আদিবাসী বিয়ে

গুড় খিলা ও সাঁওতাল বিয়ের পর্ব

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : সালেক খোকন

দিনাজপুরের একবারপুর। হাজী দানেশ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তাটি চলে গেছে ওই দিকে। প্রত্যন্ত এ সাঁওতাল গ্রামেই চলছিল ফিলিপ টুডু ও রান্দন হাজদার মেয়ে ফুল মনি টুডুর বিয়ে। সকাল হতে রাত অবধি খুব কাছ থেকে দেখি সাঁওতাল বিয়ের আদিরীতিগুলো।

সাঁওতালরা বিয়ের আগে ‘দা বাপলা’ বা গ্রাম পূজার আয়োজন করে থাকে। একটি মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটি চারকোণা গর্ত করে তার তিন দিকে তিনটি ধনুক দাঁড় করিয়ে সুতার ঘের তৈরি করে সিঁদুর দিয়ে এ পূজা শেষ করতে হয়। গর্তের মধ্যে দিতে হয় ‘সিটাকা (এক টাকার কয়েন’, চাউলি (চাল), দুর্বা ঘাস ও হানডি (হাঁড়িয়া) ও পানি। পূজা শেষে গর্তের কিছু পানি একটি কাঁসার ঘটিতে করে নেওয়া হয় কনে গোসলের সময় ব্যবহারের জন্য। সাঁওতালদের বিশ্বাস এ পানি মিশিয়ে গোসল করলে কনে অপদেবতাদের কুদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবে।

সাঁওতালদের বিয়ের আগের দিন বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে তেলাইদান নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করে। তেলাইদানের আগে কমপক্ষে তিনজন সধবা মেয়ে পুকুর থেকে কলস ভর্তি জল এনে বরকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। একই নিয়ম মেনে কনের বাড়িতেও কনেকে স্নান করানো হয়। এই জল আনারও বিশেষ নিয়মও থাকে। যেমন-বিধবা বা অবিবাহিতা মেয়েরা জল আনতে পারে না, কলসীর সামান্য অংশ খালিও রাখা যায় না, আবার জল আনার সময় পেছন থেকে ডাকা একেবারেই নিষেধ থাকে।

সাঁওতালরা বিশ্বাস করে স্নানের মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করা হয় যাতে অপদেবতার কোনো দৃষ্টি না পড়ে। জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার মধ্যেও একই বিশ্বাস রয়েছে। অতঃপর বর ও কনেকে যার যার বাড়িতে নতুন কাপড়, রূপার অলঙ্কার পরানো হয়। ওইদিন থেকেই শুরু হয় নাচ-গান আর আনন্দ ফূর্তি।

সাঁওতালরা বিয়ের দিন একই নিয়মে বর ও কনেকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়।

তেল-হলুদ মাখানোর সময় এরা সাঁওতাল ভাষায় গান গায় :

                               সুনুম সাসাং অজঃ মড়ে দিন পাহিল খন

                               দং বুন এনেচ আঃ ঝামর ঝামর।

                               সুনুম সাসাং পে অজঃ কেদিঞ।

                               ভিতির বলন পে মানা কেদিঞ।

                               ডুলৗ পাড়ন রিঞ ফাঁসি গজুঃ

 

ভাবার্থ :

গায়ের তেল হলুদ পাঁচ দিন আগে থেকে

দং নাচ হবে ঝামর ঝামর করে।

তেল হলুদ মাখাল

ভিতরে ঢুকতে মানা করল।

দে মা এক টুকরো দড়ি

পিড়িতে ঠেস দিয়ে ফাঁসি দিয়ে মরি।

স্নানের পর বর-কনের হাতে আম পাতায় বাঁধা একটি পোঁটলা বেঁধে দেওয়া হয়। পোঁটলায় থাকে কমপক্ষে তিনটি দূর্বাঘাস, নখে খুঁটে সাতটি আতপ চাউল এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ।  অতঃপর বরপক্ষ কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে।

এ সময় কনের বাড়িতে বরকে নিয়ে নানারূপ কৌতুহলদীপ্ত গান গাওয়া হয়।

একটি গান-

‘নাইন্  নূতুম দো বাবা বারঘরে মাছ ওয়া-এ পে

গুরিচ মন্দরে খুনতি বিদ মে,

নাইন্ নুতুম বারিয়াদ কো

হোর রে গে দরম কোপে

নাইন্ রেঁ জুরি দো নাতো রে গে।’

 

ভাবার্থ :

বাবা, মাঠের মধ্যে সামিয়ানা টানাও,

সে সামিয়ানা যেন থাকে বাড়ির খুব কাছে,

এবং সে সামিয়ানার খুঁটি পুঁতে দিও গোবরের ঢিবিতে,

বরযাত্রী যখন আসবে তখন তাদের বাধা দিও,

বাবা, আমার হৃদয় রয়েছে তোমাদের কাছে।

যেদিক দিয়ে বরপক্ষ কনের গ্রামে প্রবেশ করবে সে দিকে কনেবাড়ির একজন মুরুব্বী আগে থেকেই জলভর্তি একটি কলস নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বরপক্ষ আদি নিয়ম মেনে ওই কলসে একটি ছোট্ট লাঠি দিয়ে আঘাত করে গ্রামে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয়। অতঃপর তাদের কনের বাড়ি থেকে একটু দূরে কোনো গাছের নিচে বসানো হয়। এ সময় কনের বাড়িতে প্রবেশ করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ থাকে। গাছের নিচে বরপক্ষকে কোনো কোনো সময় একদিনের বেশি সময়ও থাকতে হতো। এখানে থাকাকালীন তাদের খাওয়া-দাওয়ার যাবতীয় খাওচ নিজেদেরই বহন করতে হতো।

