ছফার অগ্রন্থিত লেখা

নরেনদা বন্ধু আমার

Looks like you've blocked notifications!

আমি আর নরেন বিশ্বাস একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। উনি বোধ হয় বয়সে আমার চাইতে দুয়েক বছরের ছোট ছিলেন। তথাপি তাঁর মুখের দাড়ি এবং বাচনভঙ্গি দেখে আমি তাঁকে দাদা ডাকতে আরম্ভ করি। আমাদের সম্পর্ক সবসময় একরকম ছিল না। তার মধ্যে ওঠানামার পরিমাণও অল্প নয়। কিন্তু একদিনের জন্যও আমি তাঁকে নরেনদা ছাড়া আর অন্য কিছু ডাকিনি। তিনি আমাকে কখনও ‘তুমি’ ডাকতেন, কখনও ‘তুই’। লেখক হিশেবে আমার যখন একটুখানি পরিচিতি হয় অনেকেই আমাকে বলেছে, ‘তুমি কি করে এই দাড়িওয়ালা মানুষটিকে তোমাকে তুমি বলতে দাও?’

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতাম না। আমার মধ্যে একটা বাউণ্ডুলেপনা ছিল। আর আর্থিক সামর্থ্যও আমার ছিল অল্প। নরেনদা মোটামুটি গোছান স্বভাবের মানুষ ছিলেন। যদিও তাঁর স্বভাবে একটি আত্মভোলা দিক ছিল। নরেনদাকে অনেকে বলতেন, ‘এই বদমেজাজী লোকটিকে আপনি সহ্য করেন কিভাবে?’ আমার যখন থাকার জায়গা ছিল না নরেনদার রুমে আমি থেকেছি। [যখন] খাওয়ার পয়সা ছিল না তাঁর পয়সায় জগন্নাথ হলের ক্যান্টিনে খেয়েছি। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা পবিত্রতা ছিল। অনেকে এ পবিত্রতা শব্দটি শুনে হয়ত উপহাস করবেন। তথাপি আমি বলব, মানুষের সম্পর্কের মধ্যে পবিত্রতার একটি রেশ যদি না থাকে সে সম্পর্ক থেকে উৎকৃষ্ট কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।

আমরা ছিলাম ভয়ানক আড্ডাবাজ। মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দিয়ে চলে আসতাম শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ভবনটি ছিল পাবলিক লাইব্রেরী। ওখানে ছিল শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে দুপুরবেলা যেতাম স্টেডিয়ামে। কাফে নোবেলটি এ সমস্ত রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতাম। কোন কোন দিন পুরনো ঢাকার অরুণেন্দুদের বাসায় চলে যেতাম। অরুণেন্দুরা থাকত নবেন্দু বসাক লেনে। এই বাড়িটিকে ঘিরে আমার এবং নরেনদার অনেক স্মৃতি রয়েছে।

পুরনো ঢাকার তিনটি রেস্টুরেন্টে অদলবদল করে আমরা আড্ডা দিতাম। তার একটি ছিল ‘আমিনীয়া’। মালিক ছিলেন একজন অবাঙ্গালি ভদ্রলোক। আর একটি ‘সলোজা’। বংশাল রোড যেখানে নবাবপুর রোডের সঙ্গে মিশেছে সেই সংযোগ বিন্দুটিতে ছিল সলোজার অবস্থান। আমাদের সান্ধ্য আড্ডাগুলোর জন্য আমরা ‘খুশমহল’ রেস্টুরেন্টকে বেছে নিতাম। খুশমহলের উপরতলার ঘরটি আমরা গেলেই ছেড়ে দিত। ওই রেস্টুরেন্টে খোশকা নামে এক ধরনের খাবার তৈরি করা হত। খোশকা পোলাও এবং বিরিয়ানীর মাঝামাঝি এক ধরনের খাবার। আমরা খোশকা খেতে খুবই পছন্দ করতাম। ওই রেস্টুরেন্টের যে লোকটি আমাদের ফাইফরমাস খাটত তাকে আমরা মামা ডাকতাম।

