গল্প পড়ার গল্প
অসীম রায়ের ৬৩টি গল্পই মণিমুক্তো
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষ বা সাতের দশকের আরম্ভে যখন আমি-আমরা ১৮-১৯-২০, যখন আমি স্কুল ছেড়ে কলেজে, যখন আমার বন্ধু হিরন্ময়, অশোক, অরুণ, জয়দেব হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে গেছে, প্রতিদিন আমার বয়সীদের লাশ পড়ে থাকছে মাঠে, পথে, খাল পাড়ে, তখন অসীম রায়ের গল্প অনি বেরিয়েছিল, ১৯৭১ সাল সেইটা। ‘অনি’ই ছিলাম আমি-আমরা। আর ২০১৪তে আমি অনির পিতার ভূমিকায়। পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেছে। কিন্তু পিতা ও পুত্রের দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে। এই বয়সে ‘অনি’ আবার পড়তে গিয়ে আমি নিজেকে অন্যভাবে খুঁজে পেলাম।
অসীম রায় সারা জীবনে ৬৩টি গল্প লিখেছেন, সবগুলোই একেকটি মণিমুক্তো। কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন, ‘গোপালদেব’, ‘রক্তের হাওয়া’ পড়েছি অবশ্য পাঠ্য জেনে। সেই বয়সে অসীম রায়কে পড়ে জেনেছি রাজনৈতিক বিষয়, রাজনীতি কীভাবে সাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠে। একটি হৃদয়বিদারক নভেলেট পড়েছিলাম অধুনালুপ্ত সাহিত্যের পত্রিকা ‘গল্প কবিতা’য়। অসংলগ্ন কাব্য। রাজনীতি যাদের ঘর থেকে বের করে এনেছিল, পুলিশের হাতে মরছিল যারা, এ ছিল তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী। গল্পের ভেতরে কত প্রশ্ন ছিল তাঁর। কমিউনিস্ট পার্টি করা অসীম রায় তাঁর গল্পে তখন যে সমস্ত প্রশ্ন তুলেছিলেন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় প্রবেশ নিয়ে, আর যাবতীয় অন্যায়কে মার্কসীয় যুক্তি দিয়ে ন্যায়প্রতিপন্ন করা ও তা এত বছর বাদে পরীক্ষিত সত্য। তার ভয়াবহ পরিণতি আমরা দেখেছি।
অসীম রায় পড়তে আরম্ভ করেছিলাম, গল্প কীভাবে লিখতে হয় তা বুঝতে। আর আকর্ষণ ছিল রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর সত্য কথন, সেই সময়ে, আমাদের সেই আরম্ভের দিনে, আরম্ভের রাতে অসীম রায়ের মতো রাজনৈতিক গল্প আর কেউ লেখেননি। ১৯৬৮-তে লেখা আরম্ভের রাত গল্পে প্রবীণ কমিউনিস্ট পানুদা বলছেন, ‘ইলেকশন আর সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা এক ব্যাপার নয়। ইলেকশনে বিপ্লব নাই। আছে অনেক রকম ফিকির। সেই সব ফিকির না আয়ত্ত করতে পারলে জেতা যায় না।’
এই কথন কত সত্য তা আমরা অনেক বছর ধরে দেখতে দেখতে বয়স বাড়িয়েছি। ‘অনি’ যখন প্রকাশিত হয়, আমাদের সেই বয়স নাড়া খেয়ে গিয়েছিল। নাড়া খেয়েছিলেন সেই সময়ের প্রবীণরাও। গল্পটি পিতা ও পুত্রের কথোপকথন। পিতার বয়ানে লিখিত। যে মানুষটি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, মার্কস, অ্যাঙ্গেলস পড়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন লালন করেছিলেন একসময়, তিনিই অনির পিতা। অনি ছিল খুব শান্ত ছেলে, বাড়ির পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলে বড় হচ্ছিল। সময় সেই ১৯৭০-৭১। তখন যারা বড় হয়েছে, তারা অনেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে তাদের আগের প্রজন্মকে নিয়ে। সেই প্রশ্ন নিয়েই এই গল্প। গল্প আরম্ভ হয় অনির জিজ্ঞাসা নিয়ে, ‘তোমরাই বলতে না বাবা, বাংলাদেশের রেনেসাঁটা বোগাস?’
সত্তর দশকের সেই মূর্তি ভাঙার রাজনীতি নিয়ে পিতা-পুত্রের কথোপকথন। অনি তার মাকে বলেছিল, ‘বিদ্যাসাগরের চুষিকাঠি দিয়ে কদ্দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখবে মা?’