গ্রামে বর পৌঁছানোর খবর পেয়েই কনে বাড়িতে প্রথম কনেকে স্নান করানোর ধুম পড়ে যায়। এই সময় একদল কুমারী মেয়ে আঁচলে মুড়ি বেঁধে বাজনা ও নৃত্যের তালে তালে পুকুর ঘাটে যায় এবং কলস ভর্তি জল এনে কনেকে মই পেতে গোয়াল ঘরে বসিয়ে স্নান করায়। কোনো কোনো অঞ্চলে কেবল মই-এর ওপর বসিয়েই স্নান করনো হয়ে থাকে।

সন্ধ্যার দিকে বাড়ির সেই মুরুব্বি এক ঘটি জল নিয়ে বর ও বরপক্ষকে বাড়ি আসার আমন্ত্রণ জানাতে রওনা হয়। এ সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি দল বাজনা নিয়ে বরকে বরণের অপেক্ষায় থাকে বাড়ির বাইরে। এই দলে দুটি কলস ভর্তি পানি নিয়ে দুজন মহিলা এবং কনের মার হাতে থাকে গুড় ও মিষ্টির একটি থালা। বর এসে প্রথম কনের মা, বাবা ও মুরব্বিদের প্রণাম করে। কনের মা তখন জল নিয়ে নতুন জামাতার পা ধুইঁয়ে দেয় এবং কোলে বসিয়ে মুখে গুড় তুলে খাওয়ায়। একে ‘গুড় খিলা’ বলে।

যখনই বরপক্ষ বাড়ির ভেতর দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখনই কনে পক্ষের নৃত্যের দল বরপক্ষের সঙ্গে আসা নৃত্যের দলকে ভেতরে আসতে বাধা দেয়। এই বাধা চলে নাচ ও ধাঁধার মাধ্যমে। যতক্ষণ নাচ ও ধাঁধা চলতে থাকে ততক্ষণ বর গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে জল, গুড় ও মিষ্টি খেতে থাকে।

বরপক্ষ বাড়ির ভেতর পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে বরের বাবা কিছু চাল, মুড়ি ও পয়সা প্রদান করে। এরপর কনের বড় বোন বরকে নতুন কাপড় পরাবার জন্য এগিয়ে আসে। এ সময় বরকে স্নান করানো এবং নতুন কাপড় পরানো হয়। একইভাবে কনের ভাই অপেক্ষায় থাকে বরপক্ষের কাছ থেকে কনের নতুন কাপড় নিতে। অনেক সময় বর নিজ হাতেই এই কাপড় প্রদান করে। বর নতুন কাপড় কনের ভাইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময় উভয়ে কিছু আতপ চাল বদল করে পরস্পরের মুখে তুলে দেয়। কনের নতুন কাপড়ের সঙ্গে কনের মায়ের জন্য একজোড়া শাড়িও থাকে। সাঁওতালরা একে মারাংবুড়ো শাড়ি বলে থাকে।

সিন্দুর ঘানডি বা সাঁওতাল বিয়ের কাপড় থাকে হলুদ রঙের। কাপড়টি তৈরি করা হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। বাজার থেকে কিনে আনা ১২ হাত সাদা কাপড় কিনে সেটিকে কাঁচা হলুদে ডুবিয়ে এবং পরে শুকিয়ে তৈরি করতে হয় বিয়ের কাপড়।

নতুন কাপড় দেওয়ার পর কনের বাবা বরের বড় ভাই বা ভাই সম্পর্কের পাঁচজন লোককে ঘরে আসার অনুরোধ জানায়। তবে এদের প্রত্যেককেই বর থেকে বয়সে বড় হতে হয়। অতঃপর গ্রামের মাতব্বর বা মুরব্বিরা বিয়ের নতুন কাপড় পরীক্ষা করে। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে কাপড় নেড়ে চেড়ে দোষ না ধরলে সংস্কার অনুযায়ী বিয়ে শুভ হয় না। কাপড়ে দোষ পেলে বর পক্ষকে জরিমানা বা দোষযুক্ত কাপড় অনেক সময় পাল্টেও দিতে হয়।

বিয়ের কাপড় চূড়ান্ত হলে মেয়ের মা নতুন কাপড় নিজে এবং মেয়েকে পরিয়ে দেয়। এরপর মা মেয়ের পা ধুইয়ে দেয়। পা ধুইয়ে দিলেই আগে থেকে রাখা বাঁশের ঝুড়িকে মেয়ে এসে ভক্তি দেয় এবং মেয়েকে ওই ঝুড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বরের ওই পাঁচজন বড় ভাই এসে ঝুড়ি সমেত মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কনে পক্ষ সহজেই নিতে দেয় না। শুরু হয় ধাঁধার বাধা। এই বাধার সময় ঝুড়ি মাটিতেও পড়তে পারবে না আবার দরজার সঙ্গে স্পর্শও করানো যায় না। অন্যথায় বরপক্ষকে জরিমানা দিতে হয় যা কনে পক্ষের মেয়েরা আনন্দ করে ভাগ করে নেয়।

পাঁচজন বড় ভাই অথবা কনের ভাসুর যখন ঝুড়ি উঁচু করে মারোয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন বরের ভগ্নিপতিরা বরকে কাঁধে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠাঙ্গুলি একত্র করে কৌটা থেকে তিনবার সিঁদুর তুলে কনের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিঁদুর-দান অনুষ্ঠান হয়ে গেলেই ধরে নিতে হয় তারা স্বামী-স্ত্রী। উপস্থিত সবাই তখন উলুধ্বনি দিয়ে আশীর্বাদ জানায়।

সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক