বতিচেল্লির বসন্ত
ফ্রেস্কো বা দেয়ালে আঁকা পেইন্টিংটির নাম ‘অ্যালিগরি অব স্প্রিং’। আঁকিয়ের নাম সান্দ্রো বতিচেল্লি। আনুমানিক ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয় এই বিখ্যাত শিল্পকর্মটি। এই কাজে বসন্ত এসেছে রূপক হয়ে।
সময়টা ছিল রেনেসাঁর। মানুষের মনে তখন নবজাগরণের ছোঁয়া। নবজাগরণ সেই যুগে বতিচেল্লির অনন্য সৃষ্টি প্রিমাভেরা দেখার সুযোগ মেলে সবার। ফুলেল বসন্তের এক চমৎকার উপস্থাপন দেখা যায় এই শিল্পকর্মে। বসন্ত মানে যদি ফুল আর প্রকৃতি হয় তাহলে এই ছবিটিই বোধহয় বসন্তের সর্বোচ্চ শৈল্পিক প্রকাশ। ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে, এই অসামান্য শিল্পকর্মে রয়েছে ফুলের বর্ণিল সমারোহ। ধারণা করা হয় এখানে প্রায় ২০০ রকম ফুল রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এসব ফুলের মধ্য থেকে শনাক্ত করেছেন ১৩০ প্রজাতির ফুল। অজস্র ফুলের সমারোহ বলেই বোধহয় এর নাম হয়ে উঠেছে বসন্তের রূপক।
এ ছবির পরতে পরতে মেলে বসন্তের আবহ, যদিও বসন্তকে সামনে রেখে কাজটি করা হয়নি! গেভানির মেদিচি পরিবারের কারো বিয়ের উপহার হিসেবে এই শিল্পকর্মের সৃষ্টি। এই সৃষ্টিতে পরিবারের দুজন মডেল হিসেবে এসেছেন বলে ধারণা করা হয়। বসন্তকে মাথায় রেখে অথবা নিছক বিয়ের উপহারের উদ্দেশে- যে কারণেই আঁকা হোক না কেন- বতিচেল্লি কিন্তু এক কাজের মাঝেই ঘটিয়েছেন নানা কিছুর সমারোহ। যেমন-
১. রোমান পৌরাণিক কাহিনীর একাধিক চরিত্র
২. বসন্তের স্তুতি
৩. প্লেটোর আদর্শের ইঙ্গিত তথা মানবতার জয়
৪. মেডিচিদের উপস্থাপন
প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের এই ছবির মূলকেন্দ্রে রয়েছে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস। অনেকের মতে এই ছবি বতিচেল্লি ‘বার্থ অব ভেনাস- এর পরবর্তী রূপ। ভেনাসের আগমনে পৃথিবীতে লেগেছে রঙের ছোঁয়া। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে পৃথিবী। ছবির মাঝখানে লাল কাপড়ের আবরণে ভেনাসের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ভেনাসকে বসনাবৃত করার কারণ হয় তো এটা বোঝানো যে পৃথিবীতে বসন্ত এসেছে। সচরাচর পৃথিবী নগ্ন থাকে কিন্তু বসন্তে এই পৃথিবীই সেজে ওঠে বর্ণিল সাজে। নগ্ন ভেনাসও তেমনভাবে সেজে উঠেছেন এখানে।
ছবিটা রেনেসাঁ আমলের বলেই ধারণা করা হয় যে শিল্পী এখানে রোমান পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রগুলোকে তুলে ধরেছেন। আর এর মাধ্যমে সে সময়ের পুনর্জাগরণের কথাই বলতে চেয়েছেন শিল্পী। এখানে রয়েছে প্লেটোর মানবতাবাদের জয়গান, রয়েছে কমলার বাগান যা মেডিচিদের পারিবারিক প্রতীক।
ছবির সবচেয়ে ডানে দেখা যায় বাতাসের দেবতা জেফিরাসকে, যে ছবির অন্য সবার চেয়ে আলাদা। এই বসন্তের দুনিয়ায় ক্লোরিসের আগমন সে ঠেকিয়ে দিতে চায় হাসতে হাসতে। এখানে একটি ছোট গল্প আছে। জেফিরাস নির্যাতন করে ক্লোরিসকে। কিন্তু এই কাজের পর অনুশোচনা ভর করে জেফিরাসের মনে। ফলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্লোরিসকে সে ফুলের দেবী ফ্লোরায় রূপান্তরিত করে দেয়। এখানে সেই রূপান্তরের নমুনা হিসেবে ক্লোরিস আর ফ্লোরা দুজনকেই দেখতে পাই, যেখানে ফ্লোরা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ফুলেল পোশাকে আচ্ছাদিত। পৃথিবীর প্রাঙ্গণে ফুল ছড়িয়ে যাচ্ছে সে।
আর অন্য পাশে রয়েছে শিরোস্থান পরিহিত মার্কারি, যে হাতের কাঠের অস্ত্র দিয়ে শীতের ধূসর মেঘকে সরিয়ে দিয়ে বসন্তের মেঘকে জায়গা করে দিচ্ছে। মার্কারির দেহেও লাল বস্ত্র। ছবিতে আরো রয়েছে সজীবতার প্রতীক তিন অভিজাত নারী- যাদের গহনার নকশা, ভঙ্গিমা আর চুলের ধরন- সবই একেবারে ভিন্ন। অনেকে বলেন, এদের সব গহনা নাকি মেডিচিদের বাড়ির গহনার অনুকরণে আঁকা। যদিও গহনাসহ এই তিন নারী স্বর্গের আবহকে প্রকাশ করছে। এদের গায়ের স্বচ্ছ লম্বা পোশাকগুলো বতিচেল্লির অনবদ্য সৃষ্টি।
রেনেসাঁ শিল্পীদের অনেকের কাজেই এই তিন নারীকে দেখা যায়। তাদের দিকে চোখ বেঁধে তীর তাক করে আছে কিউপিড। ভেনাসের সন্তান কিউপিড এখানে অবস্থান করছে ঠিক ভেনাসের ওপরে।
ঝোপঝারে ঢাকা আলো-আঁধারি আবহে চিত্রিত উজ্জ্বল সব চরিত্রগুলো যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। এতগুলো পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে এত বড় কাজ সে সময় আর কেউ করেননি। ধর্মের প্রচ্ছায়া মুক্ত এই কাজ বতিচেল্লির সবচেয়ে আলোচিত কাজ। রঙের আর ফুলের সমাহার নিয়ে এক অসাধারণ ভাবনার প্রতীক ছবিটি। নবজাগরণ আর বসন্তের আগমন নিয়ে অসামান্য এক দৃষ্টান্ত এই চিত্রকর্ম।