গল্প পড়ার গল্প
রক্তমাংসের ইতিহাস জানতেন সমরেশ বসু

সমরেশ বসু ছিলেন আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে, গত শতাব্দীর সেই ষাট-সত্তর দশকে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক লেখক চরিত্র। আমরা যখন সাহিত্যে অনুরক্ত হয়ে উঠছি, সেই ষাটের দশকের শেষের দিকে, তিনি ‘উত্তরঙ্গ’, ‘বিটি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফের পর্ব’ পার হয়ে এসে পরপর লিখেছেন ‘বিবর’, ‘পাতক’, ‘প্রজাপতি’। অসম সাহসী লেখক। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কার্ডহোল্ডার। উঠেছেন সেই খোলার চাল থেকে রাজপ্রাসাদে। কত কথা তাঁকে নিয়ে। প্রথম উপন্যাস উত্তরঙ্গ যখন বের হয়, তিনি কলে কাজ করেন বা ডিম ফেরি করে বেড়ান। একের পর এক আশ্চর্য উপন্যাস আর গল্প লিখে সমরেশ বসু আমাদের মোহিত করে রেখেছিলেন আমৃত্যু। তাঁকে প্রথম দেখেছি ১৯৭৫ নাগাদ নৈহাটির এক সাহিত্য সভায়। দেখে বিস্ময়ে দেখেই ছিলাম শুধু, কোনো কথা বলতে পারিনি। পরে সমরেশ বসুর সঙ্গে এই সামান্য মানুষের পরিচয় ঘটেছে।
মহানগর নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি কিছুদিন। সেই পত্রিকায় আমি একটি গল্প দিয়েছিলাম। এক গ্রীষ্মের দুপুরে গিয়েছি সেই গল্পের খোঁজ করতে, শুনলাম তিনি মিটিংয়ে, বসতে হবে। মিটিং শেষ না হলে কিছুই জানা যাবে না। আমি একটি স্লিপ লিখে রিসেপশনে দিয়ে অপেক্ষা করছি। রিসেপশন থেকে বলল, এক-দেড় ঘণ্টা লাগবে। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না, মিটিংয়ের দরজা খুলে গেল, বেরিয়ে এসেছেন সমরেশ, আমার রূপকথার রাজপুত্র। ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, সহাস্য মুখে তিনি এগিয়ে আসছেন, আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই তিনি বসে পড়েছেন আমার পাশে, বললেন, ‘গল্পটি আমার ভালো লেগেছে, পরের সংখ্যায় যাবে, পুজোর জন্য একটি গল্প দেবেন?’
এরপর যতবার মুখোমুখি হয়েছি, তাঁর স্নেহময় কণ্ঠস্বর শুনেছি। বহুরাত অবধি তাঁর কাছে শুনেছি ‘দেখি নাই ফিরে’ লেখার পরিকল্পনার কথা। মনে পড়ে সেই সিল্কের পাঞ্জাবি ধুতি, শুয়ে আছেন তিনি চিরনিদ্রায়। বসে আছি পায়ের কাছে। তিনি কলকাতা থেকে চলেছেন নৈহাটি। সমরেশ ছিলেন একই সঙ্গে মেধা আর অভিজ্ঞতার মিশেলে এক অনন্য লেখক। তাঁর কত গল্প যে আমাকে জীবন চিনিয়েছে, সেই স্বীকারোক্তি, পাড়ি, অকালবৃষ্টি, অকালবসন্ত, উরাতীয়া, পাপ পুণ্য, শানা বাউরির কথকথা, আইন নেই, শেষ হাসি, হাজরা রোড ঝাপসা—গল্পের তালিকা বেড়েই যাবে। স্মৃতিতে যে কত আছে। আমি তাঁর উরাতীয়া গল্পটির কথা বলি। সমরেশের মেধা, এই মনুষ্যজীবনকে উপলব্ধি করার অসামান্য ক্ষমতা, মানুষের ইতিহাসের নিকট নতজানু হওয়া তাঁকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিয়েছিল। সেই ব্যতিক্রমী সমরেশকে দেখতে পাই তাঁর ‘পাড়ি’, ‘পাপ পুণ্য’, ‘উরাতীয়া’ আরো কত গল্পে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁর গল্পকে এক অপার্থিব মাত্রায় পৌঁছে দিত। ‘উরাতীয়া’ গল্পটিতে দুই দেহসর্বস্ব পুরুষ ধামারি আর লাখপতির গল্প। তারা দুই গেটম্যান একটি লেভেল ক্রসিং পাহারা দিত। ট্রেন সমস্ত দিনে আর কয়টি, বাকি সময় তারা দেহচর্চা করত। যখন বেলা পড়ে আসত, সমস্ত দিনে রোদে পোড়া আকাশে লাগত রঙের ছটা, জনহীন হয়ে যেত সবদিক, তখন রেললাইনের ধারের উঁচু জমিটায় এসে দাঁড়াত দানবের মতো দুই পুরুষ। দুই মল্লবীর শুরু করত যুদ্ধ। উঁচু জমিটা যেন কাঁপত তাদের পায়ের ভারে। আকাশের গায়ে ছিটকে যেত ধুলো মাটি। এক প্রাগৈতিহাসিক দৃশ্যের জন্ম হতো যেন সেই সময়। তারা প্রতিদিন বিকেলেই মল্লযুদ্ধে নামত।
গেটম্যানের ডিউটি ছাড়া তাদের বাকি সময় কাটত নিজের নিজের দেহ দুটি নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তৈল মর্দন, সকালে বহু সময় ধরে বুকডন তাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তে আনত পাগলামি। উত্তেজনায় চোখ লাল। গাঁয়ের মানুষ, পথ চলতি গাড়ির গাড়োয়ানরা তাদের বলত, ‘পবন পো’। পবনপুত্র বীর হনুমান। তারা ছিল বীর হনুমান ও ভীমের ভক্ত। মল্লযুদ্ধের শেষে এক এক বালতি কাঁচা গো-দুগ্ধ পান করে রাত্রে তারা ভীম আর বীর হনুমানের কথা নিয়ে আলাপ করে। বিশ্বাস করে মহাবীর হনুমান তাদের ওপর দৃষ্টি রাখে। দেহ, দেহ, দেহই সব। একদিন সময় কাটানোর ছলে যে দেহকে নির্মাণ করা শুরু, তা এখন নেশা। দেহের ভেতরে বন্দি হয়ে গেছে আর সব বাসনা। তারা যেন টের পায় তাদের ওই অসীম শক্তি আর বিশাল দেহের ভেতরে আটকে গেছে কী যেন। খাঁচায় পোড়া পাখির মতো সে ছটফট করে মুক্তির জন্য।
এমন সময় একদিন লাখপতি চামারিয়ার নামে একটি চিঠি এলো। ছয় মাস ঘুরে ঘুরে এসেছে সেই চিঠি। চিঠি দিয়েছে তার বিধবা খুড়ি। সে এবার মরবে। আশা করে যে লাখপতি এত দিনে গুছিয়ে নিয়েছে। সে যেন তার বউকে এবার নিয়ে যায়। জোয়ান আউরত, খর নদীর নৌকা, মাঝি হাল না ধরলে তরী যাবে। বউ। আউরত! সেই কবে বিয়ে দিয়েছিল বাপ-মা একটি শিশুর সঙ্গে। তারপর গাওনা হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। সে ভুলেই গেছে তাকে। খুড়ির কাছে তাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিল তার বাপ-মা। এত দিনে সে জোয়ান, লাখপতি গেল। নিয়ে এলো। লাখপতি আর ধামারি অবাক। এই জীবনে কোনো আউরতকে তারা এই ভাবে এত কাছ থেকে দ্যাখেনি।
