সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
চৈত মাইস্যা বিয়ান বেলা। তখনো বেইল ততো চড়ে নাই ঠিকই, কিন্তু চড়তে কতখোন! এই ভাবনা মাথায় নিয়া দেওভোগ গেরামের কোনো কোনো বাড়ির পুরুষপোলারা অন্য অন্য দিনের মতোন সেই দিনও তাগো বিষয়-কর্মে বাইর হইয়া গেছে গা—সেই কোন আগে!
তবে কোনো কোনো ঘরের বেটারা তখনো বাড়িতেই। সেই সেই বাড়ির মাতারিগো হাতে তখন দুনিয়ার কাম। ঘরের পুরুষপোলারা তামানটা দিনের লেইগা কামে বাইর হইয়া যাইতাছে, তাগো পাতে ভালা-বুরা নায়—নাস্তাটুকই যুদি না দেওন যায়, তাইলে আর মাতারিগো সংসারে থাইক্কা কোন কাম! সেই ঠেকার চাপ নিয়া সেই সেই বাড়ির মাতারিরা তখন দুনিয়ার হুড়াহুড়িতে।
যাগো যাগো বাড়ির বেটারা কামে মেলা দিয়া দিছে; সেই সকল বাড়ির মাতারিগো তখন হাত-পাও ঝাড়া। ঘরের বেটাগো বিদায় দেওনের হুজ্জাত তাগো শেষ। নিজেগো বা পোলাপাইনের সকালের নাস্তা নিয়া কোনোরকম বেচইন হওনের কিছু নাই। সেইটা নিত্যিই সারা হয় রয়-সয় কইরা। সেই দিনও সেইকাম অন্যদিনের মতোন দেরিতেই করোনের বাঞ্ছা তাগো।
এই কিনা চুলা ধরানি, নাস্তা-পানি বানানির ধুম তুফান সারছে তারা! ঘরের বেটারা সয়-সোন্দর হালে কামে গেছে গা! অখন আলা নিজেগো আজাইর পাওয়া হাত-পাও নিয়া এট্টু জিরাইয়া তো লউক মাতারিরা!
দেওভোগের সকল ঘরে নিত্যিকার কর্ম নিয়া সকলে যখন আছে নিত্যির মতোন; এমুন সোমে সগলতে হোনে, কেয় জানি চিক্কুর পাড়ে!
কেটায় এমুন চিক্কুর দেয়!
একবার মোনে হয় চিক্কুর। একবার মোনে হয় বিলাপ!
মোনে হইতে থাকে যে, কেটায় জানি বিলাপের করতাছে! জোর বিলাপের আওয়াজ আইতাছে কোনদিগ তেনে জানি!
এমুন বিয়ান বিয়ান কার আবার কোন অনিষ্টি লাগলো! ঘরে ঘরে সগলতে এই কথাটা খালি মোনে আইন্নাও সারে না, তার মিদেই সগলতে শোনে মংলার মায়ে ধুউচ্চা ডাক পাড়তাছে।
দেওভোগের সব মাইনষেরে ডাক পাড়ে ক্যান সেয়!
গেরামের কোনোজনে নি তখন ঘরে তিষ্টাইতে পারে! যেয় যেমনে পারে সেই ডাকের হুমুইর দিয়া আগ্গাইতে আগ্গাইতে শোনে—কী এক আচানক কথা কইতাছে মংলার মায়ে!
শোনো শোনো! কী আচুইক্কা কথা কয় অই মাতারি!
কয় যে, জুলেখারে বোলে পাওয়া গেছে!
জুলেখারে পাওয়া গেছে!
চক্ষের পলকে দেওভোগ গেরামের সগলতে আইয়া খাড়ায় জুলেখাগো বাড়ির উঠানে।
খোদা খোদা! আল্লা মাবুদ আল্লা মাবুদ! এইটা কী দেখতাছে সগলতে!
অই ত্তো দেহা যায় জুলেখাগো রান্ধন ঘরের সামোনের উঠানটুকে কে জানি লেট দিয়া বওয়া। মোখ তার আধা-নিচা করা। ছিঁড়ার হদ্দ ছিঁড়া, রং-জ্বলা একখান তেনা দিয়া কোনোমতে বেড় দেওয়া আছে তার অঙ্গ। অই মোখখান কার?
গেরামের মা-চাচিরা পষ্ট দেখতাছে, অইখান জুলেখার মোখ! অই ত্তো জুলেখায়!
মুরুব্বি যেই কয়জোন বেটা আইয়া উঠানে খাড়া হইছে—হেরাও দেখে; অই ত্তো! আসোলেই ত্তো জুলেখারে দেখা যাইতাছে অগো উঠানে বহা!
