ষষ্ঠ পর্ব
রবির জীবনে মৃত্যুশোক
রজনীকান্ত সেন
কবি, সম্পাদক, সমালোচক।
মৃত্যু : ২৮ ভাদ্র ১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার। গলায় দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে।
২১ অগ্রহায়ণ ১৩১৫ বঙ্গাব্দ, ৬ ডিসেম্বর ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের নতুন ভবন উদ্বোধনের দিন রবীন্দ্রনাথের সাথে রজনীকান্ত সেনের পরিচয় হয়। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’ গানটির সুর অবলম্বনে রজনীকান্ত সেন ‘শুনাও তোমার অমৃত বাণী’ শিরোনামে একটি গান লেখেন, যা ‘সুপ্রভাত’-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। হাসপাতালের পরিবেশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ছিল প্রচণ্ড মানসিক অস্বস্তি। তা সত্ত্বেও তিনি ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ১১ জুন ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার সকালে মেডিকেল কলেজে যান এই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ভক্তকবির’ সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেই সাক্ষাতের পর ১৬ আষাঢ় ১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ৩০ জুন ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার রবীন্দ্রনাথ রজনীকান্ত সেনকে একটি চিঠিতে তাঁর অনুভূতির কথা প্রকাশ করেন এভাবে :
“সেদিন আপনার রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর তাহাকে আপনার সমস্ত অস্থিমাংস, স্নায়ুপেশী দিয়া চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াও কোনোমতে বন্দী করিতে পারিতেছে না, ইহাই আমি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম। মনে আছে, সেদিন আপনি আমার ‘রাজা ও রানী’ নাটক হইতে প্রসঙ্গক্রমে নিম্নলিখিত অংশটি উদ্ধৃত করিয়াছিলেন—
এ-রাজ্যেতে
যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার,
যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে
পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে
ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়!
[২য় অঙ্ক, ৪র্থ দৃশ্য]
ঐ কথা হইতে আমার মনে হইতেছিল, সুখদুঃখ-বেদনার পরিপূর্ণ এই সংসারের প্রভূত শক্তির দ্বারাও কি ছোটো এই মানুষটির আত্মাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না? শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই, কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সংগীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই, পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। কাঠ যতই পুড়িতেছে, অগ্নি আরো তত বেশি করিয়াই জ্বলিতেছে। আত্মার এই মুক্তস্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে? মানুষের আত্মার সত্য প্রতিষ্ঠা যে কোথায়, তাহা যে অস্থিমাংস ও ক্ষুধাতৃষ্ণার মধ্যে নহে, তাহা সেদিন সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া আমি ধন্য হইয়াছি। সছিদ্র বাঁশির ভিতর হইতে পরিপূর্ণ সংগীতের আবির্ভাব যেরূপ, আপনার রোগক্ষত-বেদনাপূর্ণ শরীরের অন্তরাল হইতে অপরাজিত আনন্দের প্রকাশও সেইরূপ আশ্চর্য।”
এ চিঠির প্রায় আড়াই মাস পর রজনীকান্তের মৃত্যু হয়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
কবি ও গীতিকার। ডি. এল. রায় নামে সর্বাধিক পরিচিত। একসময় রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়ে।
মৃত্যু : ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০ বঙ্গাব্দ, ১৭ মে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুর পর দেবকুমার রায়চৌধুরী তাঁর জীবনচরিত রচনা করেন। সেই জীবনীগ্রন্থের ভূমিকা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি লেখেন : ‘দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনও তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই। আর যাহা কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র, তাহার সম্পূর্ণ কারণ নির্ণয় করিতে আমি তো পারি নাই, আর কেহ পারেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না।’
