শেষ পর্ব

রবির জীবনে মৃত্যুশোক

Looks like you've blocked notifications!

চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ

খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও সমাজসেবক। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী।

মৃত্যু : ৫ এপ্রিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ।

এন্ডরুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন অত্যন্ত পীড়িত, তখন রবীন্দ্রনাথ নিজের চরম শারীরিক অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে তাঁকে দেখতে কলকাতা যান। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন তা জানা যায় অনেক পরে। এ প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লেখেন : ‘কলিকাতায় গেলে পাছে লোকে উপদ্রব করে, এই ভাবনা হইতে কাগজপত্রে কবির আগমন ঘোষিত হয় নাই। রবীন্দ্রনাথ যখন এন্ডরুজকে দেখিতে গেলেন তখন তিনি সংজ্ঞাহীন, দুই-একটি কথা বলিবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্যও তখন খুবই খারাপ। অথচ কলিকাতায় দু-একটি বড়ো অনুষ্ঠানে যোগদানের আহ্বান আসিয়াছিল। কবি তাই কোনো সংবাদ না দিয়া কলিকাতায় গিয়াছিলেন কেবলমাত্র এন্ডরুজকে দেখিবার জন্য। ... সেদিন মন্দিরে উপাসনায় কবি এন্ডরুজের কথা বলেন। জীবনে তিনি তাঁহার কাছে কী পরিমাণ ঋণী তাহা গভীর আবেগে প্রকাশ পায় সেদিন। ... কবি এই দিনের ভাষণে বলেন, ‘দেখেছি দিনে দিনে নানা উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষের কাছে তাঁর অসামান্য আত্মোৎসর্গ।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর চার মাস আগে নববর্ষের দিনে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেই ভাষণে কবি তাঁর এই প্রিয়তম বন্ধুটির কথা শেষবার স্মরণ করে বলেন : ‘আমার ব্যক্তিগত সৌভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে মহদাশয় ইংরেজের সঙ্গে আমার মিলন ঘটেছে। ... দৃষ্টান্তস্থলে এন্ডরুজের নাম করিতে পারি, তাঁর মধ্যে যথার্থ ইংরেজকে, যথার্থ খ্রিষ্টানকে, যথার্থ মানবকে বন্ধুভাবে অত্যন্ত নিকটে দেখবার সৌভাগ্য আমার ঘটেছিল। আজ মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষণীতে স্বার্থসম্পর্কহীন তাঁর নির্ভীক মহত্ত্ব আরও জ্যোতির্ময় হয়ে দেখা দিয়েছে। ... তাঁর স্মৃতির সঙ্গে এই [ইংরেজ] জাতির মর্মগত মাহাত্ম্য আমার মনে ধ্রুব হয়ে থাকবে।’

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথের ছেলে। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিজের ছেলেদের মতো স্নেহ করতেন।

মৃত্যু : ৩ মে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ।

১৩ এপ্রিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ ইন্দিরা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সুরেনের জন্যে মন কী রকম উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তা বলে উঠতে পারিনে।... আমার নিজের শরীর একটুও ভালো নেই, প্রায়ই জ্বর হয়। আর অহোরাত্র থাকে সেই জ্বরের দুর্বলতা। কাজ করবার শক্তি কমেছে, রুচিও নেই, অথচ এত কাজের আক্রমণ এর আগে কখনো মনে পড়ে না। বয়স যতই বাড়ছে মন যতই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে জরায়, নিরবকাশ ততই নীরন্ধ্র হয়ে উঠচে। আমার কাজের সঙ্গে এত লোকের দায়িত্ব জড়িত যে অস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে তাকে সরিয়ে রাখতে পারিনে।

