সাক্ষাৎকার
কবিরা কখনোই কারো একার নয় : আল মাহমুদ
আল মাহমুদ—আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ। ১৯৬৮ সালে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
১৯৯০-এর দশক থেকে তাঁর কবিতায় ধর্মীয় ভাব প্রবেশ করতে থাকে। সে সময় তাঁর সাহিত্যচর্চা ও সংশ্লিষ্টতা মিলিয়ে প্রগতিশীল লেখকরা মনে করতে থাকেন আল মাহমুদ ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ চক্রে প্রবেশ করেছেন। এই বিভেদ তাঁর সমসাময়িক অনেক বড় লেখক ও কবিদের থেকে তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়।
প্রগতিশীল বনাম প্রতিক্রিয়াশীলের এই দ্বন্দ্ব, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমসাময়িক লেখকদের অবস্থান নিয়ে আল মাহমুদের ভাবনা উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। ২০০৪ সালে আল মাহমুদের গুলশানের ফ্ল্যাটে এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় অধুনা লুপ্ত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ভোরের শিশিরের জন্য, কদিন পরই সেটি প্রকাশ হয় (ভোরের শিশির, সংখ্যা : ১৬, বর্ষ : ৩, চৈত্র ১৪১০, মার্চ ২০০৪)। সাক্ষাৎকারটি মূলত গ্রহণ করেন বিধান রিবেরু, সঙ্গে ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন চপল, সম্পাদকীয় সহকারী খন্দকার মো. জসীম উদ্দিন, সহসম্পাদক আখতারুল আলম ও আলোকচিত্রী সানজিদা শারমীন সোভা। কিছু প্রশ্নোত্তর অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় সেগুলো এখানে বাদ দেওয়া হলো।
প্রশ্ন : কেমন আছেন?
আল মাহমুদ : ভালো।
প্রশ্ন : এখন আপনার ব্যস্ততা কী নিয়ে?
আল মাহমুদ : ব্যস্ততার মধ্যেই তো সময় কাটাতে হয়।
প্রশ্ন : যদি কিছু মনে না করেন তবে আমরা জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের পরে আপনারা যাঁরা প্রগতিশীল লেখক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিভাজন হলো কেন?
আল মাহমুদ : এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু বলতে চাই না। তবে তোমাদের কাছে আমি একটা প্রশ্ন রাখতে চাই তা হলো, তোমাদের মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগে না যে তখনকার সময় প্রগতিশীল লেখকদের মাঝে কারা কারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর উত্তর খুঁজে বের করো, তবেই সব তোমাদের কাছে খোলাসা হয়ে যাবে। আজ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের বেশিরভাগ সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করতেন।
প্রশ্ন : এমনটা কেন ঘটেছিল?
আল মাহমুদ : তা তো আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারব যে তাঁরা সে সময় পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পুরস্কার নিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁরা শেখ মুজিবের ছয় দফাকে সমর্থন করেননি; বরং সমালোচনা করেছেন। তা ছাড়া তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয়, তাঁরা কেন যুদ্ধ করেননি, তবে তাঁরা নানান অজুহাত দাঁড় করাবেন। কিন্তু যুদ্ধ তাঁরা কেউই করেননি। আর যুদ্ধের শেষে একেকজন কী সুন্দর লিখে ফেললেন, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘স্বাধীনতা তুমি’ আরো কত কী! যে কি না মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, এমনকি কোনো ভূমিকা পর্যন্ত রাখেননি তাঁকেই কি না দেওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের দলিল তৈরি করতে।
প্রশ্ন : আপনারা প্রগতিশীল লেখকরা তো একসময় একসঙ্গেই আড্ডা দিতেন, আন্দোলন করেছেন, তবে আজ কেন এমন বিভাজন?
আল মাহমুদ : আমি যখন গণকণ্ঠ বের করতাম, তখন তো প্রায়ই একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। সমাজতন্ত্র করেছি। বাংলাবাজার বিউটি রেস্টুরেন্টে দিনের পর দিন কত আড্ডা মেরেছি। আজ না হয় আমি দাড়ি রেখেছি বলে মৌলবাদী হয়ে গেছি। কিন্তু তাই বলে তো আর সেই পুরোনো দিনগুলো অস্বীকার করা যাবে না।
প্রশ্ন : তখনকার প্রগতিশীল লেখকদের মধ্যে কারা কারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা কি আমাদের বলবেন?