শান্তা দেবী
সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহধন্যা ছিল।
মৃত্যু : ৮ ফাল্গুন ১৩২২ বঙ্গাব্দ, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ। বসন্ত রোগে।
শান্তা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্নেহ করতেন। স্নেহধন্যা এই কন্যাসম মেয়েটির অকালমৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড আঘাত পান। তার মৃত্যুর পর সত্যপ্রসাদকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘আমার মনে একটি কথা চিরদিন থাকবে যে, ঠিক পৃথিবী থেকে চলে যাবার আগেই আমি যে তার পুণ্যহস্তের সেবা গ্রহণ করেছিলুম তার মূল্য নেই। তার সেই সেবাসুধাধারার সেচনে সেই কয়দিনে বহুকাল পরে আমার মধ্যে আশ্চর্য্য কবিত্বের বিকাশ ঘটেছিল। সেই সময়ে ‘ছবি’ ‘তাজমহল’ প্রভৃতি যেসব কবিতা লিখেছিলুম তা পড়ে পাঠকরা বিস্মিত হয়েছিল। এমন একটি গভীর আনন্দ হৃদয়ের মধ্যে পেয়েছিলুম যে আমার ভিতরে যেন একটি অকালবসন্তে যৌবনের পূর্ণ কবিত্ব আবার তেমনি প্রাচুর্য্যের সঙ্গে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। আমার জীবনে কল্যাণী লক্ষ্মীর সেই সেবামৃতের প্রভাব সেই কয়েকদিনের কবিত্বে স্থায়ী হয়ে রইল, আমি নিশ্চয় জানি আমাদের সাহিত্যেও সেগুলো স্থায়ী হয়ে থাকবে।’
মাধুরীলতা দেবী (বেলা)
রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে।
মৃত্যু : ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৫ বঙ্গাব্দ, ১৬ মে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, সকালে।
মাধুরীলতা দীর্ঘদিন ক্ষয়রোগে পীড়িত ছিলেন। সেকালের চিকিৎসাশাস্ত্রে এ রোগের কোনো প্রতিকার ছিল না। এ কারণে কন্যার মৃত্যুর জন্য একপ্রকার মানসিক প্রস্তুতি রবীন্দ্রনাথের ছিল বলে ধারণা করা হয়।
১০ আষাঢ় ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, ২৪ জুন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার কাদম্বিনী দত্তকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘আমার বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে ক্ষয়রোগে ধরিয়াছে। সেই জন্য উদ্বিগ্ন আছি। বোধ করি কিছুকাল কলিকাতায় থাকিতে হইবে অথবা বায়ুপরিবর্তনের জন্য তাহাকে লইয়া অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন হইবে।’
জে. ডি. অ্যান্ডারসনের চতুর্থ পুত্র যুদ্ধে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে পড়ার সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ১১ শ্রাবণ ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, ২৭ জুলাই ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে কন্যার মৃত্যুকে স্মরণ করে তাঁকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছেন : ‘Its must be very like the period of incessant torment which I have lately gone through when my daughter lay suffering from a mortal illness. I had been expecting her death everyday; all the same, death is a terrible surprise whenever it comes. Our love refuses to believe in its truth and yet has to accept its as a fact. Through my repeated experiences I have come to know that there must be a harmony between life and death in a great truth where they both are one.”
