রম্য
ফাঁক আটকানোর গল্প
সবকিছুতেই একটা ফাঁক থাকে। সঙ্গে ফোকর যুক্ত করলে বুঝতে সুবিধা হয়। তো, ইন্টারভিউ বোর্ডে এক লোককে জিজ্ঞেস করা হলো—আইন কোন লিঙ্গ?
স্ত্রী লিঙ্গ, স্যার।
কীভাবে?
আইনের ফাঁক আছে, তাই। হিসাবি জবাব উত্তরদাতার।
আবার কিছু লোক থাকেন, যাঁরা সব সময় ফাঁক খুঁজে বেড়ান। কেতাবি ভাষায় তাঁদের ছিদ্রান্বেষী বলা হয়। সবকিছুর মধ্য থেকে ফাঁক খুঁজে বের করতে ওস্তাদ মানুষ তারা। গল্পের সেই ছাত্রের মতো। যে রচনাই তাকে বলতে বলা হোক না কেন, ঘুরেফিরে তা কুমিরের রচনায় এসে ঠেকে।
স্যার মানুষ নিয়ে মুখস্থ রচনা বলতে বললেন।
ছাত্রটি শুরু করল।
মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষের দুই পা, দুই হাত, দুই চোখ। অন্য সব প্রাণীর মধ্যে মানুষই রাজা। মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কিন্তু এই বুদ্ধিমান মানুষও ভুল করে, যখন তারা নদীর পাড়ে যায়। কারণ, নদীতে আছে ভয়ংকর এক জলজ প্রাণী। কুমির তার নাম। কুমিরের বিশাল মুখ, তাতে আছে ধারালো দাঁত। আর আছে বিশাল এক লেজ, খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...।
স্যার বুঝলেন, ছাত্রের কুমিরবিষয়ক সমস্যা আছে।
পরদিন তিনি তাকে বাড়ি নিয়ে রচনা বলতে বললেন, যাতে বাড়িকেও মানুষের মতো নদীর পাড়ে নিয়ে যেতে না পারে।
ছাত্রটি শুরু করল।
বাড়ি হচ্ছে আদর্শ একটি স্থান। যেখানে আমরা পরিবার নিয়ে বসবাস করি। বেঁচে থাকার জন্য বাড়ি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িহীন মানুষ ভিকিরি সমান। একটি পরিবার বাড়িতেই টিকে থাকে। কিন্তু কিছু মানুষ যখন ভুল করে নদীর পাড়ে বাড়ি বানায়, তখন দেখা দেয় বিপদ। একপর্যায়ে সেই বিপদ হয়ে ওঠে মহাবিপদ। কারণ, নদীতে আছে ভয়ংকর এক জলজ প্রাণী। কুমির তার নাম। কুমিরের বিশাল মুখ, তাতে আছে ধারালো দাঁত। আর আছে বিশাল এক লেজ, খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...।
স্যার বুঝলেন, সমস্যা যেনতেন নয়। যে রচনাই বলতে বলা হয়, সবই সে কুমিরের মুখের কাছে নিয়ে যায়। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, কী দিয়ে ছাত্রকে আটকানো যায়। তার চেয়ে বেশি জরুরি কুমিরের মুখ আটকানো। সে যেন কিছুতেই কুমিরের কাছে যাওয়ার ফাঁক না পায়।
অনেক ভেবে পরদিন তাকে পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে রচনা লিখতে বললেন শিক্ষক। এবার দেখি, কীভাবে কুমিরের কাছে যাও।
ছাত্রটি শুরু করল।
পলাশীর যুদ্ধ হচ্ছে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধ।
ইংরেজ বনাম আমাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু আমরা সেই যুদ্ধে পরাজিত হই। কারণ, সিরাজের সেনাপতি ছিল মীর জাফর। আর মীর জাফরের মতো লোককে যুদ্ধের সেনাপতি বানানো মানেই হচ্ছে খাল কেটে কুমির আনা। কারণ, কুমির হচ্ছে ভয়ংকর এক জলজ প্রাণী। কুমিরের আছে বিশাল মুখ আর তাতে আছে ধারালো দাঁত। আর আছে বিশাল এক লেজ, খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...খাঁজ কাটা...।
একটি ব্যাপার তো পরিষ্কার হওয়া গেল। বিষয় যেটাই হোক না কেন, ফাঁক তাতে একটা পাওয়া যাবেই। আর সে ফাঁক গলেই বেরিয়ে যাওয়া। শুধু ফাঁক খোঁজার মতো মন আর ইচ্ছা থাকতে হবে।
আবার উল্টো মতের লোকের সংখ্যা কম নয়।
তাঁদের দাবি, কাউকে যদি আপনি আটকাতে চান, সেটা কঠিন কোনো বিষয় নয়। আপনার ইচ্ছাই যদি থাকে আটকানো, তাহলে আটকে দিতে পারবেন। এ বিষয় দুটি নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের।