আল মাহমুদ : ড. আনিসুজ্জামান, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, সিকান্দর আবু জাফর ও আমি। নির্মলেন্দু গুণও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তখন লেখক হিসেবে তেমন পরিচিতি পাননি। আহমেদ ছফাও ছিল। তিনি তখন নিতান্তই একজন ছাত্র। আর যাঁরা যুদ্ধ করেননি বা যুদ্ধের পক্ষে আছেন, এমন মনোভাবও যাঁদের মধ্যে ছিল না তাঁরা হলেন—কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাঈদ আতিকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
প্রশ্ন : তবে এখন আপনি কেন প্রতিক্রিয়াশীলদের ডাকে সভা বা সেমিনারে যান?
আল মাহমুদ : আমি সব সভা-সেমিনারেই যাওয়ার চেষ্টা করি। যেমন সমাজতন্ত্রের সেমিনারেও যাই, তেমনি জামায়াত-শিবিরের সেমিনারেও যাই। আর জামায়াত-শিবিরের সভাতে যাই বলে আমাকে রাজাকার বলা হয়, কিন্তু ওদের সভা-সেমিনারে গিয়ে আমি কী বলি সেটা শোনার জন্য কেউই যায় না। এখন মনে হয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করে রাজাকার উপাধিটাই আমার প্রাপ্য।
প্রশ্ন : দেশে আপনাকে অনেকেই মৌলবাদী বলে মন্তব্য করে। এ ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?
আল মাহমুদ : দাড়ি রাখলে আর ধর্মভীরু হলেই যদি মৌলবাদী হয়, তবে অবশ্যই আমি মৌলবাদী। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের সভায় যাই বলে আমাকে যদি মৌলবাদী বলা হয়, তাহলে অবশ্যই অন্যায় হবে। এই তো কিছুদিন আগেই ‘যায়যায়দিনে’ ‘হাওয়া বিবির জাগরণ’ নামে একটি আর্টিক্যাল লেখার কারণে তথাকথিত মোল্লারা বেশ চটে যায় আমার ওপর। তাহলে এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? সত্যি বলতে কি, আমি একজন কবি। আর কবিরা কখনোই কারো একার নয়, সে সবার—সবার জন্য তার সমান ভালোবাসা।
প্রশ্ন : যুদ্ধের সময়ের কোনো স্মৃতি বলুন।
আল মাহমুদ : আমি থাকতাম রায়পুরা। যুদ্ধের সময় বামুটিয়া হয়ে আগরতলা চলে যাই। সেখানে প্রশিক্ষণ। তার পর তো সরাসরি যুদ্ধে।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনার কিছু মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।
আল মাহমুদ : অনেক উঁচু মাপের একজন নেতা। দেশের সেই ক্রান্তিকালে তাঁর মতোই একজন নেতার প্রয়োজন ছিল। তাঁর সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলে; কিন্তু আমি বলব, তিনিই এ দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। তিনি না থাকলে এ দেশ আজ স্বাধীন হতো না।
প্রশ্ন : কিন্তু শোনা যায় তিনিও নাকি স্বাধীনতার ডাক দিতে চাননি?
