হাসানুল হক ইনুর গণমাধ্যম ভাবনা

Looks like you've blocked notifications!

তথ্যমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ ও লেখক হাসানুল হক ইনু রচনা করেছেন ‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ’ নামক একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে ২০টি নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেখকের একাগ্র গবেষণাকর্ম, সেমিনার বক্তব্য ও লেখনির কিছু অংশের লিপিবদ্ধ রূপ এই বই। এর আগে তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পাঠকদের কাছে এসেছে। তার মধ্যে বহুল পঠিত হলো, ‘তিনদাগে ঘেরা বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি’, ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নয়া কৌশল’, ‘দুই শতাধিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ’ প্রভৃতি।

‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘মুখবন্ধে’ হাসানুল হক ইনু লিখেছেন- ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বিকাশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ভূমিকা অপরিমেয়। এ কারণেই দেশে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের নজিরবিহীন বিকাশ ঘটেছে। উন্নততর হচ্ছে সাংবাদিকতার মান। প্রশাসন ও জনসেবা হয়ে উঠেছে ডিজিটাল, স্বচ্ছতর ও আধুনিক। কিন্তু থেমে থাকার সুযোগ নেই, বাংলাদেশকে নিতে হবে আরেক ধাপ এগিয়ে।’ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় থেকে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত হলো- ‘এখানে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়।’ সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁর সরকার এমন কোনো আইন তৈরি করেনি যাতে মুক্ত গণমাধ্যম বাধাপ্রাপ্ত হয় বরং আইনের আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করে গণমাধ্যমের বিকাশে আরো সহায়তা করা হচ্ছে। বর্তমান রাষ্ট্র সাংবাদিকদের কোনো কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করছে না। এমনকি রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরাও সাংঘর্ষিক অবস্থায় নেই।

২.

হাসানুল হক ইনু আলোচ্য গ্রন্থের ‘গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও বাংলাদেশ’ নামক প্রথম নিবন্ধে গণমাধ্যমের কাজ সম্পর্কে অল্প কথায় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, মিডিয়া সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে এবং জাতির সংকটে জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর ও বিবেক হিসেবে ভূমিকা রাখে। এজন্য গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যেকোনো সরকার মিডিয়ার জন্য নীতি ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়। কারণ গণতান্ত্রিক সরকার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণমাধ্যমের প্রতিপক্ষ নয়। বরং গণমাধ্যমের সঙ্গে হাত ধরে গণতন্ত্র সামনের দিকে এগিয়ে যায়। স্বাধীন গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং এ দেশে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা মোকাবিলা করে সংবিধানের পক্ষে থাকতে হবে। লেখকের মতে, ‘গণমাধ্যম স্নেহময়ী মাতা’। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মা হিসেবে মিডিয়ার কার্যকর ভূমিকার কথাই তিনি অন্যান্য নিবন্ধে তুলে ধরেছেন। ‘আমাদের গণমাধ্যম : গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী’ রচনায় তাঁর সেই অভিব্যক্তি লিপিবদ্ধ রয়েছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বলেই হাসানুল হক ইনু ‘সাংবাদিক-নিরাপত্তা’ রচনায় সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের তিনি মানুষের মতো হুঁশ করে কথা বলতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এজন্য তিনি শিক্ষার সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্কসূত্র নির্ণয় করেছেন ‘প্রাথমিক শিক্ষা ও সাংবাদিকতা’ নিবন্ধে। গণমাধ্যম তাঁর মতে, ‘জাতির বিবেক নির্মাতা’। শিক্ষার অবারিত বিস্তার ও উৎকর্ষের কারণে বাংলাদেশে গণমাধ্যম উন্নত।

হাসানুল হক ইনু তাঁর লেখার মাধ্যমে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম উন্মুক্ত, বিকাশমান ও স্বাধীন। এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। ‘গণমাধ্যম ও সরকার একে অপরের নিত্যসঙ্গী’। এখানে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। গণতন্ত্র বিকাশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তবে ‘সাংবাদিকতার স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয়। এর একটা নীতি নৈতিকতা রয়েছে। এর মূল্যবোধ রয়েছে। এর একটা মানবিক দিকও রয়েছে। সাংবাদিকতা পেশার স্বাধীনতার অপব্যাখ্যা দেওয়াও এক ধরনের অপরাধ। এখানে সাংবাদিকদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।’ সাংবাদিকদের দেশের আইনকানুন মেনে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। নতুবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা ব্লগার হত্যাকারী, জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা, অর্থদাতা ও আগুনে পুড়িয়ে যারা মানুষ মেরেছে তাদের মুখোশ জনগণের কাছে উন্মোচন করুন।’ 

