সপ্তম পর্ব
রবির জীবনে মৃত্যুশোক
সুকুমার রায়
বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথের খুবই স্নেহধন্য ছিলেন।
মৃত্যু : ২৪ ভাদ্র ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার। মাত্র ৩৫ বছর ১০ মাস বয়সে।
১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। সেই দিন সকালে সুকুমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় আড়াই বছর ধরে তিনি দুরারোগ্য কালাজ্বরে ভুগছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে আসার আগে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী সুকুমারের অনুরোধে তিনি ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। / তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’ ও ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো গভীর শান্তি এ যে / আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে উঠল কোথায় বেজে॥’ এ গান দুটি গেয়ে শোনান। শেষোক্ত গানটি রবীন্দ্রনাথকে দুইবার গেয়ে শোনাতে হয়েছিল বলে জানা যায়। ২৬ ভাদ্র ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার মন্দিরের উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘মানুষ যখন কঠিন রোগে পীড়িত তখন মৃত্যুর সঙ্গে তার প্রাণশক্তির সংগ্রামটাই সকলের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্যান্য জীবের মতো মানুষ তো কেবল প্রাণী নয়, মৃত্যুকে অমৃতলোকে উত্তীর্ণ করে দেওয়ার পাথেয় নিয়ে সে জন্মায়। আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি এই কথাই বারবার আমার মনে হয়েছে।’
সুকুমারের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। শান্তিনিকেতনে সুকুমারের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছানোর পরদিন রবীন্দ্রনাথ সুকুমারের স্ত্রী সুপ্রভাকে একটি পত্র লেখেন। পত্রটি এরূপ :
কল্যাণীয়াসু,
তোমার এই গভীর শোকে তোমাকে সান্ত্বনা দেবার যোগ্য কোনো কথা আমি জানিনে। দুই বৎসরের অধিককাল অক্লান্ত যত্নে নিরন্তর তুমি তোমার স্বামীর সেবা করে এসেচ। তোমার শুশ্রূষার সেই পবিত্র ছবিটি আমি কখনও ভুলব না। আজ তোমার অন্তর্যামী তোমার আহত হৃদয়ের শুশ্রূষার ভার গ্রহণ করুন। আমি রোগশয্যায় যখনি সুকুমারকে দেখতে গিয়েচি আমার অনেক সময় মনে হয়েচে যে, তোমরা যারা নিয়ত তাঁর সেবার ভার নিয়েচ তোমরা ধন্য, কেননা, দুঃসহ ও সুদীর্ঘকালব্যাপী রোগতাপের ভিতর দিয়ে মানুষের এমন আশ্চর্য মাহাত্ম্যের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না। আমি নিশ্চয় জানি তাঁর মৃত্যুশয্যা থেকে তোমার জীবনের একটি মহৎ দীক্ষা তুমি লাভ করেচ, আজ দুর্দিনে সেই দীক্ষাই তোমাকে রক্ষা করবে। রোগের পীড়নের মধ্যে তাঁর অক্ষুব্ধ ধৈর্য ও চিরপ্রসন্নতা, মৃত্যুর ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়েও ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা, দিব্যবাণীর মতো বারবার আমার চিত্তকে অধিকার করেচে, আসন্ন মৃত্যুর কুহেলিকা ভেদ করে’ অপরাজিত আত্মার এই জ্যোতির্ময় মূর্তিটি দেখতে পেয়েচি। এঁকে আমি সৌভাগ্য বলে মনে করি। মৃত্যুকে তিনি মহীয়ান করে, তাকে অমৃতলোকের সিংহদ্বার করে দেখিয়ে গেছেন, আমরা যারা মর্ত্যলোকে আছি, আমাদের প্রতি তাঁর এই একটি মহার্ঘ্য দান। এই কথা স্মরণ করে’ তুমি সান্ত্বনা লাভ কর; ঈশ্বর তোমার শান্তি দিন, তোমার শোককে কল্যাণে সার্থক করুন।
এই আমার অন্তরের কামনা।
ইতি ২৪শে ভাদ্র, ১৩৩০ [বঙ্গাব্দ]
ব্যথিত
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুকুমারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন : ‘আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি এই কথাই আমার মনে হয়েচে, জীবলোকের ঊর্ধ্বে অধ্যাত্মলোক আছে, যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয় বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন অমৃতধামের তীর্থযাত্রায়, তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেচি। কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো, অল্পকালের আয়ুটুকু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর-কাউকে দেখিনি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন; তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েচে।’
উইলিয়ম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সন
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বলাকা’ কাব্যটি এই বিদেশি বন্ধুটিকে উৎসর্গ করেন।
মৃত্যু : ৮ আশ্বিন ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ। রেল দুর্ঘটনায়।
বন্ধু বেটম্যানকে নিয়ে ট্রেনে করে মিলার শহর থেকে ফ্লোরেন্সের দিকে যাচ্ছিলেন পিয়ার্সন। একসময় জানালা দিয়ে ঝুঁকে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে গিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যান তিনি। রেললাইনের ধারে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে রেলের কয়েকজন শ্রমিক তাঁকে একটি ভিলায় নিয়ে আসে। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হয় পিস্টোরিয়ার একটি হাসপাতালে। কয়েক দিন তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া করেছিলেন কি না জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, পরের দিন একটি তারিখবিহীন চিঠিতে বন্ধু রোদেন স্টাইনকে সংক্ষেপে লেখেন :
‘I do not know if you have heard of Pearson’s death from accident in Italy. It is a great loss to our Ashram and to me personally, to which it will be hard for us to be reconciled.’
