গল্প পড়ার গল্প
কমলকুমার মজুমদারের ‘আমোদ বোষ্টুমী’
কমলকুমার জন্মেছিলেন ১৪ নভেম্বর, ১৯১৪। শতবর্ষ পার হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যে তিনি তিনিই। একজনই। কমলকুমার আমাদের ভাষাকে এক বিরল সৌন্দর্য দান করেছেন। আমাদের ভাষার ভেতরে এমন সৌন্দর্য নিহিত আছে, তা বঙ্কিমের পর তেমনভাবে খনন করেননি কেউ। হ্যাঁ, জীবনানন্দের গদ্যে আছে আরেক রূপময়তা।
আমি তাঁকে প্রথম পড়েছি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, সেই গীতার মতো গেরুয়া মলাটে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাস। মনে পড়ে সমস্ত দিন ধরে সেই উপন্যাস পড়ে আমি যেন কী এক জীবন আর সৌন্দর্যময়তায় অবগাহন করেছিলাম। কমলকুমারের গল্পও তাঁর উপন্যাসের মতো চিত্রময় আর তীব্র, ধারালো কথনে অনন্য। সমাজ আর এই মূর্খ সামাজিকতাকে কমলবাবু আঘাত করেছেন তাঁর অনুপম গদ্যে। অনুপম গদ্য কিন্তু নিষ্ঠুর জীবনের ভাষ্য হয়েছে সেই সব গল্প বারবার। সমকামিতা নিয়ে রাষ্ট্র এখন বিচিত্র নৈতিকতার বিধান দিচ্ছে, কমলকুমার কত বছর আগে লিখেছিলেন ‘মল্লিকা বাহার’। দুই নিরুপায় কন্যার ভালোবাসাহীন জীবন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে দিনের শেষে সুষমাময় হয়। এ ব্যতীত ‘লাল জুতো’, ‘মতিলাল পাদরি’, ‘তাহাদের কথা’, ‘আমোদ বোষ্টুমী’, ‘রুক্সিনীকুমার’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’—কমলকুমারের এই সব গল্পের কোনোটাই ভুলিনি আমি।
আমি এখন বলছি, একটু তুলনায় অপরিচিত দীর্ঘ গল্প ‘আমোদ বোষ্টুমী’র কথা। এ হলো পুরোনো কলকাতার গল্প। অবশ্যই তা উত্তর কলকাতার ভেঙে পড়া ঠুনকো আভিজাত্যের গল্প। ভেঙে পড়া দালানকোঠা আর তার ভেতরে ইটচাপা ঘাসের মতো বেঁচে থাকা মানবজীবনের কথা। আমোদিনী এক কাজের মেয়ে। অল্প বয়সী। সোমত্ত, স্ফীত, গর্বিত। দশাশই তার চেহারা। সে থাকে সিঁড়ির পাশেই একটি ঘরে। সে ছাদে দাঁড়িয়ে চুল শুকোয়। অপূর্ব সেই বর্ণনা। চুল থোক করে শুকিয়ে আবার এলো করে দেয় আমোদিনী। তারপর তাকিয়ে দ্যাখে সিঁড়ির পাশের ঘরের জানালার দিকে। কেউ নেই সেখানে। কিন্তু অনেক কিছুই ছিল। রোদ মাদুর—খোলা বইয়ের পাতা উড়ছে এখন। খাতা, কলম, কালি আর মাদুরে ফেলে যাওয়া একটি গোলাপি চাদর। ছাঁদ থেকে ঝুঁকি দিয়ে দেখা যায় ‘একটি অপুরুষ্টু সংসারের সাজবেলে উঠন।’ এ হলো উনিশ শতকের সেই কলকাতার গল্প, যেখানে গেরস্তের বাড়ি গোয়ালঘর, তুলসিমঞ্চ, খিড়কির দরজা, ভাঙা পাঁচিল—সেইসব নিয়ে হতো। সেই সংসারে গিন্নি বসে নাতিকে ভাত খাওয়ান। নাতি হাঁটু নাচাতে নাচাতে ভাত খায়। নাতির গায়ে গত্তি লাগে না। সেই গোরাচাঁদ আবার আমোদের ন্যাওটা খুব। তার ডাকে আমোদ না এলে গলায় ঝাঁজ আসে। সে তার দুধের বাটি গরম হয়ে গেলে আমোদিনীকে ডাক দেয়, ‘আমোদ আমোদিনী বাটি বদলে দে মুকপুড়ি।’