মাধুরীলতার মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেন, ‘কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা বেলার মৃত্যু হইল (২ জ্যৈষ্ঠ [১৩২৫ বঙ্গাব্দ], ১৬ মে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ)। কিছু কাল তিনি কঠিন রোগে ভুগিতেছিলেন। ১৯১২ সাল হইতে শরৎচন্দ্র [শরৎকুমার চক্রবর্তী] পৃথক বাসা করিয়া কলিকাতায় থাকিতেন। নানা কারণে ঠাকুরবাড়ির সহিত তাঁহার সম্বন্ধ শিথিল হইয়া আসিয়াছিল। কন্যাকে দেখিতে কবি প্রায়ই দুপুরে যাইতেন; যখন জামাতা থাকিতেন হাইকোর্টে। ২ জ্যৈষ্ঠ [১৩২৫ বঙ্গাব্দ] দুপুরে গিয়া শুনিলেন, বেলার মৃত্যু হইয়াছে। কবি মৃত কন্যাকে না দেখিয়াই ফিরিয়া আসিলেন। বৈকালে ‘বিচিত্রা’ ভবনে গিয়া দেখি তিনি অন্যদিনের ন্যায়ই স্বাভাবিকভাবে সকলের সঙ্গে গল্পগুজব করিতেছেন। এত বড় শোকের কোনো চিহ্ন বাহিরে নাই। অথচ কবি বেলাকে যে কী ভালোবাসিতেন তাহা তাঁহার পরিবারের লোকদের নিকট শুনিয়াছি। কয়েকদিন পূর্বে তিনি শান্তিনিকেতন হইতে এক পত্রে রথীন্দ্রনাথকে লিখিয়াছিলেন, ’জানি, বেলার যাবার সময় হয়েছে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই। এখানে আমি জীবন-মৃত্যুর উপরে মনকে রাখতে পারি, কিন্তু কলকাতায় সে আশ্রয় নেই। আমি এইখানে থেকে বেলার জন্যে যাত্রাকালের কল্যাণ কামনা করছি। জানি আমার আর কিছু করবার নেই।’ কন্যার মৃত্যুর পর কোনো শোক প্রকাশ নাই, একটি মাত্র কবিতায় চরম কথাটি বলিয়াছেন—
এই কথা সদা শুনি, ‘গেছে চলে’, ‘গেছে চলে।’
তবু রাখি ব’লে
বোলো না, ‘সে নাই।’
সে-কথাটা মিথ্যা, তাই
কিছুতেই সহে না যে,
মর্মে গিয়ে বাজে।
মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে।
তাই তার ভাষা।
বহে শুধু আধখানা আশা।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে-সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।
এই ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’ পলাতকা কাব্যের শেষ কবিতা।
১১ শ্রাবণ ১৩২৫ বঙ্গাব্দ, ২৭ জুলাই ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ তিনি রাণু দেবীকে লিখেছেন :
‘আমার খুব দুঃখের সময়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে; আমার যে মেয়েটি সংসার থেকে চলে গেছে সে আমার বড় মেয়ে, শিশুকালে তাকে নিজের হাতে মানুষ করেছি; তার মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পৃথিবীতে খুব অল্প দেখা যায়। কিন্তু সে যে মুহূর্ত্তে আমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্ত্তেই তুমি আমার কাছে এলে, আমার মনে হল যেন এক স্নেহের আলো নেবার সময় আর এক স্নেহের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। আমার কেবল নয়, সেদিন যে তোমাকে আমার ঘরে আমার কোলের কাছে দেখেচে তারই ঐ কথা মনে হয়েচে। তাকে আমরা বেলা বলে ডাকতুম, তার চেয়ে ছোট আর এক মেয়ে আমার ছিল তার নাম রাণু, সে অনেক দিন হল গেছে। কিন্তু দুঃখের আঘাতে সে অবসাদ আসে তা নিয়ে ম্লান হতাশ্বাস হয়ে দিন কাটালে ত আমার চলবে না। কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতেই হবে। ...সেই জন্যই খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল ও সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহূর্ত্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেলে, আমি প্রসন্নচিত্তে আমার ঠাকুরের সেবায় লেগে গেলুম।’
সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত বড় ভাই।
মৃত্যু : ১৬ মাঘ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, ৩০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বইটিতে সোমেন্দ্রনাথের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তার বাইরে অন্য কোথাও তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু আলোচনা পাওয়া যায় না।
রবীন্দ্র-গবেষকদের অনুমান, রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই ভাইটির সামাজিক কর্মকাণ্ডকে স্মরণ রেখেই ‘পাগল’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যা পরে ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই প্রবন্ধের এক জায়গায় শ্রাবণ ১৩১১ বঙ্গাব্দে তিনি উল্লেখ করেন : ‘পাগলও ইঁহারই কীর্তি এবং প্রতিভাও ইঁহারই কীর্তি। ইঁহার টানে যাহার তার ছিঁড়িয়া যায় সে হয় উন্মাদ, আর যাহার তার অশ্রুতপূর্ব সুরে বাজিয়া উঠে সে হইল প্রতিভাবান! পাগলও দশের বাহিরে, প্রতিভাবানও তাই; কিন্তু পাগল বাহিরেই থাকিয়া যায়, আর প্রতিভাবান দশকে একাদশের কোঠায় টানিয়া আনিয়া দশের অধিকার বাড়াইয়া দেন।’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কবি। অক্ষয়কুমার দত্তের নাতি। ছন্দের জাদুকর হিসেবে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন।