পাঁচ বচ্ছর আগের সেই পোলাপাইন ঢকের, সেই কড়া পাটপাতা রকমের নরম আর নাই অই মোখটা।
বাত্তি হইছে মাইয়ার মোখখানে। তয়, বাত্তি হইয়া সেই মোখ হইছে আরো বাহারের। আরো ঢক্কের।
সেই মোখে অই ত্তো দেখা যাইতাছে মিডা কুমড়ার ফুলের লাহান হইলদা ঝলক। পিন্ধনের ছিঁড়া তেনাটারে লাগতাছে য্যান বউন্না ঝোপ। মোখখান য্যান সেই ঝোপ্পের উপরে ফুইট্টা থাকা হইলদা ফুল! বউন্না মিডা-কুমড়ার ফুলখান।
মাগ্গো মা! এইটা কী দেখতাছে তারা! এতো ঢক নি মাইনষের মোখে দেখছে কেউ কোনোকালে!
সেই মোখের দিগে চাইয়া থাকতে থাকতে একেক জোনের শইল্লে ক্যান জানি কাঁটা দিয়া উঠতে থাকে আঁতকা আঁতকা। হুদামিছাই কাঁটা দিয়া ওটতে থাকে।
কিন্তুক জুলেখার মায় এমনে মাইয়াটারে ঘরের বাইরে বহাইয়া থুইছে কোন কারোনে! আর, সেয় নিজেও বা কী বুঝে মাইয়ার লগে উঠানে বহা দিয়া আছে!
‘কী গো জুলেখার মা? এইটা কি কিরতি তর?’ ইসুফ মিয়ার মায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে জিগায়।
অন্যরা ধুছমুছ কইরা কোন আগে আইয়া জুলেখাগো বাড়িতে হাজির হইয়া গেলেও, ইসুফ মিয়ার মায় এইনে আওনের ফাঁকখান পাইছে এইমাত্র। হাতে তার এমুনই বেজুইতের কাম আছিলো যে, সেই কামেরে কোনো প্রকারেই ফালাইয়া থুইয়া আওন যায় না। বিয়াইন্না বেইলে, বাড়ির গাই দোয়ানির কাম খালি তখন শুরু হইছে; সেইসোম কি না ইসুফ মিয়ার মায়ে শোনে যে, মংলার মায়ে চিক্কুর দিতাছে!
চাইর চাইরখান গরুর দুধ দোয়ান্তিতে তক্ষণ খালি হাত লাগাইছে মুনিশ চাইরটায়। ছেড়াটির কাম করে ঠিক, তয় সেই কাইম-কাইজের কোনো ঢক-পদ নাই। চক্ষে চশম বলতে নাই একটারও। পরানে ডর-শরম বলতে নাই কোনোটার। সেই গিলির হাতে এতাটি দুধের দায় কেমনে দেয় ইসুফ মিয়ার মায়ে! পিছা-মারারা না দুধটি খাইয়া শেষ কইরা থুইবো! অর্ধেক দুধ না অগো পেটে যাইবো গা!
অদিগে, অমুন একটা চিক্কাইররে হালকা কইরা কোন পরানে নিবো ইসুফ মিয়ার মায়ে! তার তো তগ-নগদ যাওয়ার কাম জুলেখাগো বাইত! দুধের দায় এখন কারে দেয় সেয়! এই নিয়া কতখোন ছইট্টাইতে ছইট্টাইতে শেষে তার মোনে আহে যে, আরে! ইসুফ মিয়ার বউয়ে তো আইয়া এট্টু বইতে পারে দরজাটার সামোনে!
অইতে পারে বউটায় বেমারির বেমারি; কিন্তুক এট্টুখোনের লেইগা দুধ পাহারা দেওনের কামখান করতে পারবো অই বেমারিয়ে!
এতো সকল বয়-বন্দোবস্ত কইরা, তয় ইসুফ মিয়ার মায় মেলা দিতে পারছে জুলেখাগো বাড়ির দিগে। তাইলে তার দেরি না হয় কেমনে!
কিন্তু আইয়া এইটা সেয় কোন কিরতি হইতে দেখতাছে! গেরামের দশ জোনে তো ঘেরাও দিয়া থুইছে জুলেখাগো মায়রে-ঝিয়েরে; আরেকদিগে মায়ে-ঝিয়ে মাটিত বহা দিয়া রইছে য্যান ঠাটার মরা! দেখছ নি তামশাটা! কী গো জুলেখার মা?
‘তর মাইয়ারে এমনে দুয়ারে ফালাইয়া রাখবি? কী গো?’
মাইয়ার লগে মাটিতে লেটকান দিয়া বইয়া এতখোন জুলেখার মায়ে চিপ্পাচিপ্পা কাইন্দা জারেজার হইতাছিল। ইসুফ মিয়ার মায়রে দেইক্ষা এইবার সেয় হাইরে-মাইরে চিক্কুর পাড়া ধরে।
ক্যান কান্দে সেয়!
কান্দে, ভরসা করোনের আসল মানুষটারে কাছে পাইয়া। বড়ো বেদিশা হইয়া আছিলো এত খোন জুলেখার মায়।
এতখোন দশ জোনে দশ মোখে দশ কথা কইয়া তার মাথা আউলা কইরা দিতাছিল। এয় কয় এই করো। অয় কয়—অইটা খবরদার কইরো না!
