রবীন্দ্র-সাহিত্যের নতুন প্রান্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য পঠন-পাঠনে নতুন চিন্তাধারা কিংবা বিভিন্ন তত্ত্বের আলোক প্রক্ষেপণ একটি জরুরি চাহিদা। প্রায়শ বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্র-সাহিত্যের নতুন পাঠ অসম্ভব। তাঁর সবকিছু নিয়ে কাজ হয়েছে গেছে। তবু ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের কাছে তিনি মূল্যায়িত হচ্ছেন নিরন্তর। কারণ, তাঁর টেক্সটের ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক অনুদ্ঘাটিত বিষয়। যেমন তাঁর সাহিত্যে মানবজীবনের নিমর্ম ও নিষ্ঠুরতার রূপ অঙ্কিত হয়েছে নানাভাবে, বিচিত্র পরিপ্রেক্ষিতে। আসলে প্রাচীনকাল থেকে সাহিত্যের বিভিন্ন রূপকল্পে নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রসঙ্গের অবতারণা লক্ষ করা যায়। ট্রয় কিংবা কুরক্ষেত্রের যুদ্ধের বর্ণনা উপস্থাপনে নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনার একাধিক চিত্র রয়েছে ইলিয়াড ও মহাভারত—এ উভয় মহাকাব্যে। মহাকাব্যের সেই পরিধি থেকে সফোক্লিসের ট্র্যাজেডি ‘ইডিপাসে’ নিয়তির নিষ্ঠুর রূপের চিত্রও কম সহিংস নয়।
অন্যদিকে শেক্সপিয়রের নাটকে চরিত্রের আত্মদ্বন্দ্ব মুখ্য হলেও চক্রান্তকারী মানুষের কারণে নায়ক-নায়িকার জীবনে নির্মম পরিণতি নেমে আসতে দেখা যায়। অবশ্য রেনেসাঁস, ফরাসি বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্যের রোমান্টিক যুগে নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রসঙ্গের চেয়ে মঙ্গল, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের অভূতপূর্ব আলোড়ন লক্ষণীয়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই রোমান্টিক সাহিত্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে সত্য-সুন্দরের পূজা করেছেন। কিন্তু সেই মুখ্য স্থান মাঝেমধ্যেই দখল করে নিয়েছে মানবজীবনের নির্মম ও নিষ্ঠুর রূপের আত্মপ্রকাশে।
‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় ঋণগ্রস্ত কৃষক উপেনের শেষ সম্বল জমিটুকু ভূস্বামী কর্তৃক দখল করে নেওয়া হয়। ‘সজল চক্ষে, করুণ বক্ষে গরিবের ভিটেখানি’ চেয়েও সে তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ভিটেমাটি ছাড়ার সেই দৃশ্য নির্মম, করুণ, ‘পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে—/ করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।/এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি—/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ কাঙালের ধন চুরির এই দৃশ্য করুণ রঙিন নির্মম।
‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় পুণ্য লোভাতুর বিধবা মোক্ষদা তার নাবালক ছেলে রাখালকে নিয়ে তীর্থস্নানে যেতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত ছেলের পীড়াপীড়িতে নিতে বাধ্য হয়; সে সময় সে রাগ করে বলেছিল, ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!’ এ কথা শুনেছিল মৈত্র মহাশয়। তারপর তীর্থস্নান শেষে ফিরে আসার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়লে যাত্রীদলের মধ্যে মাঝি কর্তৃক অভিযুক্ত অন্বেষণ করার সময় ব্রাহ্মণ ‘মোক্ষদারে লক্ষ্য করি’ বলেছে, ‘এই সে রমণী/ দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে/ চুরি করে নিয়ে যায়।’