুন মাকে আঁকড়ে ধরেছে বিয়ে হয়ে সে হাজির ভিটেয় আসার পর থেকেই। নাইওর থেকে সম্পর্কে বড় ছেলের সঙ্গে ফেরা হেঁটে, জ্যোৎস্নায় আকুল এক রাত্রে। পার হয় মরা নদী, যার মধ্যিখানে তিরতিরে জল। ২১ বছরের জোহরার ভিতরে চাঁদের আলো ঢুকেছে যেন। বাচ্চাটি বয়ে ক্লান্ত, খালেদের হাতে দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্পর্শ পায় যেন উভয়েই। তারপর চাঁদের আলোয় ফেরা। অস্পষ্ট মেঘে ছাওয়া আলোর ভিতরে ফেরা। কাছাকাছি হয়েও না হওয়া। একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাস টের পেতে পেতে ফেরা।
এই যাত্রাই যেন বাংলা গল্পের এক মহৎ যাত্রা হয়ে ওঠে। তাদের সম্পর্ক তো সৎ মা এবং পুত্রের। গত শতকের ষাটের দশকে লেখা এই গল্প নিশ্চিত ভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বদ্ধ জলার মতো স্থির হয়ে থাকা সমাজটিকে। তরঙ্গ তুলেছিল। নাইওর থেকে ফিরল বিবি। হাজির মাথায় অনাবৃষ্টি আর ফসলহানির জন্য একজনকে শনাক্ত করা ব্যতীত আর কিছু ছিল না। টেরও পায়নি তার বিবি ভিতরে ভিতরে অগ্নিময়ী হয়ে উঠেছে। উঠানের মেহেন্দি গাছটা বটি দিয়ে কেটেই ফেলল। কার উপরে রাগ, অভিমান তার! সম্পত্তির জন্য এই লোকটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। লোকটা মরলে তার সম্পত্তি নিয়ে এক জোয়ানকে বিয়ে করতে পারবে।
বাতাসি যৌবনবতী। এক সকালে তার বাড়ি গিয়ে তাকে নিজে পরখ করে এসেছে হাজি। তারপর নিশ্চিত হয়েছে যে মুমূর্ষু লোকটা, যে মামাতো ভাই বাতাসির ঘরে ময়লা কাঁথা মাদুরে শুয়ে আছে সে-ই বাতাসির গর্ভ ধারণের জন্য দায়ী। নতুন বিবিকে তা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে হাজি। সেই যুবতী নিঃশব্দে ঘরের বাইরে যায় খিল খুলে। খালেদ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গভীর রাতে খালেদ বাড়ি ফিরলে সাঁ করে তার সামনে গিয়ে জোহরা বলে, সারাদিন না খেয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে, তাই না? রোষে তার গালে চড় মারে অন্ধকারে। কী অনুপম সেই আলো অন্ধকার, প্রণয় অভীপ্সা! বাতাসীর বিচারের রাতেই হয়ে যায়। নির্জন বাড়িতে খালেদ প্রবেশ করে। জোহরার ঘরে যায়। বাতাসীকে বিচারে দোষী করে যখন তৃপ্ত হাজি, আকাশ ডাকে। মেঘ ক’দিন ধরেই আসছিল। উন্মত্ত বাতাস, ঝড় তছনছ করে দেয় সব। বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টির ভিতরে তৃপ্ত জোহরা নেমে আসে। এতদিনে অনাবৃষ্টি কাটল। ফসল হবে, সে ভিজবে না প্রথম বৃষ্টিতে? গল্পটিতে জোহরাই যেন অনাবৃষ্টির পৃথিবী হয়ে উঠেছে। গল্প নয়, আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছেন এক কবিতা। এই বিরল গোত্রের গল্প পাঠে কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা হয়।