অনি তার বাবাকে বলে, ‘তোমাদের উনিশশ আটচল্লিশটা—যখন তোমরা সশস্ত্র বিপ্লব করতে নেমেছিলে—আর আজকের মধ্যে অনেক ফারাক। তখন তোমাদের পেছনে কেউ ছিল না, আর এখন সমস্ত পৃথিবীর মেহনতি মানুষ আমাদের পেছনে।’
সেই স্বপ্ন দেখেছিল অনি, যে স্বপ্ন দেখেছিল তার বাবাও, ওই বয়সে। বাবা ভয় পাচ্ছে। এক বছর ধরে কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না, ছোঁয়ার চেষ্টাও করছে না। অনির বয়সই তার রক্তকে ফোটাচ্ছে, এই রক্তফোটা দেশের ছেলেগুলোকে মণ্ডামিঠাই দিয়ে পুষে তিরিশ পার করাতে পারলেই হলো, তখন রক্ত ঠান্ডা হয়ে আসবে, কোনো কিছু করার আগে দুবার সে ভাববে। অনির বাবা, এই গল্পের কথক ভাবছে, এই কয়েকটা বছর, দশ-বারোটা বছর যদি লাফ দিয়ে পার হয়ে অনি বুড়ো হয়ে যেতে পারত...। এ দেশের তারুণ্য তো কখনোই পরিণতি পায় না, সেই ইংরেজের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় থেকেই সে এক অসমাপ্ত মহত্ত্বের প্রতীক মাত্র। অসমাপ্ত মহত্ত্বের শৌর্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে অনির বাবার। দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি আর দেখতে চান না। আর তাঁর না বলা কথাগুলোই যেন অনি বুঝতে পারে। তার পাতলা গোঁফের ফাঁকে যেন ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে। অনি যেন বলে, তার বাবা নিজের অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কেন না তার বাবা আর পলিটিক্যাল এলিমেন্ট নয়। বাবাদের সময় যেমন পুলিশের মার খেয়ে আন্দোলন গুটিয়ে গিয়েছিল, অনিদের সময়ও যেন তাই হবে? একবারও তাকিয়ে দেখছে না চারদিক।... অতীত পুজো করে কিছু হয় না। অনি যেন বলে, তারা যুদ্ধ শুরু করেছে, শেষ করবে। পড়তে পড়তে অসীম রায়ের ইতিহাস বোধে মাথা নত করতে হয়।
যৌবনের রক্ত অনির বাবাকে পথে নামিয়েছিল, তারপর রক্ত ঠান্ডা হলে সেই লোক দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়, কলকাতা করপোরেশনের এক ডেপুটি মেয়রকে ধরে চাকরিতে ঢুকে যায়। অনির বাবা ভাবছে, অনিদের বিপ্লবটা আর বছর পাঁচ বাদে এলে, তার রিটায়ারমেন্টের আগে করপোরেশনের বোস বাবুকে ধরে তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। তা আর হওয়ার নয়। বরং ভয় হয় ছেলেটাকে পাঁচ বছর বাঁচিয়ে রাখা যাবে তো। ভীরু আর সুযোগসন্ধানী, কোনোরকমে বেঁচে থাকা সেই মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টের ঘরে এখন মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের বইয়ে ধুলো পড়ে। বাবার মনে নানা প্রশ্ন, ব্যক্তিগত হত্যা, মূর্তি ভাঙা...সমস্ত। অনি শোনায়, ‘তুমি যা শিখেছ বাবা, সেগুলো ভুলে যাও, নতুন বিপ্লব ঘটছে চারপাশে, সেখানে তৈরি হচ্ছে বিচারের নতুন মানদণ্ড..।’
সমস্ত গল্পটিতে দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্ব, ভীরু পিতা বোঝায়, ‘অনি আর একটু সবুর কর। এ রকম আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের ভস্ম করে দিস নে। আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয় বছরের পর বছর।’ অনির ঠোঁটের কোণে সেই হাসি। কী বেদনাময় এই গল্প! এই গল্প যেমন রাজনীতির তেমন গভীর এক জীবনেরও। অনিকে শনাক্ত করতে যেতে হয়েছিল মর্গে। সেই অনি, যে লিখেছিল জীবনানন্দের সেই পঙক্তি তার রাফ খাতায়, ‘আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে।’ অনির মৃত্যু তো তার মৃত্যু নয়, ভীরু লোকটির সমাজবাদ স্বপ্ন দেখার মৃত্যু, লেনিনের মাও সেতুংয়ের মৃত্যু। এই গল্প এই এতটা বয়সে এসে, অনির পিতার ভূমিকায় পৌঁছে আরো নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। জীবন, জীবন, তুমি এমনি। কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাও। ফিরিয়ে নিয়ে আসো মর্গ থেকে গৃহকোণে।