আমাদের আড্ডার একটি নাম ছিল ‘নটি কর্নার’। নটি কর্নারের সদস্য ছিলেন অনেকেই। ছিলেন পবিত্র, জামাল, শংকর, শওকত আলম সিদ্দীকী, নরেনদা এবং আমি। মাঝে মাঝে অন্য বন্ধুবান্ধবরা আসতেন। এই নটি কর্নারে আমরা শিল্প সাহিত্য সিনেমা রাজনীতি নানা বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করতাম। আমাদের মধ্যে জামাল ছিলেন সবচাইতে বেশি মেধাবী ছাত্র। নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড স্ট্যান্ড করেছিল। পলিটিক্যাল সায়েন্সে বোধ করি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। সে অনেকদিন নাইজেরিয়ায় ছিল। এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। জামাল সিনেমার প্রতি দুর্বার অনুরাগ পোষণ করত। প্রথম ফিল্ম সোসাইটি করার পেছনে জামালের অবদান ছিল সবচাইতে বেশি। পরে জামাল এবং মোহাম্মদ খসরু মিলে ‘ধ্রুপদী’ পত্রিকাটি প্রকাশ করতে আরম্ভ করে।

শংকর অল্প বয়সে মারা যায়। পবিত্র তাঁতীবাজারে থাকত। ওকালতির সনদ নিয়েছিল। অনেকদিন কোন খোঁজখবর নেই। শওকত আলম সিদ্দিকী সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে। আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অন্যরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

নরেনদার সঙ্গে আমার পরিচয়ের তিনটা স্তর আছে। প্রথম স্তরের কথা বললাম। এখন দ্বিতীয় স্তরের কথা বলি। তিনি এমএ পাস করার পর গোপালগঞ্জের রামদিয়া কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন, সেখান থেকে যান মাদারীপুর নাজিমুদ্দীন কলেজে। আমি দুতিন বছর নষ্ট করে পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছি। কিছুদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা আসার পর আমার কয়েকটি বই বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত হয়। এ সময় নরেনদা একবার ঢাকায় এলেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করলেন।

সে সময়ে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত এবং আমি- আরো কতিপয় ব্যক্তি মিলে- ‘স্বদেশ’ নামাঙ্কিত একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকি। বাংলাবাজারের কালিকলম প্রকাশনার মালিক আবদুল আলিম এ পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করতেন। আলিম ভাই ছিলেন অকৃতদার এবং পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। নরেনদার সঙ্গে আলিম ভাইয়ের খুব গভীর সম্পর্ক হয়। আলিম ভাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির গোঁড়া সমর্থক। মূলত আলিম ভাইয়ের প্রেরণায় নরেনদা ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদারে’র বাংলা নাট্যরূপ দিতে আগ্রহী হন। পরবর্তীকালে নরেনদা যে অভিধান সংকলন করলেন তার পেছনেও আলিম ভাইয়ের কিছু অনুপ্রেরণা অবশ্যই কাজ করেছে।

মাদারীপুরে শিক্ষকতা করার সময় অঞ্জলীর সাথে নরেনদার পরিচয় হয়। অঞ্জলী নরেনদার ছাত্রী। অঞ্জলীর বাবা ছিলেন দ্বারিক বাবুরী। ভদ্রলোক পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। নরেনদা এ ভদ্রলোককে বিশেষ একটা পছন্দ করতেন না। তারপরও এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে নরেনদার সঙ্গে অঞ্জলীর বিয়েটা হল। এর পেছনে আমার সামান্য একটা হাত আছে। নরেনদার মরদেহ যখন পিজি থেকে বাড়িতে নেয়া হয়েছে খবর শুনে আমি দেখতে গেলাম। মেঝেতে শায়িত নরেনদার নিথর মুখমণ্ডল দেখার পর অঞ্জলী ও ছেলেমেয়েদের খবর নিতে ভেতরে গেলাম। আমাকে দেখা মাত্রই অঞ্জলী হু হু করে কেঁদে উঠে বললেন, ‘ভাই, আপনি তার সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এখন সে তো আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আমি কি করব?’