/ ‘দাও তারে ফেলে’/এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর/ যাত্রী সবে।’ সাগরে নিক্ষেপ করা হয় শিশুটিকে কিন্তু ব্রাহ্মণের অন্তরে করুণা জাগ্রত হয় এবং ‘ফিরায়ে আনিব তোরে’ কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে/ ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে—/ আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।’ এখানে একদিকে যাত্রীদের নিষ্ঠুরতা অন্যদিকে ব্রাহ্মণের করুণাঘন চিত্র অঙ্কন করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ দুয়ের মূলে আছে অবৈধ মাতৃত্ব ও সন্তানের স্বীকৃতির প্রসঙ্গ। ‘নরকবাস’ আর ‘সতী’ দুটি রচনাতেই রয়েছে অগ্নিতে সন্তান সমর্পণের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পরিবারের ক্ষুদ্রতম সদস্যকে কেন্দ্রে রেখে রাজা-রানি, শুরু-শিষ্য, পুরোহিত-অমাত্য বিচিত্র সম্পর্কের জটিল জাল বিন্যস্ত হয়েছে। এসব রচনার পটভূমি রাজপ্রাসাদ থেকে দরিদ্রের কুটির, ঋষি আশ্রম থেকে যুদ্ধশিবিরে প্রসারিত। জবালা, কুন্তী, গান্ধারী, দেবযানী, অনামা সতী আর পতিতা চরিত্রগুলো সংরাগে-নির্বেদে স্পন্দমান। তারা কখনো প্রজননে, মৃত্যুতে, শারীরিকতায় হিংস্র। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে এভাবেই নির্মমতা অন্বেষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘কথা’ কাব্যের ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতায় গোত্রহীন, পিতৃপরিচয়শূন্য জবালা পুত্র সত্যকাম আচার্যকে তার প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করার পর উপস্থিত ছাত্রগণ, ‘কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার/ লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।’ কারণ সে মায়ের অবৈধ সন্তান। তাদের গৃহটিও গ্রামপ্রান্তে, বালুতীরে। সমাজের অন্তেবাসী সত্যকাম ব্রাহ্মণ থেকে দূরবর্তী। নিম্নবর্গকে উচ্চবর্ণ অবজ্ঞা করলেও কবি শেষপর্যন্ত সত্যকামকে গৌতম কর্তৃক আলিঙ্গন করিয়ে ঊর্দ্ধায়ন ঘটিয়েছেন মানবতার। ‘পরিশোধ’ কবিতায় শ্যামা বজ্রসেনকে রাজার বন্দিশালা থেকে মুক্ত করেছিল। বালক কিশোর উত্তীয় বজ্রসেনের চুরির অপবাদ নিজস্কন্ধে নিয়ে আপন প্রাণ দিয়েছে। শ্যামা উত্তীয়ের প্রতি নির্মমতা প্রদর্শন করেছে। কিন্তু ঘটনা শোনার পর বজ্রসেন বলেছে- ‘কলঙ্কিনী, ধিক্ এ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী।/ ধিক্ এ নিমেষপাত প্রত্যেক নিমেষে।’
দুজনের বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে কবিতাটি শেষ হয়েছে। ‘বিচারক’ মারাঠি গল্পের সূত্রে রচিত। আপন ভাইয়ের পুত্রকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাবীন্দ্রিক বক্তব্য উপস্থাপিত এখানে। রঘুনাথ রাও নারায়ণ রাওয়ের হন্তারক। ব্রাহ্মণ রামশাস্ত্রী বলেছেন, তার শাস্তি ব্যতীত সে স্বাধীন নয়। নিমর্মতার প্রতিবিধানও দেখিয়েছেন কবি।
ঋষিপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে ভোলানোর জন্য মন্ত্রী দ্বারা যেসব বারাঙ্গনা তপোবনে প্রেরিত হয়েছিল তাদের অন্যতম হচ্ছে ‘পতিতা’ কবিতার কথক। বারবিলাসিনীর নিত্যকর্ম শরীরী মুদ্রা দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে ঠিকই তারা ভুলিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ঋষিপুত্রের সারল্যের কাছে বারাঙ্গনাদের সহাস্য ভূমিকা নিষ্ঠুর ও মর্মভেদী। কবি এজন্যই তাদের ‘পিশাচী’ ও ‘পামরী পাপিনীর দল’ বলেছেন। অন্যদিকে রাজা আপন ক্ষমতায় অন্ধ, তার স্বৈরাচারী স্বভাবের নির্মম রূপটি এ রকম—‘সিংহাসনের আড়ালে বসিয়া/ মানুষের ফাঁদে মানুষ ধর।’ ক্ষমতাধর রাজার দ্বারা নিয়োজিত বারাঙ্গনারা সাধারণভাবে নরকের জীব। এ জন্যই কবির ভাষায় তারা ‘পিশাচীর দল’। তবে ঋষ্যশৃঙ্গের স্পর্শে প্রধান পতিতার মনে ঘুমন্ত প্রেম জেগে ওঠার রহস্য উন্মোচনে কবি অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন।
