গল্প পড়ার গল্প
প্রতিকূল স্রোতের লেখক শওকত ওসমান
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছরে কলকাতার দেশ কিংবা আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় শওকত ওসমানের উপন্যাস পড়েছিলাম, ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়।’ তখন সীমান্তের ওপারের কিছুই জানা যেত না। পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদের কাউকেই চিনতাম না। বয়স তখন বছর কুড়ি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি উত্তেজিত ছিলাম। এর আগে সীমান্তের ওপারকে এক অলীক ভূখণ্ড মনে হতো। আমার পিতৃপুরুষ তো ওপার থেকেই এসেছেন এপারে। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ পড়ে পাকিস্তান আর্মি, বাংলাদেশের মানুষের অনেক কথাই জেনেছিলাম। উপন্যাসটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এ দেশে। পরে জেনেছি শওকত ওসমানের জন্ম আমাদের পশ্চিমবঙ্গে।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি হুগলি জেলার জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এপারে নিঃশব্দে জন্মশতবর্ষ পার হয়ে গেল এই মহৎ লেখকের। ওপারে নিশ্চয় স্মরণ করা হয়েছে তাঁকে। কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও অর্থনীতিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ হন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং তৎকালীন বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। শওকত ওসমান ছিলেন 'অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ'। প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ সেই কথা বলতেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে যান। প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, অগ্রবর্তী মানুষই ছিলেন শওকত ওসমান। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনতা স্বীকার করতে চাইতেন না। পাকিস্তান সরকারের অবিচারে মুক্তকণ্ঠ ছিলেন শুনেছি। তাঁর উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’ ছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসনের জাঁতাকলে আবদ্ধ পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের কথা। ১৯৬২ সালে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে সামরিক শাসক, ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিষয় হয়েছিল। সামরিক শাসনে সব ধরনের-বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেই এই উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। এই উপমহাদেশে ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতো উপন্যাসের উদাহরণ আর আছে বলে জানা নেই। এ এক মহৎ উপন্যাস। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তোলা খুবই বড় লেখকের কাজ। শওকত ওসমান এই কারণে বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু এবং সৎ পাঠকের কাছে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। স্বৈরাচারী শাসক ভয় করে মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে। এই চেতনাকে দমন করার জন্যই নেমে আসে সামরিক শাসনের দমন-পীড়ন। কিন্তু লেখক তো নিজের কলমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে পারে না শাসক। রূপকের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে এই প্রতিবাদ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র প্রোটাগনিস্ট তাতারী।
আমি শওকত ওসমানের গল্প ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’র কথা বলি। গল্পটি এক সহপাঠী বন্ধুর। সেকালের গল্প, কিন্তু একালে তার আবেদন ফুরায় না। গল্পটি সেকালে লেখা, হয়তো গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষে, পাকিস্তানের জন্মের পর (প্রকাশের তারিখ আমি খুঁজে পাইনি), তখন তিনি পূর্ববঙ্গে, গল্প লেখার ধরনে তাই মনে হয়। ভুলও হতে পারে। যাই হোক গল্পে আসি। মুরারি পাচাল ছিল লেখকের সহপাঠী বন্ধু। পাচাল পদবি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি জেলায় দেখা যায়। গল্পের সময় স্বাধীনতার আগের। গল্প বলায় স্মৃতিকথার আদল আছে। মুরারি ছিল অত্যন্ত মেধাবী। নতুন ভাবে ভাবতে পারত। সেকালে সাত গ্রামের ভিতর একটি ইস্কুল। সেই ইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে মুরারি ছিল তাঁর সহপাঠী। গুণী ছেলে ছিল সে। তার আবৃত্তির গলা ছিল মধুর। ক্লাসে ফার্স্ট না হলেও প্রথম চার পাঁচজনের ভিতর ছিল তার পজিশন। লেখক বলছেন, মর্নিং শোজ দ্য ডে, এই প্রবাদ সত্য হয়নি মুরারির ক্ষেত্রে। এই গল্পে সে আমলের শিক্ষার রীতির কথার উল্লেখ আছে।
পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর মুরারির মাথায় গোলমাল দেখা যায়। খেয়ালে কখন কী করে বসবে বলা দায়। এ সত্ত্বেও সে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় ফার্স্ট। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার দিনে পরীক্ষায় না বসে মাঠে মাঠে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে বিকেলের দিকে ‘ফিট’ হয়ে যায়। সে যুগে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত ছিল না। হাতুড়ে, কবিরাজ, ঝাড়ফুক, তুকতাক… এসবই ছিল দাওয়াই। মেধাবী যুবক মুরারির মাথা খারাপ হয়ে যেতে তার মা বাবা খুব আশাহত হয়েছিলেন। যাই হোক, মাথা কিছুদিন ভালো থাকে কিছুদিন খারাপ থাকে। যখন খারাপ থাকে অদ্ভুত সব কথা বলে, আমি কলিযুগের ত্রাণকারী, পাপে ভরে গেছে পৃথিবী, পাপ ঘরের ভেতর কিলবিল করছে, ফুঁ দিলেই সব উড়ে যাবে...ফু ফু ফু।
অসংলগ্ন কথাই তার পাগলামির লক্ষণ। সেই সব কথা নানা রকম। নানা ঘটনা আচমকা ঘটিয়ে দেয় সে। ক্লাস চলাকালীন বক্তৃতা শুরু করে দেয়। এমনি করে করে ক’বছর নষ্ট করে ম্যাট্রিকটা পাশ করল মুরারি। রেজাল্ট ভালো, প্রথম ডিভিশনে। সে আমলে ম্যাট্রিক পাস খুব বড় ঘটনা। মুরারি আইএ-ও পাস করে ফেলল। মনে হলো তার মাথার গোলমাল আর নেই। মুরারির মামা বিজয়বাবু তাঁকে নিয়ে গেলেন শহরে। বিএ পড়বে সে। বিজয়বাবুও ম্যাট্রিক পাস। শহরে কেরানিগিরি করেন। লোকে তাঁকে মান্য করে। মুরারি ভালো হয়ে গেছে। শহরে এক মেসে মামা ভাগ্নে থাকে। শহরে দু’বছর খুব ভালো কাটে মুরারির। কলেজে তার খ্যাতি ভালো ডিবেটার হিসেবে। কণ্ঠস্বর, ধারাল যুক্তি, দুয়েই সে সকলের চেয়ে এগিয়ে। সে কলেজের প্রতিনিধি হয়ে যাবে আন্তকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। কিন্তু ক’দিন পরেই তার মাথা বিগড়ে গেল। চাগিয়ে উঠল পুরোনো অসুখ। নিয়মিত কলেজে যায় না। গেলেও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। বিতর্ক সভায় নিয়মিত যায় না। একবার তো প্রতিপক্ষকে মেরেই বসল। তার মামা যখন ভাগ্নের এই পরিবর্তনের কথা জানল তক্ষণ সে কলেজে যায়ই না। পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।
একদিন মামা বিজয়বাবু তাঁকে আবিষ্কার করলেন সারা দিন মেসে শুয়ে। দুপুরের ভাত ঢাকা পড়ে আছে সেই সন্ধেতেও। মামার জিজ্ঞাসায় মুরারি উঠে স্বাভাবিক। সে মামার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চায়। নিজের উপলব্ধির কথা বলতে চায়। কী কথা? না, সে উপলব্ধি করেছে ঈশ্বর যেমন সর্বত্র বিরাজমান, মানুষও তা হতে পারে। মামা অবাক। তিনি ভাগ্নেকে এই ভাবনা থেকে সরিয়ে আনতে পারেন না। মুরারি বলে, চেষ্টা করতে দোষ কী? ঈশ্বরের মতো মানুষ সর্বত্র বিরাজমান হতে পারে। কতকাল আগে লেখা এই গল্পে তিনি আঁকাড়া বাস্তবতার বাইরে যে বাস্তবতা নির্মাণ করেছেন, তা আমাদের বাংলা গল্পে অদৃশ্য ছিলই বলা যায়। এই সত্য সাহিত্যের সত্য। এখানে একটি যুবক ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায়। ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চায়। মামা তাকে নিবৃত্ত করতে পারেন না। কিন্তু তাঁর চেষ্টার শেষ ছিল না। মানুষের দেহ আছে, আকার আছে, কিন্তু ঈশ্বর নিরাকার। নিরাকার ঈশ্বর সর্বত্র থাকতে পারেন, মানুষ কীভাবে পারবে তা? কিন্তু মুরারি তর্কপ্রিয় যুবক। সে যুক্তি দিতে থাকে। সে চায় ঈশ্বরের মতো সর্বত্র বিরাজমান হয়ে মানুষের ইতিহাসে পথিকৃৎ হতে। তাঁকে চেষ্টা করতেই হবে। একবার ব্যর্থ হলে আবার চেষ্টা করবে। সে মেস থেকে বেরিয়ে পড়ে হাঁটতে লাগল শহরের ভিতর। ফিরল রাত এগারটার পর। ফিরে এসে বলল, সে প্রচুর হেঁটেছে, শহরের এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ দেবে না। সর্বত্র সে তার পদচিহ্ন রেখে দেবে। অস্তিত্ব রেখে যাবে। মাঝে মাঝে সে কলেজেও যায়। সেখানে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মেসেও নেই। পড়াশোনা যে করে না তা নয়। মামা ভাবেন একদিন আবার মুরারি শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না।
শহরে যে সভা হয়, সেই সভায় উপস্থিত হয় মুরারি। কিন্তু তা সভা শোনার জন্য নয়। বড় মিটিংয়ের এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্ত অবধি সে যায়, অসংখ্য মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের ভিতর নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে। এভাবে হয়ে উঠবে সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বর। ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জন জোয়ারে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে সে উপলব্ধি করছে সর্বত্র তার উপস্থিতি। এই অদ্ভুত দার্শনিকতা নিয়ে ভেসে চলে মুরারি। এবং এমন যুবকের বেঁচে থাকা শেষ অবধি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার করুণ মৃত্যুতে এই গল্প অন্তিমে পৌঁছয়। একজন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে নিজেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমনই এক গল্প অনেক কাল আগে লিখে গিয়েছেন শওকত ওসমান। তিনি আঁকাড়া বাস্তবের গল্প লিখতেন না। কিন্তু যে বাস্তবতা তৈরি করতেন তা সমাজের চলতি হাওয়ার পন্থী ছিল না। প্রতিকূল স্রোতে যাওয়াই তো লেখকের কাজ। তাঁর কাছ থেকে এইটুকু যা শিখেছি তা সমস্ত জীবনের পাওয়া।