কুরোসাওয়া কথা

অন্ধকারাচ্ছন্নতা ও মানবতা

Looks like you've blocked notifications!

 

ভূমিকা

জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।

প্রলয়ংকরী কান্তো ভূমিকম্প আমার কাছে ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং গুরুত্বপূর্ণ। এর ভেতর দিয়ে আমি কেবল প্রকৃতির অনন্যসাধারণ ক্ষমতাকেই প্রত্যক্ষ করিনি, বরং দেখেছি মানুষের আত্মায় বসত করা অসাধারণ বিষয়-আশয়কেও। এককথায়, ভূমিকম্পটি আমার চারপাশের জগতের আচমকা রূপান্তরের মাধ্যমে আমাকে একেবারেই বিস্মিত করে ফেলেছিল।

এদোগাওয়া নদীর অপর পাড়ের যে সড়কটি দিয়ে স্ট্রিটকার চলত, ফাটল ধরে সেটির অবস্থা হয়ে পড়েছিল খুবই বাজে। এমনকি নদীটিও তলানি থেকে ভীষণ ফুলে-ফেঁপে ওঠায় তার বুকে দেখা মিলেছিল কাদাময় নতুন চরের। কাছাকাছি অঞ্চলে ভেঙে পড়া কোনো বাড়ি যদিও আমার চোখে পড়েনি, তবে সবগুলো ছড়িয়ে ছিল এখানে-ওখানে। এদোগাওয়া নদীকূলের পুরো অঞ্চলটি একটি নাচুনে ও ঘূর্ণি ধুলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল; ফলে ধূলি-ধূসরতায় সূর্যের আলো হয়ে পড়েছিল গোধূলিলগ্নের পাণ্ডুবর্ণের। এই দৃশ্যে আমার ডানে-বামে যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, সবাইকে লাগছিল নারকীয়, এ জগৎ থেকে পলায়নপর যেন। পুরো ল্যান্ডস্কেপ ধারণ করেছিল এক অনাসৃষ্টি ও ভুতুড়ে চেহারা। নদীতীরের একটি কচি চেরিগাছ আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আর এ দৃশ্যটি দেখে শিউরে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম, ‘নিশ্চয়ই এটাই রোজ-কেয়ামত।’

সেভাবে দেখলে, সেদিনটির কথা আমার তেমন বেশি মনে নেই। তবে এ কথা আমার ঠিকই মনে আছে, পুরো ভূখণ্ড দুলছিল, অবিরাম দুলছিল। আরো মনে আছে, পরমুহূর্তেই পুবের আকাশে একটি মহাতরঙ্গায়িত মাশরুম-আকৃতির মেঘ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল, আর টোকিওর কেন্দ্রস্থলের অগ্নিশিখার ধোঁয়ায় তা ধীরে ধীরে অতিকায় হয়ে উঠে, ছড়িয়ে পড়ে দখল করে নিয়েছিল আকাশের অর্ধেকটা।

সে রাতে ইয়ামা-নো-তে পার্বত্যাঞ্চল—যেখানে আমরা ছিলাম, এবং যে অঞ্চলটি আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিল—সে অঞ্চলটিও টোকিওর বাদবাকি এলাকার মতো ছিল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। কোনো বাতি জ্বলেনি ঠিকই, তবে শহরতলির নিম্নাঞ্চলে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা এই পার্বত্যাঞ্চলের পুরো এলাকা এক অপ্রত্যাশিত আলোয় একাকার করে দিয়েছিল। সে রাতে প্রত্যেক গৃহস্থের কাছে মোমবাতি থাকলেও, আঁধার কাটাতে সেগুলো কেউই ব্যবহার করেনি। তবে সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছিল অস্ত্রাগারটির শব্দ।

অস্ত্রাগারটির চারপাশ, যেমনটাই আগেই বলেছি, লালরঙা ইটের দীর্ঘ এক দেয়ালে ছিল ঘেরা—যার ভেতরে ছিল লালরঙা ইটের বিশাল বিশাল দালানের মধ্যে কারখানাগুলো দাঁড়িয়ে। এই দেয়ালগুলো শহরতলি থেকে ধেয়ে আসা আগুন রুখে দেওয়ার পথে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং পুরো ইয়ামা-নো-তে অঞ্চলকে দিয়েছিল বাঁচিয়ে। বাঁচিয়ে দিয়েছিল অস্ত্রাগারের হাত থেকেও; কেননা, বিস্ফোরকের এক সংগ্রহশালা ছিল এটি; ফলে এখানে আগুনের ছোঁয়া পৌঁছুলে, কান্দা থেকে সুইদোবাশি পর্যন্ত—বিস্তৃত এলাকা বিস্ফোরিত হয়ে যেত। ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়েছে, কোনো ধরনের কার্তুজ যেন জ্বলে উঠেছে; অস্ত্রাগারটি থেকে আগুনের রেখা ফুটে উঠে, এক আতঙ্কজনক গর্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল। এই শব্দটিই সব মানুষকে করে ফেলছিল বিচলিত।