মৃত্যু : ১০ আষাঢ় ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ২৪ জুন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার। মাত্র ৪১ বছর বয়সে।
২৭ আষাঢ় ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ১১ জুলাই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার রামমোহন লাইব্রেরিতে সত্যেন্দ্রনাথের স্মরণে এক সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। ২৯ আষাঢ় ১৩২৯ বঙ্গাব্দ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এ আয়োজনটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘...শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় স্বর্গীয় কবির মৃত্যুতে মনে এত আঘাত পাইয়াছেন যে স্বর্গীয় কবির কথা বলিবার সময় তাঁহার কণ্ঠরুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। তিনি বলেন, সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি হিসাবে তাঁহার সে সম্বন্ধ, তাহা অপেক্ষা অন্তরতর বন্ধু সম্বন্ধই নিবিড়তর ছিল। সভা করিয়া সত্যেন্দ্রনাথের জন্য শোক প্রকাশ করা তাঁহার ইচ্ছা ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে তিনি ঠিক আত্মীয় বিয়োগ ব্যথাই অনুভব করিয়াছেন। কেহ কেহ বলেন যে, বাঙ্গলা ভাষা ও ছন্দের উপর তাঁহার যে আধিপত্য ছিল, তাহা একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই তুলনা হইতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, ’আমি মুক্তকণ্ঠে এবং কিছুমাত্র বিনয় প্রকাশ না করিয়া বলিতেছি যে, বাঙ্গলা ভাষা ও ছন্দের উপর সত্যেন্দ্রনাথের যে অসামান্য অধিকার ছিল, তাহা আর কাহারও সঙ্গেই তুলনীয় নহে।’
রবীন্দ্রনাথ ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ শিরোনামে একটি সুদীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। সেই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি স্নেহভাজন সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যে শোক অনুভব করেছিলেন তা ব্যক্ত করেছেন অকপটে। কবিতাটি তিনি লিখেছেন ১৮ আষাঢ় ১৩২৯ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ কবি সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৮ দিন পর। কবিতাটির অংশবিশেষ এ রকম :
‘জানি তুমি প্রাণ খুলি
এ সুন্দরী ধরণীরে ভালোবেসেছিলে। তাই তারে
সাজায়েছ দিনে দিনে নিত্য নব সংগীতের হারে।
অন্যায় অসত্য যত, যত কিছু অত্যাচার পাপ
কুটিল কুৎসিত ক্রূর, তার ‘পরে তব অভিশাপ
বর্ষিয়াছ ক্ষিপ্রবেগে অর্জুনের অগ্নিবাণ-সম;
তুমি সত্যবীর, তুমি সুকঠোর, নির্মল, নির্মম,
করুণ, কোমল। তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী ’পরে
একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে।
...
ধরণীতে প্রাণের খেলায়
সংসারের যাত্রাপথে এসেছি তোমার বহু আগে,
সুখে দুঃখে চলেছি আপন মনে; তুমি অনুরাগে
এসেছিলে আমার পশ্চাতে, বাঁশিখানি লয়ে হাতে।
মুক্ত মনে, দীপ্ত তেজে, ভারতীর বরমাল্য মাথে।
আজ তুমি গেলে আগে; ধরিত্রীর রাত্রি আর দিন
তোমা হতে গেল খসি, সর্ব আবরণ করি লীন
চিরন্তন হলে তুমি, মর্ত কবি, মুহূর্তের মাঝে।
গেলে সেই বিশ্বচিত্তলোকে, যেথা সুগম্ভীর বাজে
অনন্তের বীণা, যার শব্দহীন সংগীতধারায়
ছুটেছে রূপের বন্যা গ্রহে সূর্যে তারায় তারায়।
সেথা তুমি অগ্রজ আমার; যদি কভু দেখা হয়,
পাব তবে সেথা তব কোন অপরূপ পরিচয়
কোন ছন্দে, কোন রূপে? যেমনি অপূর্ব হোক-নাকো,
তবু আশা করি যেন মনের একটি কোণে রাখ
ধরণীর ধূলির স্মরণ, লাজে ভয়ে দুঃখে সুখে
বিজড়িত, আশা করি, মর্তজন্মে ছিল তার মুখে
যে বিনম্র স্নিগ্ধ হাস্য, যে স্বচ্ছ সতেজ সরলতা,
সহজে সত্যের প্রভা, বিরল সংযত শান্ত কথা,
তাই দিয়ে আরবার পাই যেন তব অভ্যর্থনা
অমর্তলোকের দ্বারে, ব্যর্থ নাহি হোক এ কামনা।
(চলবে)