গিন্নি তাতে আদরের নাতি গোরাকে বকলে তার গলার ঝাঁজ কি কমে। আসলে যুবতী মেয়েমানুষ, গোরার এঁটো থালায় ভাত নিয়ে বসে। বুড়ি গিন্নির সাধের নাতি, তার বাপ মা নেই। তাকে বেশি আদর দেওয়ার কথা উঠলে বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে চোখে আঁচল দেয়। কমলবাবু বলেন, ‘ছাইমাখা পুরাতন স্যাঁতসেঁতে কথা, শ্মশানের ছায়া।’ কমলকুমার এমনভাবেই বলেন। গল্পের ভেতরে ভেতরে রোদ মরা বিকেলের নিঝুমতা আনেন। আমোদিনী এই সংসারে আছে ষোল-সতের বছর। মায়ের সঙ্গে এসেছিল যখন সে কোনোমতে ধুলোমাখত উঠোনে বসে। মায়ের নাম ছিল গিরি। আমোদকে রেখে সে মরেছিল। আমোদ এই বাড়িতে রয়ে গেল। গাছের মতো বেড়ে উঠল। সে আগে মনে করত এ বাড়ির কেউ, কিন্তু যবে কোন এক কুটুম্বকে ঐ গোরাচাঁদ বলে ফেলেছিল, কে আমোদ, না তাদের ঝিয়ের মেয়ে, সেদিন আমদের কী দুঃখ। আসলে এই গল্প কিন্তু শেষ অবধি প্রেমেরই। গোরাচাঁদে আমোদের টান আছে। আর গোরারও আছে আমোদে। সেই কথাটা বলে ফেলে মরমে মরেছিল গোরা। কতবার অন্ধকার সিঁড়িতে, ছাদের ঘরে নিরিবিলিতে গোরা আমোদকে বলেছে, ‘আমার গা ছুঁয়ে বল অমন কথা আর বলবি না।’ কী কথা, না ঝিয়ের মেয়ে সে এই কথা শুনে আমোদ বলে, সে কে, সে তো দাসী বাঁদী। গোরার কথা শুনে আমোদ তার গায়ে হাত দেয়। সিরসির করে ওঠে। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এইটুকু আলো। গোরা তাকে শুধুই ডাকে, বালিশ দিয়ে যা আমোদ, পান সেজে দে। আর আমোদ নিজেকে সাজায় কালো পাড়ের ফিতে দিয়ে আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে চুল বেঁধে। তার শরীর দেখলে মনে হয় সে হন্যে হয়ে রয়েছে।
কমলকুমার অতি নিবিড়ে বর্ণনা করেন আমোদিনীকে। তাকে গিন্নি প্রতিবেশী সদাশিবের বাড়ি পাঠায় মিউনিসিপালিটির ট্যাক্সো নিয়ে কথা বলতে। হাফ বোম্বাই খাটের ওপর শুয়ে সদাশিব নিকেলের চশমা চোখে লীলাপ্রসঙ্গ পড়ছিলেন। আসলে তাকে বলা আছে গোরার বিয়ের মেয়ে দেখার কথা। তার গ্রহ কুপিত, বিয়ে দেওয়া হলে গ্রহ দোষ যাবে। আমোদ তা জানে না। জেনে ফেলে মনে মনে ভেঙে পড়ে। এই গল্প এই আশ্চর্য শহরের কথা আর শহরের মানুষের কথা নিয়ে। আমোদ আর গোরার এক আশ্চর্য ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে। দীর্ঘ এই গল্পে কমলকুমার যেভাবে ক্ষয়ে যাওয়া এক সমাজের চেহারা এঁকেছেন, তা আমাদের সাহিত্যে নেই। এমন চাঁচাছোলা কথন। সদ্য কৈশোর পেরোন গোরায় যুবতী আমোদের নতুন রক্তের ঢল এমন যেন তার বুক কঁকিয়ে উঠছে শলাকাবিদ্ধ শুয়োরের মতো, কেননা গোরাকে আসছে জ্যৈষ্ঠের মধ্যে বিয়ে না দিলে অমঙ্গল হবে, তাই ত্রিবেণীতে মেয়ে দেখা হচ্ছে। শুনে আমোদের ঘুম যায়। আমোদ ঝি মাত্র, আর গোরা বয়সে ছোট কিন্তু উচু জাত। আশা ছিল তার দুর্দমনীয়। মনে পাপ ছিল না। আমোদিনী এখন সব করে। ছড়াঝাঁট, বাসিপাট, দুধ দোওয়া, তারপর কুলঙ্গী থেকে খঞ্জনীজোড়া বের করে নামগানে বেরোয়। এই গল্প যেন গল্প নয়, এ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এক সমাজের কথা। ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়েছে সবুজ ঘাসের মতো এক নিরূপম ভালোবাসা। আমোদ আর ছোটবাবু গোরার। গল্পটি পড়ুন। বলা যায় না সবটা।