আমার প্রতিবেশীদের মধ্যে আসলে এমন একজন ছিলেন, যিনি সত্যিকার অর্থেই আস্থার সঙ্গে বর্ণনা করছিলেন, বিস্ফোরণের এই শব্দটি আসলে টোকিওর একশো মাইল দক্ষিণের, ইজু পেনিনসুলা উপদ্বীপটি থেকেই ভেসে আসছে। তিনি বলেছিলেন, সেখানে একের পর এক অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে—যা কিনা উত্তরে, আমাদের দিকে আসছে ধেয়ে। লোকটি বলতে থাকলেন, ‘এটি যদি আমাদের কাছে পৌঁছে যায়, তাহলে ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যাবে। আমি এখনো সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি; এক্ষণই যা কিছু সঙ্গী করে এ এলাকা থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে।’ তারপর তিনি এখানেই কোথাও খুঁজে পাওয়া একটি দুধবাহী ঠেলাগাড়ি বেশ গর্বের সঙ্গে সবাইকে দেখালেন।

এই পুঁচকে গল্পটি বেশ প্রাণবন্ত ছিল, এবং এটি শুনে সত্যিকার অর্থে কেউই মনে কষ্ট পায়নি। মনুষ্য স্বভাবের মধ্যে, আতঙ্ক থেকে মানুষের বেরিয়ে আসার বিষয়টিই আসলে আতঙ্কজনক ব্যাপার। শহরতলির আগুনের তেজ যখন কমে এলো, সবাই তখন নিজেদের বাড়িতে থাকা মোমগুলো জ্বালিয়ে নিলেন এবং পৃথিবী তখন রাতের অন্ধকারের প্রকৃত রূপের দেখা পেল। এই অন্ধকার সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এবং সবচেয়ে অবিশ্বাস্য রকমের উন্মত্ততা ও অনাচারের ভেতর ঠেলে দেবে জীবনকে—এমন আতঙ্কে ভুগতে থাকলেন অনেকেই। এমন অন্ধকারের মুখোমুখি এর আগে কোনোদিন না হওয়া এই মানুষগুলোর মনে যে পরিমাণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তা কল্পনা করাও অসম্ভব ব্যাপার; এ এমনই এক আতঙ্ক—যা সব যুক্তি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। কোনো মানুষ যখন তার ডানে-বামে আর কোনোকিছুই দেখতে না পায়, সে তখন একেবারেই মনোবলহীন ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। ঠিক যেন মুরুব্বিরা যেমনটা বলে থাকেন, ‘আতঙ্কগ্রস্ত মানুষমাত্রই অন্ধকারের দানবদের সমতুল্য।’

মহাপ্রলয়ংকরী কান্তো ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটেছিল যে অঞ্চলের পাদদেশে, টোকিওর সেই কোরিয়ান আবাসিক এলাকাটির গণমৃত্যু—মানুষের চোখে-মুখে এমন অন্ধকারভীতির জন্ম দিয়েছিল। আমি নিজের চোখে তরুণ এক গুণ্ডাকে দেখেছি, বিকৃত চোখ-মুখ করে, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চিৎকার করে দ্রুতবেগে ছুটে যেতে—‘এ পথে!’ ‘না, অই পথে!’ তারা একজন দাঁড়িঅলা লোককে তাড়া করছিল; নিশ্চয়ই জাপানে তখন দাঁড়িঅলা মানুষের সংখ্যা খুব একটা ছিল না।

আগুনের গ্রাসে সর্বস্ব খোয়ানো আত্মীয়দের দেখতে, উয়েনো অঞ্চলে গিয়েছিলাম আমরা। আমার বাবার মুখে দাঁড়ি ছিল—শুধু এ কারণেই একদল গুণ্ডা তাকে ঘিরে রেখেছিল নিজেদের ক্লাবে। বাবার সঙ্গে ভাইয়াও ছিলেন, তার দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল আমার। ব্যঙ্গাত্মক এক মুচকি হাসি দিয়েছিলেন ভাইয়া। বাবা যখনই রেগে গর্জে ওঠলেন, ‘গর্দভের দল!’, তক্ষুণি লোকগুলো চুপিসারে সটকে গেল।

রাতের বেলা এলাকায় পাহারা দেওয়ার জন্য আমাদের প্রতিবেশীদের প্রত্যেকের বাড়ি থেকে একজনকে করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভাইয়ার যেহেতু এই বুদ্ধিটি একেবারেই পছন্দ হয়নি, ফলে তাকে সে দায়িত্ব দেননি কেউই। বিকল্প কোনো সমাধান না থাকায়, আমিই বরং দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজের কাঠের তলোয়ারটি সঙ্গে নিয়ে, এবং পানি নিষ্কাশনের এমন একটি পাইপের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, যেটির ভেতর দিয়ে কোনো বিড়ালের পক্ষেও হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। তারা আমাকে এখানে দাঁড় করানোর কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘কোরিয়ানরা নিশ্চয়ই এখান দিয়ে ছিঁচকে চোরের মতো ঢোকার চেষ্টা করবে।’

তবে আরো হাস্যকর একটি ঘটনাও ঘটেছিল তখন। তারা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, আমাদের বাড়ির কাছের নির্দিষ্ট একটি কূপ থেকে যেন পানি না খাই। এর কারণ, সেই কূপটির দেয়ালে সাদা চক দিয়ে আজব ধরনের কথা লেখা ছিল। তাদের ধারণা, এ কথাগুলো নিশ্চয়ই কোনো কোরিয়ান কোড—যার মাধ্যমে এই কূপের পানিতে বিষ মেশানোর ইঙ্গিত লেখা আছে। এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সত্য হলো এই যে, এই আজব ধরনের কথাগুলো ছিল আসলে আমারই নিজের লেখা হিজিবিজি। বড়দের এমনতর আচরণ দেখে, তখন কিছুই বলতে পারিনি আমি; অবাক হয়ে ভেবেছি, কী করে এমন হয় মানুষ!

(চলবে)