লাখপতি আরেক মল্ল ধামারিকে ডাকে, চল আউরত দেখি। নিজের আউরতকে যে নিয়ে এলো সে, দ্যাখেনি। দুজনে একসঙ্গে দেখবে। হাত ধরে ঘরে ঢুকল তারা। ঘরে উরাতীয়া অবগুণ্ঠনবতী হয়ে বসেছিল। উরাতীয়া ঘোমটা তুলে ধীরে ধীরে তার কালো চোখ দিয়ে দেখল দুজনকে। হাসল। চোখে-মুখে বিদ্যুৎ চমকাল যেন মিঠে হাসির। বিস্মিত দুই মল্ল পুরুষ মুখ চাইল পরস্পরে। তারপর হেসে উঠল উচ্চরোলে। উরাতীয়া সেই হাসিতে যোগ দিল, নূপুর নিক্বণের মতো খিলখিল সেই হাসি। উরাতীয়া এতকাল ক্রীতদাসীর মতো ছিল খুড়িশাশুড়ির ঘরে। এখানে এসে তার ২৬ বছরের তৃষ্ণার্ত যৌবন ভাসল। প্লাবিত হলো। সে লাখপতির বউ। লাখপতি তার ষোলআনা। তার যৌবনের দেবতা। ঘামারি হলো তার সহচর। ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য, সুখ ও দুঃখ। ঘামারি এককালে বিয়ে করেছিল। তার বউ মরেছিল। তা উরাতীয়া খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানল। জানল লাখপতি এতকাল পরে। তারা যখন মল্লভূমিতে নামে বিকেলে, উরাতীয়া বসে অবাক হয়ে দ্যাখে দুই মল্লের যুদ্ধ। দুজনে যেন উরাতীয়ার হৃদয়ের দুই জানালা। দুই পুরুষের জীবন বদলে গেল। দুজনে কত রকম অঙ্গভঙ্গি করে উরাতীয়াকে খুশি করতে চায়। এক নারী, দুই পুরুষে এমন হয়। কিন্তু যা ছিল সরল, যা ছিল স্বাভাবিক, তার ভেতরে প্রবেশ করে এক ভয়ংকর বিষধর। এই বিষধর লুকিয়ে ছিল তাদের রক্তে। এইটাই ঘটে, ঘটে থাকে চিরকাল। যা ঘটে না, ঘটতে পারে না, তাই ঘটাতে চেয়েছিল উরাতীয়া।
দুই পুরুষকে দুইভাবে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। তা হয় কী করে? দুজনের ভেতরে জেগে উঠেছে দখলের প্রবৃত্তি। বিকেলে মল্লভূমিতে তারা ভীষণ আক্রোশে পরস্পরের দিকে রুখে যায়। উরাতীয়াকে যখন রাতে সোহাগ করে তার স্বামী লাখপতি, তার ভেতরেও জেগে উঠতে থাকে বুঝি ভয়ংকর এক প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা। একটি নারীকে নিয়ে দুই পুরুষের ভেতর যেন প্রাগৈতিহাসিক জীবনের আবির্ভাব হয়। এর শেষ হয় উরাতীয়ার এক ভয়ানক মৃত্যুতে। দুজনে এমন লড়াই শুরু করেছিল, যেন তাদের কেউ একজন মরবে। রাত হয়েছিল। উরাতীয়া চলে গিয়েছিল লাইনের ওপর। ফেরার কোনো উপায় ছিল না। সমরেশ মানুষ মানুষীর জীবনের সঙ্গে আদিম জীবনের পরম্পরা খুঁজেছেন সমস্তজীবন ধরে। ‘পাড়ি’, ‘পাপপুণ্য’ থেকে উরাতীয়া—সব যেন একাকার হয়ে যায় আমার কাছে। ‘পাড়ি’ গল্প শেষ হয় এক অপরূপতায়। শুয়োরগুলিকে উত্তাল গঙ্গা পার করিয়ে এনে নারী পুরুষ খানা বানায়, তারপর মিলনে যায়। এ হলো মানুষের জীবনের অপার সৌন্দর্যের বিবরণ। উরাতীয়া সেই সৌন্দয ধ্বংসের কাহিনী। দুই পরম্পরাতেই আমাদের উত্তরাধিকার। সমরেশ আদিমতার, জৈবিকতার এই পরম্পরাকে তাঁর কত গল্প-উপন্যাসে যে ধরেছেন। রক্তমাংসের ইতিহাস তাঁর জানা ছিল। সেই ইতিহাসকে আমরা পাঠ করেছি বারবার। রক্তমাংসের ইতিহাসের ভেতরেই মানুষের ইতিহাস।