রম্য
‘আল্লাহর কসম গেটলক’
ঢাকা শহরের যানজট আর যানবাহন নিয়ে সবারই কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে। রাস্তায় যাঁরা নামেন, মানে যাঁদের নামতে হয়, সবাই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। আর রাস্তায় তো সবাইকেই নামতে হয়। সুতরাং সবারই এ বিষয়ে ধারণা আছে। ঢাকার রাস্তা এবং সেই রাস্তার যানবাহন কী জিনিস, তা চিনতে কারোরই বাকি নেই। বোঝা শেষ।
নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা... এই যুগও এখন পুরোপুরি অতীত। কারণ, আকাশ ইদানীং খুব কমই নীল থাকে। মানুষ, ঢাকার রাস্তা এবং যানবাহনের মতো আকাশের রূপও প্রতিনিয়ত বদলায়। আর একা চলা? ওটার দিন কী আর আছে বলুন! যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে—রবীন্দ্রনাথের এই গান ভুলে যান। রবীন্দ্রনাথের সময় আর বর্তমান সময়ে বিস্তর ফারাক। তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনিও গানটি ঘুরিয়ে লিখতেন। ঢাকা শহরকে চিনতে আর বাকি নেই কিছু! তা সে রাত কিংবা দিন, যে সময়েই হোক না কেন! এই শহরে একা চলা আর রাস্তা কেটে কুমির আনা সমান কথা। এখানে মানুষ একা চলার সাহস হারাচ্ছে দিন দিন। ঠ্যাকা ছাড়া কেউ একা চলতে চায় না এই শহরে।
আবার পিচঢালা পথটাকেও আপনি খুব বেশি ভালোবাসতে পারবেন না। সুযোগ নেই। কারণ সেই পথ জুড়ে শুধুই যানজট। অবশ্য সবকিছুতেই জট পাকিয়ে ফেলা আমাদের স্বভাবের অংশ। আমরা জট পাকাতে ভালোবাসি। জট এবং ভজঘট আমাদের ভালোলাগার বিষয়। সে হিসেবে যান যেহেতু আছে, যানজট তো থাকবেই। সেটাই স্বাভাবিক। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। ঢাকার রাস্তায় নামলে এই সত্য আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
এক হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ধারণক্ষমতার অনেক বেশি যান চলাচল করছে রাস্তায়—চলাচলের অনুমতি নিয়ে এবং অনুমতি ছাড়াই। রাজধানী শহরে যেমন যানবাহন চলা উচিত না, তাও চলছে। মুড়ির টিন বলে একটি শব্দ তো মুড়ি ফেলে বাসের গায়ে ঝুলে পড়েছে বহুদিন আগে থেকেই। সেই মুড়ির টিনে চড়ে ‘যত ঝাঁকি তত নেকি’ সূত্র মেনে চলাচল করছি আমরা। গাড়ির এমনই দশা নামই হয়ে গেছে মুড়ির টিন।
এই শহরে হ্যামার চলছে, পোরশে চলছে, আবার মুড়ির টিনও চলছে। মিলেঝিলে সবই চলছে ঢাকার রাস্তায়। সুতরাং ঢাকা শহরে যানজট থাকবে না তো কি ভুরুঙ্গামারীতে থাকবে!
রাস্তার মানুষকে আমরা সহজে বিশ্বাস করতে চাই না। ধরা খেতে খেতে এটাই আমাদের উপলব্ধি। কারণ, প্রতারণার বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে রাস্তায়। আমরা ধরে নিই, চলতি পথে দেখা আর জীবনে কখনো দেখা হবে কি না, তার ভরসা কী! সুতরাং চান্স নেওয়া যায় একটা। সে কারণেই রাস্তায় দেখা হওয়া মানুষকে ঠকাতে চায় সবাই। আর ঠকতে ঠকতে আমরাও তাই রাস্তার কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করতে চাই না। আরো পরিষ্কারভাবে বললে, বিশ্বাসই করি না। রাস্তার মানুষের ভরসা কী! চলতি পথ মানেই আমাদের কাছে অনিশ্চয়তায় ভরা।
অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস আর নাভিশ্বাস থেকে রাস্তার সবকিছু থেকে আমাদের বিশ্বাস উঠে গেছে। এই যেমন রাস্তায় ট্রাফিক বাতি জ্বলে, লাল আর সবুজ। ড্রাইভাররা তা মানে না, বিশ্বাস করে না। মানুষেরই বিশ্বাস নেই, বাতির কী দাম। যে কারণে ট্রাফিক বাতির লাল আর সবুজের কী মানে, ভুলতে বসেছি আমরা। ঘটনা হয়ে যাচ্ছে তরমুজ খাওয়ার মতো। সেই যে একটা আইকিউ আছে না।
আমরা কখন লাল দেখলে থামি না, কিন্তু সবুজ দেখলে থেমে যাই?