সেসব কথা থাকুক। নরেনদার সঙ্গে সম্পর্কের তৃতীয় স্তরটি সম্পর্কে বলি। ১৯৭১ সালে জুন মাসে আমি যেদিন আগরতলা থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে কলকাতা নামি, এয়ারলাইন্সের বাসই অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে আমাকে বৌবাজারের কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় নামিয়ে দেয়। আমি আগে কখনও কলকাতা শহরে যাইনি। মৈত্রেয়ী দেবী এবং আমার পত্রবান্ধবী অর্চনা চৌধুরী ছাড়া অন্য কোন লোককে আমি চিনি না। কোথায় যাব? কি করব? ভয়ঙ্কর হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরকম হতবিহ্বল পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে পিনাকীর দেখা। এখন পিনাকী ঢাকা শহরের নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এই পিনাকীই আমাকে পথ দেখিয়ে বৌবাজারের উদয়ন ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়েছিল। ওটা ছিল তপসিলী ছাত্রদের হোস্টেল, নরেনদার দুই ভাই সেখানে থাকত। তাদের সঙ্গে আমিও থাকতে আরম্ভ করলাম। আমার যাওয়ার পরে আরো অনেকে উদয়ন ছাত্রাবাসে থাকতে আসে। তার মধ্যে নাট্যকার মামুনুর রশীদও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত সময়টিতে আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি।

দেশে ফেরার পর নরেনদা আবার নাজিমুদ্দীন কলেজে যোগ দেন। সেখানে তাঁর পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রক্ষীবাহিনীরা তাঁকে গ্রেফতার করে। ভয়ঙ্কর রকম নির্যাতন করে। সে সময়টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন ড. আহমদ শরীফ। নরেনদা [একসময়] ড. আহমদ শরীফের ‘স্বদেশ অন্বেষা’ নামে প্রবন্ধের বইয়ের উৎকৃষ্ট সমালোচনা প্রকাশ করেন। কোন পত্রিকায় লেখাটি প্রথম বেরিয়েছিল এখন নাম মনে পড়ছে না। নরেনদার সমালোচনাটি পাঠ করে ড. আহমদ শরীফ খুবই সন্তুষ্ট হন। সে সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল। শরীফ স্যার নরেনদাকে দরখাস্ত করতে বলেন এবং তাঁরই আগ্রহাতিশয্যে নরেনদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিশাবে নিয়োগপত্র লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর নরেনদা সম্পূর্ণভাবে নিজের জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্র ছকিয়ে নেন। এখানে যে সকল সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তপ্ত বিতর্ক জন্ম নিচ্ছিল সেগুলো থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে থাকার সংকল্প গ্রহণ করেন। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না তাঁর ভাইয়েরা সকলেই কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত। নরেনদা একাই বাংলাদেশে থাকতেন। ভাইদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর একটা চাপ এবং দাবি থাকা খুবই সম্ভব। বোধ করি তারা চাইতেন নরেনদা কলকাতা চলে আসেন। কিন্তু তিনি সেটা করতে রাজি ছিলেন না। এখানে দীর্ঘকাল [অনুত্তপ্ত] মস্তিষ্কে কাজ করার একটি ক্ষেত্র তিনি বাছাই করে নিয়েছিলেন। কলেজে থাকার সময়েই তাঁর বই ‘অলঙ্কার অন্বেষা’ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর তিনি অভিধান রচনায় মনেপ্রাণে আত্মনিয়োগ করেন। আবৃত্তিটি তাঁর এক সময়ে অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবৃত্তি নিয়েই সকাল-সন্ধ্যা মেতে থাকতেন। এই আবৃত্তির জন্যই তিনি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন।

গত ৮/১০ বছর নরেনদার সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। সংসার জটিল জায়গা। জীবন ও জীবিকা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মাত্র একমাস আগে আমার বন্ধু অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ও আবু জাফরের কাছ থেকে এই ভয়াবহ অসুখটির কথা আমি জানতে পারি। নরেনদা তো মারাই গেলেন। নরেনদার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হচ্ছে আমার জীবন থেকে যৌবনের দিনগুলো খসে পড়ে গেল। বন্ধুর বিয়োগ ব্যথা কি বস্তু তা যে বন্ধু হারায়নি তার বোঝার কথা নয়। যখন আমি একা থাকি, নরেনদার কথা মনে হলেই চোখের কোণে পানি জমা হতে থাকে।

(রচনাটি প্রথম প্রকাশ পায় বাংলাবাজার পত্রিকা, ২ ডিসেম্বর ১৯৯৮, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪০৫ সংখ্যায়, এটি এখনো কোনো গ্রন্থে স্থান পায়নি।রচনায় লেখকের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)