প্রথম পর্ব
রবির জীবনে মৃত্যুশোক
মহাভারতের শান্তিপর্বের একটি শ্লোক রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন পত্রে উদ্ধৃত করেছেন, ‘সুখং বা যদি দুঃখং প্রিয়ং বা যদি বা প্রিয়ম। /প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়ে না পরাজিত।’ অর্থাৎ ‘সুখ বা হোক দুখ বা হোক। প্রিয় বা অপ্রিয়/অপরাজিত হৃদয়ে সব/বরণ করি নিয়ো’—স্মৃতি।
বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি শ্লোকটি উদ্ধৃত করে বলেন : ‘এই মন্ত্রটি আমি সর্ব্বদাই মনে রাখিতে চেষ্টা করি—কোনও ফল পাই নাই তাহা বলিতে পারি না। সংসারে যখন সুখ পাই তখন দুঃখের আবির্ভাবে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই। যত রকম দুঃখ ও অপ্রিয় সংসারে সম্ভবপর আমি সমস্তই মাঝে মাঝে মনে মনে প্রত্যাশা করিয়া মনকে সকল অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখিতে চেষ্টা করি।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় ৮০ বছরের জীবদ্দশায় অনেকের মৃত্যু দেখেছেন—জীবন-আদর্শ বাবা, পরম স্নেহময়ী মা, প্রিয় ভাই-বোন, প্রাণপ্রিয় বৌদি, প্রেমময়ী স্ত্রী, প্রিয়তম ছেলে, মেয়ে, নাতি, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন, নিকট বন্ধুসহ অনেকের। এ মৃত্যুর মধ্যে যেমন রয়েছে কাছের মানুষের মৃত্যু, তেমনই রয়েছে সহকর্মীর মৃত্যু এবং রাজনৈতিক বা অন্য ঘটনায় কারও-কারও মৃত্যু। সব মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া এক নয়। কোথাও তা গভীর শোকের—যেমন : কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু; কোথাও তা আত্মসংমের—যেমন : বেলার বা শমীর মৃত্যু; কোথাও ক্ষোভের—যেমন : যতীন দাসের মৃত্যু; কোথাও ধিক্কারের—যেমন : ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমায় ইংরেজ মহিলার মৃত্যু; কোথাও কর্তব্যবোধের—মৃত্যু, যেমন : চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু; কোথাও আনুষ্ঠানিক—যেমন : মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু; কোথাও আশ্চর্য নীরবতার—যেমন : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু।
মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ দেখতে চেয়েছেন মহিমান্বিত রূপে। মানবজীবনের সার্থকতাকে তিনি মৃত্যুর মাঝে খুঁজতে চেয়েছেন। কখনো বা চেষ্টা করেছেন জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সেতু নির্মাণ করার। ঈশ্বরের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো কারো কারো মৃত্যুকে ঈশ্বরের লীলা হিসেবে বিশ্বাস করেছেন। তিনি অনেক সময় মৃত্যুশোক সহ্য করার শক্তি প্রার্থনায় ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করেছেন একাগ্রচিত্তে। শোক পরীক্ষা করার মতো বিশ্বাস মনে স্থাপন করে তিনি শোকের বিহ্বলতা থেকে বাঁচতে চেয়েছেন নানাভাবে। মৃত্যুকে জীবনের চরম পরিণতি বলে কোনো দিনই মান্য করেননি তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর ১১ মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫ জানুয়ারি খ্রিস্টাব্দ, সোমবার শান্তিনিকেতনের মন্দিরে আয়োজিত উপাসনায় পঠিত রচনার মধ্যে। পরবর্তীকালে এ লেখাটি টীকাসহ ‘মৃত্যু’ নামে ‘ভারতী’ পত্রিকার মাঘ-সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে বলেছেন :
“সংসারের ভিতর মৃত্যুকে ক্ষতি বলে জানি, দুঃখ বলে জানি। জীবনের বিরুদ্ধ, অস্তিত্বের বিরুদ্ধ, ‘না’ বলেই জানি। সেই সঙ্কীর্ণ পরিধির আবেষ্টনে অমৃতের মধ্যে মৃত্যুর যে প্রতিষ্ঠা তা দেখতেই পাইনে। কাছের দিকটাতে চেয়ে দেখি মৃত্যু আমাদের পক্ষে প্রকাণ্ড অভাবের রূপ ধরে আসে, অথচ এই বিপুল বিশ্বসংসারের দিকে যখন তাকাই তখন দেখি তার জ্যোতি কোথাও ম্লান নয়, আনন্দের সঙ্গীত, সূর্য্যের মহিমা আকাশে বিস্তৃত, কোনও জায়গায় বিষাদের কোনও চিহ্ন নেই। ছন্দের মধ্যে যতি তার গতিকেই প্রকাশ করে। সেই সমাপ্তিগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে দেখলে অবসানকেই দেখি, গতিকে দেখি