কুরোসাওয়া কথা
লাল ইটের দীর্ঘ এক দেয়াল
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/06/22/photo-1498124908.jpg)
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
মিডল স্কুলে নিজের স্মৃতিগুলোর কথা লিখতে গিয়ে, অস্ত্রাগারটিকে ঘিরে রাখা ইটের দেয়ালটির কথা এড়িয়ে যেতে পারব না। আমার প্রতিদিন স্কুলে হেঁটে আসা-যাওয়ার পথেই পড়ত এ দেয়াল। প্রথমদিকে আমি অবশ্য হেঁটে যাইনি। কোইশিকাওয়া গোকেঞ্চোতে অবস্থিত আমাদের বাড়িটির কাছেই, ওমাগারি বাসস্টপ থেকে একটি স্ট্রিটকারে উঠে বসতাম। ইদাবাশি স্টেশনে পৌঁছে ওঠতাম হঙ্গো মোতামাচিগামী ট্রামটিতে; আর তারপর সেখান থেকে হেঁটে যেতাম। তবে এভাবে আসা-যাওয়া করেছি মাত্র বারকয়েকই। স্ট্রিটকারে আমার সঙ্গে একেবারেই আজব এক কাণ্ড ঘটেছিল; সেই ঘটনার পর এটিতে আর কখনোই চড়তে পছন্দ করিনি আমি। যদিও তা ছিল আমার নিজেরই ভুল, তবু আতঙ্ক কাটেনি।
সকাল বেলা ট্রামটি সবসময়ই কাণায় কাণায় পূর্ণ থাকত। দরজায় সবসময়ই ঝুলে থাকত অসংখ্য মানুষ, আর কনডাক্টর সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে, বিপজ্জনকভাবে ঝুলে ঝুলে কারটির অন্যপ্রান্তে পৌঁছুতেন। একদিন ওমাগারি থেকে ইদাবাশি যাওয়ার পথে আমিও এভাবেই ঝুলে ছিলাম; আচমকা মনে হলো, জীবনের সবকিছুই অর্থহীন, একঘেয়ে ও বৃথা। ফলে হাত ছেড়ে দিলাম আমি!
কারটির বাইরের দিকে ঝুলে থাকা দুজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মাঝখানে পড়ে গেলাম আমি। যদি তাদের মাঝখানে আটকে না যেতাম, নিশ্চিতভাবেই নিচে পড়ে যেতাম আমি। এমনকি রানিং বোর্ডে যদিও আমার একটি পা ছিল, তবু পড়ে যাচ্ছিলাম নিচে।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র দুজনের একজন চিৎকার করে উঠে, নিজের এক হাত দিয়ে আমার কাঁধে ঝুলে থাকা স্কুলব্যাগটি আঁকড়ে ধরে আমাকে বাঁচালেন। ইদাবাশি পৌঁছানো পর্যন্ত বাকিটা পথ আমি এভাবেই, সেই ছাত্রটির হাতের ভেতর, ডাঙ্গায় উঠে যাওয়া কোনো মাছের মতো প্রাণ নিয়ে কাটালাম। এভাবে ঝুলে থাকতে থাকতে, পুরোটা পথে আমি এই পাংশুটে, আতঙ্কগ্রস্ত তরুণটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অবশেষে আমরা যখন ইদাবাশি পৌঁছলাম, এবং ট্রাম থেকে নামলাম, তখন এই দুই ছাত্র হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছিল তোমার?’ যেহেতু আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না, আমার কী হয়েছিল, ফলে স্রেফ ঝটপট মাথা নাড়িয়ে, বাসস্টপের দিকে এগিয়ে গেলাম আমার পরবর্তী স্ট্রিটকারটি ধরব বলে। ‘তুমি ঠিক আছ তো?’ –তবু তাঁরা নাছোড়বান্দা; এবং পিছু নিলেন আমার। আমি এক দৌড়ে, ওচানোমিজুগামী ট্রামটিতে লাফিয়ে উঠে পড়লাম—ঠিক যখনই সেটি চলতে শুরু করল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, স্তম্ভিত হয়ে ছাত্র দুজন আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি নিজেকে হতবুদ্ধিকর অবস্থায় ফেলতে পারি না!