৯ পৌষ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ, ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত আশ্রমবাসীদের স্মরণসভায় পিয়ার্সনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘... আমাদের যে বন্ধুর আগমনের জন্যে আমরা কিছুকাল ধরে প্রতীক্ষা করছিলুম, কিন্তু যাঁর আর আসা হল না সেই অকাল-মৃত্যুগ্রস্ত আমাদের পরম সুহৃৎ পিয়ার্সনের কথা আজ বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। তিনি চলে যাওয়ার ক্ষতির কথা কিছুতে আমরা সহজে ভুলতে পারি নে। কিন্তু তাঁকে কেবল এই ক্ষতির শূন্যতার মধ্যে দেখলে ছোটো করে দেখা হবে। আমাদের যে ধন বাইরের জিনিস বাইরে থেকে যাবামাত্রই তার ক্ষতি একান্ত ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যাঁর জীবন নিজের আমি-গণ্ডিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যিনি কেবল নিজেরই মধ্যে বেঁচে ছিলেন না মৃত্যুর দ্বারা তাঁর বিনাশ হবে কী করে?
... এখানকার ছাত্র অধ্যাপক যাঁরা তাঁর বন্ধুত্বের ও প্রেমের আস্বাদ পেয়েছেন তাঁরাই জানেন যে কী পবিত্র দান তিনি চারি দিকে রেখে গেছেন। তিনি এখানকার সাঁওতালদের একমাত্র বন্ধু ছিরেন, নিজে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের মধ্যে কাজ করেছেন। আজ সেই-সব সাঁওতালরাই জানে যে কী সম্পদ তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি এই সাঁওতালদের আর আশ্রমের শিশুদের সেবা করতে গিয়ে যে মহাসম্পদ লাভ করেছেন তা অতি মহামূল্য, তা সস্তায় পাওয়া নয়। তিনি সমস্ত দান করে তবেই সমস্ত গ্রহণ করতে পেরেছেন, জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করে নিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর মহৎজীবনকে পরিপূর্ণ করে সেই দান গ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনের পাত্র তাতে ভরপুর হয়ে উপছে পড়েছে, তিনি তার আনন্দে অধীন হয়েছেন।
... আজ আমাদের তাঁর জীবনের এই কথাই স্মরণ করতে হবে তিনি যেমন বড়ো দান রেখে যেতে পেরেছেন তেমনি বড়ো সম্পদ পেয়ে গেছেন। তাঁর জীবনের এই মহত্ত্বকে শ্রদ্ধা করতে পারলেই তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হবে। আশ্রমে যে সত্য কালে কালে ক্রমে ক্রমে পূর্ণ প্রকাশের মধ্যে উদঘাটিত হয়ে উঠেছে, পিয়ার্সন সাহেব তাকে জীবনে স্বীকার করে নিয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সাক্ষ্য রেখে গেছেন।’
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি, গীতিকার ও নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বড় ভাই।
মৃত্যু : ২০ ফাল্গুন ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ মার্চ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার। ৭৬ বছর বয়সে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রশান্তকুমার পাল উল্লেখ করেন, ‘রাঁচিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনাবসান হয় ৭৬ বৎসর বয়সে। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন : জ্যোতিকামশায় যে কতদিন হার্নিয়ায় ভুগছেন, সে জিনিসটা যে কী তা পর্যন্ত মা জানেন না। ... আর তিনিও ঐ রোগ নিয়ে বছরের পর বছর কী ক’রে যে একলা ঐ পাহাড়ের উপর কাটিয়ে গেলেন, একটা চাকর ডাকবার দরকার হলেও পাহাড়ের মাঝরাস্তার ছোটো বাড়ি থেকে ঘণ্টা বাজিয়ে তবে তাকে আনতে হত। এও আর-এক আশ্চর্য ব্যাপার। অথচ ঐ অন্ত্র বেরিয়ে পড়লে যে কত শীঘ্র কত সাংঘাতিক অবস্থা হ’তে পারে তা কি আর তিনি বুঝতেন না? অথচ একলা থাকতে তো কোনো ভয়ডর ছিল না। যে-ঘণ্টা জাপান থেকে রবিকা এনে দিয়েছিলেন, তার চেহারা এখনো চোখে ভাসছে, আর শেষদিন বেলা পাঁচটা পর্যন্তও সেই ঘণ্টা নিজের হাতে বাজিয়েছেন, তার আওয়াজ এখনো কানে বাজছে, অথচ ছ’টার সময় সব শেষ হয়ে গেল।’
চৈত্র-সংখ্যা শান্তিনিকেতনে লেখা হয় : ‘শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে আশ্রমে একদিন অনধ্যায় ছিল। এতদুপলক্ষ্যে প্রাতঃকালে মন্দিরে উপাসনা হয় এবং সন্ধ্যায় একটি সভায় হয়। তাহাতে শ্রদ্ধেয় রামানন্দ বাবু, নেপালবাবু ও এগুরুজ সাহেব জ্যোতিরিন্দ্র বাবুর জীবনী সম্বন্ধে আলোচনা করেন। কিন্তু এই প্রিয় দাদার মৃত্যু উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এইসব প্রকাশ্য সভায় যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায় না।’
(চলবে)