হাসানুল হক ইনু এ গ্রন্থে জঙ্গি-সন্ত্রাস ও ইসলামভীতি মোকাবিলায় গণমাধ্যমের ভূমিকা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি ‘দুর্যোগ মোকাবিলা, জলবায়ুর পরিবর্তন ও সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সচেতন করতে গণমাধ্যমের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তাঁর মতে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা কোনো একটি দেশের পক্ষে একা সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক-এ তিন ধাপের কার্যক্রম। এতে বিভিন্ন পরিবেশবিদের সঙ্গে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণ জরুরি।  তাঁর গ্রন্থ পাঠ করে আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে তিনটি বড় যুদ্ধের ভেতরে রয়েছে। সে যুদ্ধগুলো হলো- টেকসই উন্নয়ন অর্জনের যুদ্ধ, জঙ্গিবাদ নির্মূলের যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার যুদ্ধ। প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রেই সরকারের আন্তরিকতার পাশাপাশি গণমাধ্যম সরকারের সঙ্গে রয়েছে এবং আগামীতেও থাকবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্প্রচার ও গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে সরকারের সুদৃঢ় নীতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। লেখনির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক এই রাজনীতিবিদ যথার্থ কথাগুলোই আমাদের অবগত করিয়েছেন। বক্তা হিসেবে যেমন তেমনি লেখনিতে তিনি নতুন নতুন শব্দ সৃজন করেছেন। তাঁর মতে, দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন ‘স্বর্ণপ্রবাসী’ ও পোশাকশিল্প ও জাতিসংঘে শান্তিরক্ষায় এক অনন্য নাম। আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব যুগের আগামী দিনে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত জনসম্পদ দেশের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করবে। ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং আমাদের গণমাধ্যম’-এ এবিষয়ে তাঁর যৌক্তিক অভিমত আছে।

হাসানুল হক ইনু ‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি এ গ্রন্থে বেশি পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন গণমাধ্যম সম্পর্কে অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে তবু গণতন্ত্রের সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধনের কথা লিখেছেন তিনি। আবার তিনি যেমন সাংবাদিকতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন তেমনি রাজনীতি, প্রশাসন ও গণতন্ত্রকে মিলিয়ে পাঠ করেছেন। ‘আমাদের চলচ্চিত্র, আমাদের গর্ব’, ‘চলচ্চিত্র ও সাংবাদিকতা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও জঙ্গিবাদের স্বরূপ’- এই তিনটি নিবন্ধে লেখক শক্তিশালী মিডিয়া হিসেবে চলচ্চিত্রের দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে উৎসাহী করে তুলেছেন। আবার বেতার ও টেলিভিশনের সামাজিক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছেন যথাক্রমে ‘বেতার : যাপিত জীবনের প্রতিধ্বনি’, ‘কমিউনিটি বেতার : তৃণমূলকে আনে টেকসই উন্নয়নে’, ‘টেলিভিশন ও কেবল নেটওয়ার্ক’ এবং ‘পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ টেলিভিশন’ শীর্ষক রচনাসমূহে।  

 ৩.

‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট ও তথ্য মন্ত্রণালয়’ নিবন্ধে হাসানুল হক ইনু লিখেছেন, গণমাধ্যম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে তথ্য কর্মকর্তাদের দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের যোগ্যকর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে জঙ্গি দমনের মাধ্যমে শান্তি, উন্নয়ন বেগবান করে সমৃদ্ধি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে সর্বজনীন করে জনগণের সক্ষমতা আনয়ন করছেন। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে একটি বাড়ি একটি খামার, ডিজিটাল বাংলাদেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, সবার জন্য বিদ্যুৎ, আশ্রয়ণ প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগ বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ঠিক এ সময়েই দেশের উন্নয়নে তৃণমূল মানুষকে সম্পৃক্ত করতে সকল গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। আর দেশব্যাপী ৬৪টি জেলা ও ৪টি পার্বত্য উপজেলার তথ্য অফিসের কর্মকর্তাদেরই এ দায়িত্ব পালনে অগ্রণী হতে হবে।

৪.

হাসানুল হক ইনু রচিত ‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ’ গ্রন্থটির ভাবনাপুঞ্জ বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) মে (২০১৭) মাসে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের সূত্র অনুসারে আরএসএফের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ থেকে পিছিয়ে ১৪৬-এ গেছে। প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত তিন-চার বছরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। হাসানুল হক ইনুর গ্রন্থে উপস্থাপিত বক্তব্য থেকে ওই সংস্থাগুলো স্পষ্ট জবাব পাবে। আর সাধারণ জনগণ ও এ দেশের সাংবাদকর্মীরা মিডিয়াকে উন্নয়নের পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরতন্ত্র ও বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া গ্রন্থটি তরুণ রাজনীতিবিদ, শিক্ষানবিশ গণমাধ্যমকর্মী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাংবাদিকতা অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। কারণ এই গবেষণাগ্রন্থটি কালজয়ী সময়ের দলিল হিসেবে ভবিষ্যৎ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

বইয়ের নাম : গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ

লেখক : হাসানুল হক ইনু

প্রকাশনা সংস্থা : অন্যপ্রকাশ

প্রকাশের সাল : ২০১৭

প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ

মূল্য : ২৫০ টাকা