এ ঘটনার পর স্ট্রিটকার এড়িয়ে চলেছি আমি। তা ছাড়া, সেই প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলোতেই তো আমি ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুলে আসা-যাওয়ার কারণে সুদীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটতে অভ্যস্ত। আর যদি স্ট্রিটকারের ভাড়ার টাকা বাঁচাতে পারি, তাহলে নিজের মধ্যে সদ্য জেগে ওঠা নতুন অভ্যাসটির পেছনে ব্যয় করার তৃপ্তি নিতে পারব : অর্থাৎ, বই কিনতে পারব আমি।
সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে, এদোগাওয়া নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ইদাবাশি ব্রিজের নিচে গিয়ে পৌঁছতাম। সেখান থেকে ট্রামের আসা-যাওয়ার রাস্তাটিতে ওঠতাম এবং ডানদিকে মোড় নিতাম। খানিক দূর এগিয়ে, তারপর বামে মোড় নিলেই পড়ত অস্ত্রাগারের সেই সুদীর্ঘ লাল-ইটের দেয়ালটি। মনে হতো, এ দেয়ালের যেন শেষ নেই। কাউন্ট মিতোর টোকিও ম্যানশনের বাগান— কোরাকুয়েনে এসে দেয়ালটির বিঘ্ন ঘটত। তারপর সেটি ধরে ডানদিকে খানিকটা হেঁটে গেলেই সুইদোবাশি ইন্টারসেকশন। এর খানিকটা দূরে, বামদিকে কোনো এক মহামানবের বাড়ির একটি বিশাল দেবদারু বৃক্ষের গেট। সেই কর্নারটি থেকে খানিকটা ঢালু পথে এগিয়ে গেলেই ওচানোমিজু; এবং এটিই ছিল আমার প্রতিদিনকার আসা-যাওয়ার পথ। আর স্কুলে এ পথে আসা-যাওয়াকালে, পুরোটা সময় আমি কিছু না কিছু পড়তাম।
এই চলতি পথে আমি পড়েছি জাপানি সাহিত্যিক হিগুচি ইচিয়ো [১৮৭২-১৮৯৬], কুনিকিদা দোপ্পো [১৮৭১-১৯০৮], নাৎসুমে সোসেকি [১৯৬৭-১৯১৬]; এবং রাশিয়ান সাহিত্যিক ইভান তুর্গেনেভের উপন্যাস। ভাইয়া ও আপুদের কেনা বইগুলোর পাশাপাশি, আমার নিজের কেনা বইও পড়তাম। পড়ে বুঝি কি না-বুঝি, হাতের কাছে যা পেতাম, তাই পড়ে ফেলতাম।
জীবনের সে পর্যায়টিতে মানুষকে আমি খুব ভালোভাবে না বুঝলেও, প্রকৃতির বর্ণনা ঠিকই বুঝতে পারতাম। তুর্গেনেভের লেখা একটি অনুচ্ছেদ আমি কতবার যে পড়েছি; সেটি ছিল ‘দ্য রঁদেভু’ [১৯০৭] উপন্যাসটির শুরুর দিকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা : ‘অরণ্যের ভেতর বৃক্ষের পাতা ঝরার শব্দের চেয়ে ভালোভাবে অন্য কোনোকিছুর মাধ্যমে ঋতুবদল টের পাওয়া সম্ভব নয়।’
সে সময়ে প্রকৃতির বর্ণনা পড়ে বুঝতে ও তা উপভোগ করতে পারার ফলে সেগুলো আমাকে প্রভাবিতও করেছিল। পরে আমার লেখা একটি কম্পোজিশন পড়ে আমাদের ব্যাকরণ শিক্ষক ওহারা ইয়োইচি প্রশংসা করে বলেছিলেন, কেইকা মিডল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ সেরা লেখা নাকি সেটিই। কিন্তু লেখাটি এখন পড়তে গেলে মনে হয়, এটি আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বিশাল ও ধৃষ্টতাপূর্ণ।
অতীতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবি, সকালে যাওয়ার পথে আমার বামদিক দিয়ে আর বিকেলে ফেরার পথে আমার ডানদিক দিয়ে কোনো জলরাশির মতো প্রবাহিত হতে থাকা সেই লাল-ইটের সুদীর্ঘ দেয়ালটি নিয়ে কেন এতদিন কিছুই লিখিনি? শীতকালে হিমশীতল বাতাস থেকে এটি আমাকে সুরক্ষা দিলেও, গ্রীষ্মে জ্বলজ্বলে সূর্যের প্রতিফলনে সৃষ্ট তাপে আমাকে বেশ ভুগিয়েছে। খুবই বাজে ব্যাপার। সেই দেয়ালটি নিয়ে এখন চেষ্টা করলেও, লিখতে পারি না। আর মহাপ্রলয়ঙ্কারী কান্তো ভূমিকম্পের ফলে, দেয়ালটি এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল যে, সেটির একটি ইটেরও আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
(চলবে)