আবারো গল্পের আশ্রয় নেওয়া যাক।
গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ভারতের তিন নেতা—সোনিয়া গান্ধী, এল কে আদভানি আর বিহারের লালুপ্রসাদ যাদব। একই দুর্ঘটনায় মৃত্যু। কিন্তু ওপরে গিয়ে দেখা গেল, সোনিয়া গান্ধী আর আদভানিকে স্বর্গে জায়গা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেচারা লালুর জায়গা হয়েছে নরকে।
ভীষণ ক্ষেপে গেলেন লালু।
এ হয় না। এ অবিচার। আমরা একই দুর্ঘটনায় মারা গেছি। তা ছাড়া আমাদের প্রফেশনও ছিল এক। তাহলে ওই দুজনকে স্বর্গে জায়গা দেওয়া হলে আমার কী দোষ। আমাকে কেন নরকে পাঠানো হলো! জানতে চাইলেন লালু।
স্বর্গ কর্তৃপক্ষ জানাল, স্বর্গে দুটি সিটই আছে। সুতরাং একজনকে বাইরে রাখতে হবে।
তখন লালু জানতে চাইলেন, কিসের ভিত্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়া হলো। কোনো যাচাই-বাছাই তো হয়নি। তিনি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
ঠিক আছে। মেনে নিল স্বর্গ পরিচালকরা।
তিনজনকে এক জায়গায় এনে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলো। বানান।
সোনিয়া গান্ধীকে বলা হলো ইন্ডিয়া বানান করতে। সোনিয়া পটাপট বলে দিলেন।
আদভানিকে জিজ্ঞেস করা হলো পাকিস্তান বানান কী। আটকালেন না আদভানিও।
এবার লালুর পালা।
তাকে বলা হলো চেকোস্লোভাকিয়া বানান করতে।
লালু পারলেন না। তবে তিনি এ বিচার মানলেনও না। তাঁর দাবি, কঠিন প্রশ্ন করা হয়েছে তাঁকে।
ঠিক আছে আবার পরীক্ষা নেওয়া হবে। স্বর্গ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল।
সোনিয়াকে ট্রান্সলেশন ধরা হলো—কুকুর ডাকে ঘেউ ঘেউ।
সোনিয়া পারলেন।
আদভানিকে ধরা হলো—বিড়াল ডাকে মিউ মিউ।
তিনিও পারলেন।
এবার লালুকে ধরা হলো—বাঘ গর্জন করে ঘরর...ঘরর...ঘরর।
তিনি পারলেন না।
এবারও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তাঁর।
স্বর্গ কর্তৃপক্ষ বলল, ঠিক আছে, তুমিই বলো কোন সাবজেক্টের ওপর প্রশ্ন করব তোমাকে।
ইতিহাস।
খানিক ভেবে বললেন লালু। কারণ, তাঁর সাবজেক্ট ছিল ইতিহাস। সুতরাং প্রশ্ন করে তাঁকে আটকানো যাবে না।
ঠিক আছে, তবে তাই হবে। তবে এবারই শেষ। হুঁশিয়ারিও আছে সঙ্গে।
ইতিহাস থেকে সোনিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো—
ভারত স্বাধীন হয়েছে কবে?
সোনিয়া চটপট বলে দিলেন ১৯৪৭ সালে।
উত্তর সঠিক।
এরপর আদভানি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, পুরো স্বাধীনতা-সংগ্রামে মোট কতজন মানুষ মারা গেছেন। অনেক ভেবে আদভানি বললেন, পাঁচ লাখ মানুষ।
এই উত্তরকেও সঠিক বলে ধরে নেওয়া হলো।
এবার লালুর পালা।
স্বর্গ কর্তৃপক্ষ বলল, আগের উত্তরদাতা বলেছেন, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাঁচ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন।
লালু বললেন, জি হয়েছে।
তুমি তাদের নাম আর ঠিকানা বলো—লালুর কাছে জানতে চাইল স্বর্গ কর্তৃপক্ষ।
এই হচ্ছে ঠিক মুদ্রার উল্টো পিঠ। এ গল্পটি আমাদের বলছে—আপনি যদি কাউকে আটকাতে চান, সেটাও কোনো বিষয় নয়। সব বিষয়ে যেমন ফাঁকসহ একটা রাস্তা থাকে, আবার সব বিষয়েই আটকানোর একটা শক্ত দরজাও থাকে। একই বিষয়ে ধরা ছাড়া দুটোই সমানভাবে বিদ্যমান। মূল বিষয়টা হলো ইচ্ছা। আপনি কোনটা বেছে নেবেন।
ফাঁক চাইলে ফাঁক। আর ‘থাক’ চাইলে থাক। আটকে দিন।