সন্তান বর্জনের নির্মম প্রসঙ্গ রয়েছে রবীন্দ্রনাথের একাধিক রচনায়। ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতায় মা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে বর্জন করতে চেয়েছে, পিতা বাধা দিয়েছে। ‘নরকবাসে’ পিতা শিশুসন্তানকে উৎসর্গ করেছে এবং ‘কর্ণকুন্তীসংবাদে’ মা কুন্তী জন্মের পরেই সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছে। গান্ধারী নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে দূরে অবস্থান করে, নরকবাসে রানিমা অসহায় ও নিরুপায়, আর কুন্তী উদাসীন এবং নিষ্ঠুর। গান্ধারীকে পুত্রত্যাগ করতে হয়নি, নরকবাসের রানিমা শতপুত্রবতী হবে এই আশ্বাসের প্রেক্ষাপটে সন্তান বিসর্জন দিয়েছে, কিন্তু সদ্যোজাত সন্তানকে নিরুদ্দেশে ভাসিয়ে দিয়ে অতিবাস্তব প্রয়োজনে তাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়ে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে কুন্তী। এমনকি কুন্তী কর্ণের জনক সূর্যের পরিচয় দেয়নি, জননীরূপে নিজের পরিচয়ই কেবল প্রকাশ করেছে। মাতার নির্মমতা কর্ণকে অভিমানে, হতাশায় মর্মান্তিকভাবে পীড়িত করেছিল তবু সে সকল আচ্ছন্নতা কাটিয়ে বলেছে, ‘জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে/ নামহীন, গৃহহীন। আজিও তেমনি/ আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো, জননী।’
কবিতার শেষাংশে কর্ণের উপলব্ধি হাহাকারে বিদীর্ণ হয়েছে এভাবে—‘মিথ্যা মনে হয়/ রণহিংসা, বীরখ্যাতি, জয়পরাজয়।/ কোথা যাব, লয়ে চলো।’ ‘বিদায়-অভিশাপে’ দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য কচের গুরু কিন্তু ব্রহ্মচর্য শেষে বিদায়ের মুহূর্তে দেবযানীর প্রেম উপেক্ষা করায় গুরুকন্যা দ্বারা অভিশপ্ত কচ। কারণ, তার কাছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ আর সঞ্জীবনীবিদ্যা শিক্ষা করে তা পরাভূত দেবতাদের মধ্যে বিতরণ করা ছিল মুখ্য। কারণ, স্বর্গবাসী দৈত্যদের চেয়ে শক্তিমান ও অপ্রতিহত একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল তার। দৈত্যপুরীতে কচকে হিংস্রতার শিকার হতে হয়েছে একাধিকবার। দৈত্যদের দ্বারা নিহত কচকে তিনবার পুনরুজ্জীবিত করেছে দেবযানী। সেখানকার পুরুষরা ঈর্ষা করে কচকে। পরদেশি কচ, শত্রুশিবিরের সদস্য কচ, তাদের আচার্য শুক্র এবং শুক্র কন্যা দেবযানীর প্রিয় হওয়ায় তাদের ঈর্ষা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল।
কাব্যে কচের উচ্চারণে আছে—‘ঈর্ষাভরে তিনবার দৈত্যগণ মোরে/ করিয়াছে বধ, তুমি, দেবী, দয়া ক’রে/ ফিরায়ে দিয়েছ মোর প্রাণ—’। এক রাজা ও ঋত্বিকের কাহিনী হলো ‘নরকবাস’। এখানে রাজা ও পুরোহিতের সংঘাত চিত্রিত হয়েছে। নিষ্ঠুরতা দেখা গেছে যখন সোমকরাজা বলেছে, ‘শিশুরে মোর করেছি অর্পণ/হুতাশনে।’