আল মাহমুদ : সে তর্কে যাওয়াটাই বোধ হয় ঠিক হবে না। তা ছাড়া যে যাই বলুক না কেন, তাঁকে কখনই অস্বীকার করা যাবে না। তাঁকে অস্বীকার করা মানেই দেশকে
অস্বীকার করা। যুদ্ধ-পরবর্তী সময় তাঁর অনেক ভুল ছিল। সেই ভুলের মাশুল তাঁকে দিতে হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে তাঁর মতো একজন নেতারই আমাদের প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন : অনেকে সে সময় শেখ মুজিবের স্থানে অন্য যে কেউ থাকলেও একই ভূমিকা পালন করতেন বলে দাবি করেন।
আল মাহমুদ : কখনই না। এটা সব সময় মনে রাখবে, কেউ কখনো কারো অলটারনেটিভ হতে পারে না। তাঁর মতো নেতা তখনো কেউ জন্মায়নি, আর ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর কিছু ভুল ছিল বলছেন, তাহলে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য জাতীয় সরকার তৈরি করে তাঁদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিলে কি ভালো করতেন?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, তা হতো। কিন্তু সে চেষ্টা শেখ মুজিব করেননি। আর একজন কবি হিসেবে আমার এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানা নেই। দেশে ফিরে আমি একটি পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সমাজতন্ত্র করতাম। তখন সমাজতন্ত্রের নেতারা কত কম জানত, তা ভেবে আজ বড় অবাক লাগে। তবে আরেকটি কথা না বললেই নয়, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত কি না সন্দেহ আছে।
প্রশ্ন : আপনার বই পড়া নিয়ে কিছু বলুন।
আল মাহমুদ : সময় পেলেই পড়তাম। তবে বেশি পড়েছি জেলখানায় থাকতে। তখন তো অফুরন্ত সময়। বই পড়েই কাটাতাম। এই পড়তে পড়তেই আমার ধারণা হলো রাশিয়া একসময় ভাগ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে আপনার কী মত?
আল মাহমুদ : এককথায় বলতে গেলে প্রতিভাবান, কিন্তু হতভাগিনী। হতভাগিনী বলছি এ কারণে যে ওকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রগতিশীল লেখকরাই ওকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। তারপর তুলে দিয়েছে আনন্দবাজারিদের হাতে। তাঁরাও তাঁকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে। তারপর ছুড়ে ফেলেছে।
প্রশ্ন : এই ‘ব্যবহার’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
আল মাহমুদ : সবকিছুই বোঝাচ্ছি। প্রথমে ওকে ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে প্রগতিশীল লেখকরা। আর আজ যখন ওদের চরিত্র নিয়েই লিখেছে, তখন ওই প্রগতিশীল লেখকদের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, কলমের অপব্যবহার কখনই ঠিক না।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় ‘ক’ লিখে তসলিমা নাসরিন ভালো করেছেন?
আল মাহমুদ : না, এটা আমি কখনোই বলব না। সব মানুষের গোপন কিছু থাকতে পারে। কিন্তু তা কারো লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে না। না জেনেশুনে বা ভালো করে না বুঝে যেমন ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরা ওর উচিত হয়নি, তেমনি ‘ক’-এর মতো বই লেখাটাও ওর উচিত হয়নি। তবে ‘ক’ লিখে ও বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। একটানে ও সব সাধুর মুখোশ ছিঁড়ে ফেলেছে। তোমরা আমার এই কথাটা লিখে রাখো, তাঁদের বর্তমান চেহারা পুনরায় মানুষের রূপ নিতে আরো একশ বছর লাগবে। কই আমাকে নিয়ে তো কিছু লেখার সাহস পেল না তসলিমা? তসলিমার লেখার প্রতিভা আছে, এটা বলতে দ্বিধা নেই। ওর কবিতার হাত অতুলনীয়। পড়ে দেখো।
প্রশ্ন : আপনাকে কি এখন প্রগতিশীলরা কোনো সভায় আমন্ত্রণ করে না?
আল মাহমুদ : দেশে তেমন হয় না। তবে দেশের বাইরে, যেমন কলকাতা থেকে বামপন্থীরাই আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায়। গত বছর ‘সার্ক রাইটার্স ফোরাম’ থেকে আমাকে দাওয়াত করা হয়েছিল। ওদের দাওয়াত দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কেননা, বর্তমানে ভারতের বামপ্রধানরাই এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। গত বছর তাঁরা আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন।
প্রশ্ন : তরুণদের জন্য কিছু বলুন।
আল মাহমুদ : তরুণ শব্দের অর্থ হচ্ছে নির্বোধ, অজ্ঞ। তবে আমরা তরুণ বলতে সাধারণত বয়সে কমটাকেই বুঝি। আর আমি মনে করি, তরুণদের মুখ্য কাজ হওয়া উচিত ‘পড়া’। সময় পেলেই পড়তে হবে। তাহলেই জ্ঞান অর্জন হবে, জীবনে অনেক বড় হওয়া যাবে। আর সব সময় মনে রাখতে হবে, পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আল মাহমুদ : তোমাকেও ধন্যবাদ।