—তরমুজ খাওয়ার সময়।
তরমুজ খাওয়ার পরিস্থিতিই এখন ঢাকার রাস্তায়। কোন বাতিতে যে কী কাজ হয়, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। শহরের লালবাত্তি জ্বালিয়ে যে-যার মতো চলছে। আর সে কারণেই দাঙ্গা কিংবা আর্মড পুলিশ না হয়েও ট্রাফিক পুলিশের হাতে সব সময় লাঠি থাকে।
এ সবকিছু মাথায় নিয়েই আমরা পথ চলছি। আমাদের পথ চলতে হয়। তা যত অনিশ্চয়তাই থাকুক। যত যানজট কিংবা ম্যানজটই থাকুক না কেন। বাঁচতে হলে চলতে হবে। সবকিছু মেনে নিয়ে এবং মাথায় নিয়েই আমরা চলছি।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। নতুন আইডিয়া নিয়ে এসেছে কোম্পানি। নতুন কোম্পানি নতুন সার্ভিস। নতুন আইডিয়া। বিন্দাস।
সার্ভিসের নাম সিটিং গেটলক সার্ভিস। অর্থাৎ যাত্রী ছাউনি থেকে ছাড়ার পর গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এমনই বন্ধ হবে যে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছানোর আগে সেই গেট আর খুলবে না। কোম্পানির মানুষের ভাষায়, ‘ভূমিকম্প হয়ে যাবে, কিন্তু গাড়ির বন্ধ গেট বন্ধই থাকবে। খোলা হবে না।’ তবে কেউ নামতে চাইলে খোলা হবে, তবে নতুন করে যাত্রী ওঠানো হবে না। আর সব যাত্রী ভ্রমণ করবেন বসে বসে। বাসে উঠে কেউ আগের প্রজন্মকে স্মরণ করবে না। অর্থাৎ বানর ঝোলা হয়ে যেতে হবে না।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের যাত্রীরা আশার আলো দেখলেন। যাক, এত দিনে একটা ব্যবস্থা হলো। গাড়ির যা অবস্থা, তাতে ৩০ মিনিটের পথ যেতেই এতদিন লাগত দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে জ্যামের কারণে আধঘণ্টা দেরি কনফার্ম। আর বাকি এক ঘণ্টা গাড়িগুলো বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে যাত্রী তোলার কারণে। যাঁদের সময়ের মূল্য আছে (সময়ের দাম কার নেই!) তাঁরা ভীষণ ত্যক্ত-বিরক্ত। এত দিনে তাঁরা হাঁফ ছাড়লেন। যাক, অবশেষে একটা গতি হলো। গেটলক সার্ভিস। টাকা বেশি নেক সমস্যা নেই। কিন্তু সময়টা তো বাঁচল।
নতুন সার্ভিস অল্প সময়ের মধ্যে সবার নজর কাড়ল। সবাই চড়ে তাতে। কিন্তু একটা সময়ে দেখা গেল, সার্ভিসের নামটাই শুধু গেটলক আর সিটিং আছে। কিন্তু কথা আর কাজে কোনো মিল নেই। গুলিস্তান থেকে গাড়ি ছাড়ে, কিন্তু গেট লক হয় না। মোড়ে মোড়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। পারে তো রাস্তা থেকে যাত্রীর কলার ধরে টেনে গাড়িতে ওঠায়। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসে। যেই ম্যাংগো সেই আম অবস্থা। মোড়ে মোড়ে একই ঘটনা। লোকজন মহা বিরক্ত। কী কথা আর কী কাজ!
একদিন এক যাত্রী ধরে বসলেন কন্ডাক্টরকে—
এই কন্ডাক্টর, কী, বিষয় কী? গেটলক কইয়া ওঠাও, গেটলক হয় না ক্যান? দরজার মুখ বন্ধ করো। মুখ বন্ধ।
ভাই, গেটের লক নষ্ট। তাই গেট লক হয় না। কন্ডাক্টর জবাব দেয়।
ফাইজলামি পাইছো মিয়া, লক নষ্ট...