কিন্তু আমার তো যাবার সময় হয়ে এসেছে, কোনো কিছুর জন্য পরিতাপ করবার সময় নেই জানি, তেমনি আর সময় নেই কর্তব্য থেকে নিষ্কৃতি নেবার।... এই জন্যে দুর্বল স্বাস্থ্যের কুহেলিকাচ্ছন্ন দিনের অস্বচ্ছ আলোয় ঝুঁকে পড়ে কাজ করে চলেছি। ... কিন্তু কী হবে নালিশ করে আর কতদিনকারই বা মেয়াদ। এতদিন পরে সুরেনকে যদি হারাতেই হয় তা হলে আমার পক্ষে সান্ত্বনা এই থাকবে যে তার বিচ্ছেদ বেশি জায়গা পাবে না নিজেকে বিস্তীর্ণ করবার জন্যে।’

কয়েক দিন পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘বুঝতে পারচি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে সুরেন পেরে উঠবে না। এত কষ্ট ও পাচ্ছে। নানা রকম কষ্টের ভিতর দিয়ে ওর জীবনটা গেল। অমন মানুষের ভাগ্যে এত কষ্ট ঘটতে পারে এ কথা ভাবলে অত্যন্ত ধিক্কার জন্মায় বিশ্ববিধানের উপর। মনটার ভিতর বৃথা ছটফট করতে থাকে।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর আঘাত পান। এ প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন : ‘[রবীন্দ্রনাথের] জন্ম-উৎসবের পরদিন ৬  মে [১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ] রবীন্দ্রনাথকে সুধাকান্ত জানাইলেন যে গত ৩ মে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহারা পূর্বদিনই খবর পান, কিন্তু উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথকে জানানো হয় নাই। রবীন্দ্রনাথ এই সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তথাচ ইহা তাঁহার কাছে পুত্রশোকতুল্য।’

৬ মে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখলেন, ‘তোরা বোধ হয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি ভালোবেসে ছিলুম। নানা উপলক্ষ্যে তাকে আমার কাছে টানবার ইচ্ছা করেছি বারবার, বিরুদ্ধ ভাগ্য আমার নানা আকারে কিছুতেই সম্মতি দেয় নি। এইবার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বোধ হয় কাছে আসবে, সেইদিন নিকটে এসেছে।’

সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরদিন (৭ মে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ) যে কবিতাটি লেখেন তার অংশবিশেষ এরূপ :

   ‘রাহুর মতন মৃত্যু

   শুধু ফেলে ছায়া,

   পারো না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত

   জড়ের কবলে

   এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।

   প্রেমের অসীম মূল্য

   সম্পূর্ণ বঞ্চনা করে লবে

   হেন দস্যু নাহি গুপ্ত

   নিখিলের গুহা-গহ্বরেতে

   এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।’

কালীমোহন ঘোষ

রবীন্দ্রনাথের ‘পল্লীসঞ্জীবন’ ব্রতে প্রথম ও প্রধান সহায়ক। একান্ত অনুগত সহকর্মী।

মৃত্যু : ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ, ১২ মে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ। সন্ন্যাসরোগে।

কালীমোহনের মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কালিম্পঙে। তাঁর মৃত্যুতে জীবন-সায়াহ্নে চরম আঘাত পেলেন। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭, ১৯ মে ১৯৪০ কালীমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র সংগীতশিল্পী শান্তিদেব ঘোষকে লিখেছেন : ‘তোমার পিতার মৃত্যুসংবাদে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। শান্তিনিকেতনে আসবার পূর্বে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার নিকট সম্বন্ধ ঘটেছিল। কর্মের সহযোগিতায় ও ভাবের ঐক্যে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। অকৃত্রিম নিষ্ঠার সঙ্গে আশ্রমের কাজে তিনি আপনার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর আন্তরিক জনহিতৈষা শ্রীনিকেতনের নানা শুভকর কার্যে নিজেকে সার্থক করেছে। তাঁর মূর্তি আমাদের আশ্রমে এবং আমার মনের মধ্যে চিরদিনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে রইল। লোকহিতব্রতে তাঁর যে জীবন ত্যাগের দ্বারা পুণ্যোজ্জ্বল ছিল, মৃত্যু তার সত্যকে খর্ব করতে পারে না। এই সান্ত্বনা তোমাদের শান্তি দান করুক।’