মূলত পুরাণ ও ইতিহাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্ররচনায় নির্মম দৃশ্যরূপ অঙ্কিত হয়েছে তাঁর প্রাথমিক সৃষ্টিকর্ম থেকেই। ১৮৯৭ সালে রচিত তাঁর ‘সতী’র মধ্যে অন্যতম। নিষ্ঠাবান মারাঠি ব্রাহ্মণ বিনায়ক রাওর কন্যা অমাবাই ব্রাহ্মণ জীবাজীর বাকদত্তা হলেও ‘বিজাপুর-যবনের রাজসভাসদ’ এক মুসলমান আমিরের দ্বারা অপহৃতা হয় এবং তাকে বিবাহ করে। তার এক পুত্রসন্তানও জন্ম নেয়। কিন্তু অমাবাইয়ের পিতা তার বিধর্মী স্বামীকে মেনে নিতে পারেনি। তাকে হত্যা করে সে এবং পূর্ববর্তী বাকদত্তা মৃত জীবাজীর সঙ্গে সহমরণে জীবন উৎসর্গ করতে বলে। পিতার অন্যায় দাবিকে প্রত্যাখ্যান করলে মাতা রমাবাই তাকে জীবাজীর সৈন্যদলের সহায়তায় বন্দি করে চিতায় সমর্পণ করে। বদ্ধ অবস্থায় তাকে জীবন্ত দগ্ধ করে এভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অমাবাইকে সতী হতে বাধ্য করা হয়। অর্থাৎ মানবধর্মের কথা ছাড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার নির্মমতা তুলে ধরেছেন কবি এ রচনায়। সতী নারীর মা’র নিষ্ঠুরতার প্রকাশভঙ্গি এ রকম—‘তার আগে করিব ছেদন/ আমার সংসার হতে পাপের অঙ্কুর/ যতগুলি জন্মিয়াছে।’ কন্যার বংশকে নির্মূল করার এ প্রত্যয় সত্যিই নির্মম। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বিরোধী ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্পে নিষ্ঠুর চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। ‘শাস্তি’ গল্পে দরিদ্র কৃষক দুখীরাম রুই তার স্ত্রী রাধাকে হত্যা করলে তার দায়ভার নিতে হয় চন্দরাকে। হত্যার অভিযোগে চন্দরার ফাঁসি হলো কারণ প্রচলিত সমাজের আচরণ ছিল এ রকম—বউ গেলে বউ পাওয়া যায় ভাই হারালে পাওয়া যায় না। ‘হৈমন্তী’ গল্পে শ্বশুরবাড়ির মানসিক অত্যাচারে নায়িকার জীবনে করুণ পরিণতি নেমে এসেছে। বাঙালি সমাজের নানান অসংগতি তুলে ধরতে গিয়ে গল্পকার নির্মম আচরণ তুলে ধরেছেন ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে। ‘বিসর্জন’, ‘মুক্তধারা’ আর ‘রক্তকরবী’তে অপমৃত্যুর দৃশ্য রয়েছে একাধিক। রঘুপতি তার ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য জয়সিংহকে দিয়ে রাজাকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আত্মহত্যায় ট্র্যাজেডি এসেছে রঘুপতির জীবনে। প্রতাপ এবং প্রেমের দ্বন্দ্বে নিষ্ঠুরতা অপ্রকাশ থাকেনি সেখানে। ‘মুক্তধারা’য় যুবরাজ অভিজিৎ মুক্তধারার বাঁধ ভেঙেছে, জনগণের পক্ষ নিয়েছে কিন্তু তার জীবন বিপন্ন হয়েছে। রাজা প্রজাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল শেষে তার পুত্র অভিজিতকে হারিয়ে বোধোদয় হলো। ‘রক্তকরবী’তে প্রাণের প্রতীক রঞ্জনকে রাজা হত্যা করেছে। সে নন্দিনীর নাম এমন করে বলেছিল যে সে সহ্য করতে পারেনি। রাজা বলেছে, ‘আমি যৌবনকে মেরেছি—এত দিন ধরে আমি সমস্ত শক্তি নিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি। মরা-যৌবনের অভিশাপ আমাকে লেগেছে।’
বস্তুত রবীন্দ্র-সাহিত্যে দেখা যায় আগুনে ছুড়ে ফেলার জন্য পিতা শিশুপুত্রকে অন্যের হাতে তুলে দেয়, মাতা নির্বাসন দিতে চায় তার পুত্রকে, ভাইকে হনন করতে সচেষ্ট হয় সহোদর ভাই, প্রেমিকা অভিশাপ দেয় প্রেমিককে, পরপুরুষের জ্বলন্ত চিতায় কন্যাকে উঠিয়ে দিয়ে মা তাকে সতী করে। নির্মমতার এমন করুণ রঙিন নাটকীয় পরিবেশ নির্মাণে রবীন্দ্র-সাহিত্য অভিনব, অনন্য। এ বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ রয়েছে বলে আমার ধারণা।