মাইয়ায় যে তার ফিরতি আইছে, সেইটা হইছে আল্লাপাকের কুদরতির গুণে! শুক্কুর তোমার দরবারে মাবুদ!
কিন্তু কেমনে কোনখান তেনে সেই মাইয়া বাড়ির রাস্তায় আইলো, সেইটা তো মায়ের জানোনের কাম। কী হইছিলো এই সোনার পরতিমার, কেমনে কী হইছিল—এই কথাকয়টা জিগানের লেইগা মায়ের পরান ফাইট্টা যাইতে থাকে। কিন্তু এত্তা মাইনষের সামোনে এই ভেদের কথা জিগায়—তেমন তেজি কইলজা নাইক্কা মায়ের ভিতরে!
মাইয়ায় তো মায়ের কান্ধে ভর দিয়া দিয়া কোনোমতে বাড়ির উঠানে আইসা পাড়া দিল। কিন্তু তাতেই কী জুলেখার মায়ের কপালের গরদিশ দূর হইলো! কিছুই দূর হইলো না। মাইয়ায় আইয়া করলো কী, রান্ধন ঘরের সামোনে যে চিলতা উঠানটুক; সেইনে থপ কইরা বইয়া পড়ল।
অম্মা! এইটা কী! ঘরে ল! এইনে বইলি ক্যান রে সোনা! মায় জুলেখারে কয়। কিন্তু মাইয়ায় নেক-বদ কিছুই কয় না! কোনো সাড়া ইস্তক দেয় না। মোখ হেঁট কইরা সেই যে বওয়া দিলো তো দিলোই। তার বাদে মায় যতোই কিনা মাইয়ারে নিছে-পোছে, যতোই কিনা ঘরের ভিতরে যাইতে ঠেলে—মাইয়ায় গেরাজ্জিই করে না। সেয় য্যান এই দুনিয়ায় নাই!
ততখোনে মংলার মায়ের চিক্কুইর শুইন্না গেরামের সগলতে লৌড়ালৌড়ি কইরা আইয়া খাড়া জুলেখাগো উঠানে। তাগো সম্মুখে মাইয়ারে না কিছু জিগানের উপায় আছে জুলেখার মায়ের, না তারে ঘরে নেওনের লেইগা ঠেলোনের উপায় আছে!
তাও জুলেখার মায়ে মতে মতে আলগোচ্ছে মাইয়ারে ঠেলতাছিলো ঘরে যাওনের লেইগা। কিন্তু দশ জোনের দশপদের কথার ধাক্কায় তার মাথায় এমুন তালাগারা দিতে থাকে যে, সেয় য্যান আধা বেহুঁশ হইয়া যায়। এতো জোনের এতো কথার ঠেলা-ধাক্কার মধ্যেও যে জুলেখার মায় নিয়া মাইয়ারে ঘরে নেওনের একটা বেবস্থা নিবো, তার কোনো উপায় দেখে নাই সেয়।
একটা মাইনষেও তারে সায় দিতাছিলো না! অমুকে কয় আগে ঝাড়-ফুঁক দেওয়াইয়া লও। তার বাদে ঘরে তোলো। তমুকে কয়, অই কামও কইরো না! অমুনটা করলে কইলাম আরো অনিষ্টির তলে পড়বা! খবরদার!
এতো হাউ-কাউ কতো মাথায় নেওন যায়! কতোই বা সওন যায়! দিশা-বিশা না পাইয়া মংলার মায়ে লৌড় দিছে ইমাম হুজুরের কাছে। আহুক হেয়! সেয় আইসাই বিধি-বেবস্থা যা দেওনের দেউক। সেয় যা করতে কইবো, সেই মতো করবো জুলেখার মায়ে।
ইমাম হুজুরে জুলেখাগো উঠানে ঢুইক্কা দেখে, আরে খাইছে রে! পুরা গেরামের সগল মাইনষে দেহো জুলেখা গো উঠানে!
সেয় তক্ষণ তক্ষণ হাতজোড় কইরা গেরামের বেটা-মাতারি সগলজোনের কাছে মিন্নতি কইরা কয়, বাবাসগলেরা! অগো মা সগল! আপনেগো দোহাই লাগে! উঠানটারে এট্টু নিরালা করেন। এই যে এমুন আঁতকা আমাগো মাইয়ায় ফিরতি আইছে—বিষয়খান ভালা কী বুরা—আমারে বোজতে দেন গো ! নাইলে কইলাম কার গরদিশ শেষ-কাটালে কার উপরে যাইবো—কেউ কইতে পারে না! আমারে কিন্তুক দোষতে পারবেন না গো লক্ষ্মীরা!
হুজুরের কথা শেষও হয় না, জুলেখা গো উঠান তেনে লোকে ধুছমুছ পাওয়ে নিজেগো বাড়ির দিগে হাঁটা ধরে। হুজুরে ভাইঙ্গা না কইলে কী, লোকে ঠিকই ধরতে পারে—বিষয়খান সুবিধার না! এইর পিছে অশৈলী বানবাতাসের কোনো না কোনো কেরামতি আছে!
(চলবে)