না ভাই, ফাইজলামি না। সত্যই। আপনে আইসা দেহেন লক নষ্ট। ছিটকিনির খাপ আছে, কিন্তু মেশিন নাই। লকে তাই কাজ করে না।
লক ঠিক করাও না কেন?
মালিকরে কইছি।
ওই ব্যাটা, ছিটকিনি ঠিক করতে মালিক লাগে...। লোক উঠাইতে তো মালিক লাগে না।
ছিটকিনি ঠিক করতে কী লাগে, তা ওই কন্ডাক্টরের ভালো করেই জানা আছে। তার চেয়েও ভালো জানা আছে ছিটকিনি নষ্ট থাকলে কী কী সুবিধা পাওয়া যায় তা। সুতরাং নষ্ট ছিটকিনি ভালো হয় না। উল্টো একদিন দেখা যায় ছিটকিনি তো ছিটকিনি, গাড়ির দরজার একপাশই নেই। দরজার এক কপাট নিয়ে চলছে গাড়ি।
এভাবে করতে করতে একদিন এই গেটলক সার্ভিসের ‘লাক’ খারাপ হয়ে গেল। লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিল। তাদের প্রতি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস দুটোই উঠে গেল। লোকজন বিরক্ত হয়ে গেটলক সার্ভিসে চড়া বন্ধ করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়।
বাধ্য হয়ে ব্যবসার পলিসি বদলাল তারা। নতুন নাম নিয়ে রাস্তায় নামল বাস কোম্পানি।
এবার শুধু গেটলক না।
এবার সার্ভিসের নাম ‘আল্লার কসম গেটলক’।
বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য এর চেয়ে বড় ওষুধ আর কী হতে পারে।
কিন্তু কসম কেটে লাভ হলো না। সব সময় সব ওষুধ কাজ করে না। তাদের লাটের ব্যবসা লাটে উঠেই বসে থাকল। নামল না। কারণ বিশ্বাস এমনই এক জিনিস, একবার উঠে গেলে তা আর জোড়া লাগে না। আবার বিশ্বাসেই মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
তো, বিশ্বাস নিয়ে একদিন আমাদের এক পরিচিত মহিলা বাসে চড়ে বসলেন। তিনি সাধারণত বাসে চড়েন না। বাধ্য হয়েই চড়লেন। নিউমার্কেট টু মিরপুর রুটের একটি বাস সার্ভিস। বাসে চড়ে তার ভালোই মনে হলো। সিটিং সার্ভিস। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় না। স্টপেজ ছাড়া রাস্তা থেকে লোক ওঠায় না। কেউ নামতে চাইলে শুধু নামিয়ে দেয়। চিটিংবাজি কম। একটি বিষয় শুধু তার পছন্দ হলো না। বাসের মধ্যে লেখা কিছু কথায় মারাত্মক বানান ভুল। এই যেমন—‘৫০০ ও ১০০ টাকার ভাংচি নাই’, ‘পকেট সাপধান’, ‘অপরিচিত কারো দেয়া কিচু খাইবেন না’। তিনি মনে মনে হাসলেন। বানান ভুল ছাড়া বাসটির অন্য সবকিছু ভদ্র মহিলার ভালোই লাগল।
তিনি নামবেন মিরপুর ২ নম্বরে। আগে থেকেই কন্ডাক্টরকে জানিয়ে রাখলেন। তাঁকে যেন নামিয়ে দেয়া হয়। মিরপুর-১-এ এসে তাগাদা দিলেন। এই আমাকে কিন্তু মিরপুর-২-এ নামিয়ে দিও।
সময়মতো মহিলা সিট থেকে উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
মিরপুর ২ নম্বর চলে এসেছে। ভদ্র মহিলা কন্ডাক্টরকে খোঁচা দিলেন। কন্ডাক্টরও ড্রাইভারকে আওয়াজ দিল...
ওস্তাদ থামবে, ২ নাম্বার লেডিস নামবে।
নামা ভুলে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রমহিলা।
নাম্বারিংয়ের উল্টা-পাল্টার কারণে মহিলার সমস্ত ভালো লাগাবোধ মুহূর্তেই নাই হয়ে গেল।