না; তখন সে কিছুই প্রকাশ করে না। ছন্দের সমাপ্তির মধ্যে যতিকে দেখলে বুঝি, তার মধ্যেই প্রাণের দোলা। বিপুল বিশ্বসংসারে বিস্তৃত করে মৃত্যুকে দেখলে বুঝি সে অবসান নয়। বুঝি যে, সমাপ্তির তালে তালে করতাল বাজিয়ে চলেছে চিরন্তর।... এই বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে অগ্নি সূর্য্য বায়ু যা কিছু সৃষ্টিকে ঘটিয়ে তুলচে এরা সবাই বিশ্বের গতিলীলার প্রকাশ; তারি সঙ্গে মিলিয়ে বলা হয়েচে, মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ—মৃত্যুও তাদেরই তালে তালে চলেছে; এ সংসারে প্রাণচাঞ্চল্যের যে পঞ্চায়েৎ বসেছে মৃত্যুও সেই পঞ্চায়েতের একজন। মৃত্যু তার বিরুদ্ধ নয়। সে যে সৃষ্টির চক্রকে অবরুদ্ধ করছে তা হতেই পারে না, সে তাকে আরও অগ্রসর করে দিচ্ছে। মৃত্যু যাঁর ছায়া, অমৃত যাঁর ছায়া সেই পরম আনন্দের মধ্যে যাঁরা মৃত্যুকে দেখেন তাঁদের ভয় থাকে না। ... মৃত্যু কোনও সূত্রকে ছিন্ন করবার জন্য নয়, সূর্য্য বায়ু জল প্রভৃতি অন্যান্য শক্তির মত সেও সৃষ্টির বাহন। সৃষ্টিকে সে রূপ থেকে রূপান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে—না হলে অচল রূপের চাপে সব পিষ্ট হয়ে যেত।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুর ছায়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল বলেন, “অনেক আত্মীয়-বন্ধুর মৃত্যুর ঘটনায় রবীন্দ্রনাথকে নীরব অচঞ্চল দেখে আমাদের অনেকের হয়তো মনে হয়, তিনি হয় নিষ্ঠুর নতুবা নির্বিকার—কিন্তু মৃত্যুকে যিনি দার্শনিক পটভূমিকায় দেখেন, তাঁকে বিচার করার মানদণ্ডটিই তো আলাদা হওয়া উচিত।”
সারদাসুন্দরী দেবী
রবীন্দ্রনাথের মা।
মৃত্যু : ২৭ ফাল্গুন, ১২৮১ বঙ্গাব্দ, ১০ মার্চ, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার; রাত ৩.৪৫ মিনিট, আনুমানিক ৪৯ বছর বয়সে।
রবীন্দ্রনাথের মায়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী গ্রন্থে বলেন : “রবীন্দ্রনাথের রচনায় মায়ের উল্লেখ অবিশ্বাস্য রকমে কম।... ছেলেদের দেখাশোনার ভার সারদা দেবীর উপর ছিল না, এবং প্রায় এক বৎসর যাবৎ অসুস্থতার জন্য মায়ের সঙ্গে আগে বালক রবীন্দ্রনাথের যেটুকু যোগাযোগ ছিল সেটুকুও অনেকখানি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। তাছাড়া বৃহৎ পরিবারের মধ্যে চাকর-দাসীদের তত্ত্বাবধানে থাকার জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় মায়ের অভাব খুব একটা বোধ করার কথা নয়।”
মাতৃমৃত্যুর বহু বছর পর ৯ আশ্বিন ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘মনে পড়া’ নামে তিনি একটি কবিতা লেখেন :
“মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে, যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে।”
মায়ের মৃত্যুকালে রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ১৩ বছর ১০ মাস। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের এক জায়গায় তিনি মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন :
“অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু, তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়—তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!’ তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন—পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপর শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না—সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। ... এইজন্য জীবনে প্রথম যে-মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল। ইহার পরে বড়ো হইলে যখন বসন্তপ্রভাতে একমুঠো অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম—তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত—আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম, যে-স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার আর অন্ত নাই—তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি।”
(চলবে)