তুলনামূলক পাঠে রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ালকট

Looks like you've blocked notifications!

আজ ২২ শ্রাবণ, সাহিত্যে নোবেলজয়ী বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। অন্যদিকে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ক্যারিবীয় কবি, নাট্যকার ডেরেক ওয়ালকটের বর্ণিল জীবনের অবসান ঘটে অতি সম্প্রতি—১৭ মার্চ, ২০১৭ তারিখে। ব্রিটিশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক ১১ বছর আগে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সেন্ট লুসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ওয়ালকট। দুজনের বয়সে ব্যবধান প্রায় সাত দশক হলেও নানা কারণে তাঁদের নিয়ে একটি তুল্যপাঠ উপস্থাপন করা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের মতো ওয়ালকটের জন্ম জমিদার পরিবারে না হলেও অনুরূপ শিল্পী পরিবারে। ওয়ালকটের বাবা ও যমজভাই ছিলেন লেখক ও চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের মতো পারিবারিক আবহে ওয়ালকট চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুললেন বটে কিন্তু প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি পান সাহিত্যের অন্যতম প্রধান তিন শাখায়—কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধে। কবিতা লেখার শুরুতে তিনি সচেতনভাবে ডব্লিউএইচ অডেন, টিএস এলিয়েট এবং ডিলান থমাসকে অনুসরণ করেন। রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় কবি ছিলেন তাঁরা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দুজনেই দুই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের লেখক। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে। তাঁর মৃত্যুর (১৯৪১) ছয় বছর পর ভারত স্বাধীন হয় (১৯৪৭)। ভারত যে স্বাধীন হবে সেই ইঙ্গিতটা তিনি পেয়েছেন বটে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা ও একইসঙ্গে বিভক্ত হওয়া তিনি দেখে যেতে পারেননি। অন্যদিকে, ওয়ালকটের জন্ম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের খুদে শহর সেন্ট লুসিয়াতে। ১৬৬০ সালে ফরাসি উপনিবেশের আওতায় আসে দ্বীপটি। ১৬৬৩ সালে চলে যায় ব্রিটিশ অধীনে। ১৮১৪ সালের আগপর্যন্ত দ্বীপটির ওপর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে চৌদ্দবার যুদ্ধ হয়, ফলে ঘন ঘন মালিকানার বদল ঘটে। এরপর ১৮১৪ সালে চূড়ান্তভাবে ব্রিটিশ অধীনে চলে আসে। দেড়শ বছরেরও অধিক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থাকার পর ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে।

আফ্রো-ইউরো বংশোদ্ভূত ওয়ালকটের দাদা ও নানা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ এবং নানি ও দাদি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। মাতৃভাষা হিসেবে শিখলেন ফরাসি ও ইংরেজি ভাষা; শিক্ষাগ্রহণ করলেন ইংরেজি মাধ্যমে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখলেন ফরাসি, লাতিন ও স্প্যানিশ ভাষা। শৈশব ও কৈশোরে শিক্ষক মায়ের কাছে ইংরেজি কবিতার আবৃত্তি শোনেন, জন্মশহরে আফ্রো-ইউরো সংস্কৃতির পাশাপাশি পথেঘাটে সাক্ষাৎ ঘটে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। উপভোগ করেন মুসলিম ও চীনা পুরাণনির্ভর পালানাটক। ওয়ালকট তাঁর নোবেল ভাষণে সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছেন, [...] “all the faces along its road were Indian, which, as I hope to show, was a moving, beautiful thing, because this Saturday afternoon Ramleela, the epic dramatization of the Hindu epic the Ramayana, was going to be performed…Ó [The Antilles: Fragments of Epic Memory]

এই বহুজাতিক ও বহুভাষিক সংস্কৃতির ভেতর বেড়ে ওঠার ফলে ওয়ালকটের ভেতর এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট (dilemma) ও উৎকণ্ঠা (anxiety) তৈরি হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও প্রবণতা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে লিখেছেন :

I’m just a red nigger who love the sea,

I had a sound colonial education,

I have Dutch, nigger and English in me,

And either I’m nobody, or I’m a nation. [The Schooner Flight]

ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সাংস্কৃতিক সংকটের পেছনে ব্রিটিশ উপনিবেশকে দায়ী করে ওয়ালকট লিখেছেন :

I who am poisoned with the blood of both

Where shall I turn, divided to the vein?

I who have cursed

The drunken officer of British rule, how choose

Between this Africa and the British tongue I love? [A Far Cry from Africa]

এভাবে ওয়ালকট তাঁর কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধে সেন্ট লুসিয়ার সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কথা পুনলেখন করেছেন স্বদেশিদের দৃষ্টিকোণ (point of view) থেকে। তিনি হোমারের মহাকাব্য ‘ওডিসি’কে ক্যারিবিয়ান মহাকাব্য ‘ওমেরস’-এ রূপান্তর করেন। সেখানে তিনি সচেতনভাবে হোমারের বীরদের কাহিনী বাদ দিয়ে আফ্রিকার নিম্নবর্গীয় (subaltern)  জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলেছেন। ক্যারিবিয়ান ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এলিগরি হিসেবে লেখেন নাটক ‘ড্রিম অন মানকি মাউন্টেইন’ (১৯৭০)। নাটকের নায়ক কৃষ্ণাঙ্গ ফেলিক্স হোবেইন। লোকে ডাকে মাকাক বলে। ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় মাকাক তাঁর প্রকৃত নাম ও পরিচয় হারিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আত্মতৃপ্তির বদলে তাঁর ভেতর জন্ম নেয় আত্মক্রোধের। এভাবে ওয়ালকট তাঁর অধিকাংশ লেখায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঔপনিবেশিক সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। তবে স্বদেশে তাঁর কবিতা-নাটকে পশ্চিমা সাহিত্যরীতির (Forms of Western Narrative) ব্যবহার নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তিনি ক্যারিবিয়ান ক্লাসিক সাহিত্যের চেয়ে ইংরেজি ক্লাসিক সাহিত্যকে অনুসরণ করেছেন বেশি। এর কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে তাঁর ঔপনিবেশিক শিক্ষা (Colonial Education) গ্রহণকে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর বেড়ে ওঠা শিশুরা এক ধরনের শংকরজাত (hybridity) বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। শিশুর স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা হরণ করে নেওয়া হয়। নিজের সংস্কৃতির প্রতি হীনমন্যতা থেকে জন্ম নেয় আত্মক্রোধ বা আত্মগ্লানির।

একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঔপনিবেশিক শিক্ষার সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেছেন, মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষালাভ সম্ভব। তবে রবীন্দ্রনাথ ওয়ালকটের মতো কট্টরভাবে স্বদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরোধিতা করেননি। যেখানে ওয়ালকট বলছেন, ঔপনিবেশিক অবস্থা আফ্রিকার মানুষকে অসভ্য ও অসহায় পশুতে পরিণত করেছে; সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ভারতীয় জনগণের উন্নতিই ব্রিটিশদের ভারত শাসনের মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন সময়ে উপনিবেশবাদ বিষয়ে আমরা স্ববিরোধী রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন ভারতে গণমুখী আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে তখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘ভরসা করিয়া বলিতে পারি এমন অবিশ্বাসী এ সভায় কেহই নাই যিনি বলিবেন ভারতের উন্নতিই ভারত-শাসনের মুখ্য লক্ষ্য নহে। অবশ্য, ইংরাজের ইহাতে আনুষঙ্গিক লাভ নাই এমন কথাও বলা যায় না। কিন্তু নিজের স্বার্থকেই যদি ইংরাজ ভারত-শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য করিতেন তবে আমাদের এমন দুর্দশা হইত যে ক্রন্দন করিবারও অবসর থাকিত না।’ [প্রবন্ধ : মন্ত্রী-অভিষেক, ১৮৯০] অথচ আমরা জানি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণির অত্যাচারী মনোভাবের কারণে ভারতীয় জনগণ উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছেন। অঞ্চলে অঞ্চলে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছে তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সেই গণআন্দোলনের উত্তাপ রবীন্দ্রমানসকে যে ছুঁয়ে যায়নি তাও বলা যাবে না। ১৮৭৭ সালে কিশোর বয়সে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কথা শুনে স্বদেশে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করে তিনি রচনা করেন ‘দিল্লি দরবার’ কবিতাটি :

তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন?

তবে এই সব দাসের দাসেরা, কিসের হরষে গাইছে গান?

ব্রিটিশ বিজয় করিয়া ঘোষণা, যে গায় গাক্ আমরা গাব না

আমরা গাব না হরষ গান,

এস গো আমরা যে ক-জন আছি; আমরা ধরিব আরেক তান।

১৮৯৪ সালে ‘রাজনীতির দ্বিধা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকায় ব্রিটিশ আগ্রাসনের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ‘য়ুরোপীয় জাতি য়ুরোপে যতটা সভ্য, যত সদয়, যত ন্যায়পর, বাহিরে ততটা নহে, এ-পর্যন্ত ইহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।’ ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড উপাধি প্রত্যাখানপত্রে Lord Chelmsford-কে লেখেন, ‘The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab for quelling some local disturbances has, with a rude shock, revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India.’ ব্রিটিশ উপনিবেশের ওপর রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের উপযুক্ত পর্যালোচনা করেছেন হুমায়ুন আজাদ—“রবীন্দ্রনাথ ‘রাজনীতির দ্বিধা’ প্রবন্ধে শাসক চরিত্রের দুটি ত্রুটি নির্দেশ করলেন। ইংরেজ স্বদেশে যতোটা সভ্য এবং ন্যায়পরায়ণ, বিদেশে ততোটা নয়। তাদের চরিত্রের দ্বিরূপ:...তিনি লক্ষ করলেন ইংরেজ জাতির মধ্যে দুটি দল, একদল প্রবলতার পক্ষে অপরদল সুবিচারী। ভারতবর্ষে শাসক ইংরেজ অত্যাচারী, তিনি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন। কিন্তু তিনি বিলেতের ধর্ম ও ন্যায়পরায়ণ ইংরেজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইংরেজের রাজনীতির মহত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী;...তিনি শাসক ইংরেজকে পরিত্যাগ করে আশ্রয় করলেন বিলেতের ইংরেজ।” [রবীন্দ্রপ্রবন্ধ রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিণতকালে ‘সভ্য’ ব্রিটিশদের থেকে মুখ ফিরিয়ে সত্যিকার অর্থেই সুবিধাবঞ্চিত বাঙালির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তাদের কল্যাণসাধনে ও সুশিক্ষিত করে তোলার জন্যে লেখালেখির পাশাপাশি সমাজকর্মী ও সমাজসংস্কারক হিসেবে কাজ করে গেছেন। তিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়, বাঙালিকে বিশ্ববাদে দীক্ষা দিতে চেয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘শ্রীনিকেতন’ গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করেছে। বাঙালিকে সাংস্কৃতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার জন্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। তৎকালীন পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চাষিকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে তিনি সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দরিদ্র প্রজাদের ভাগ্যোন্নতির জন্য সমবায় ব্যাংক, সমবায়নীতি ও কল্যাণবৃত্তি চালু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন হেলথ্ কোঅপারেটিভ সোসাইটি ও কৃষি ল্যাবরেটরি। কৃষিউন্নয়নের জন্য নিজ ছেলে ও জামাতাকে কৃষিবিদ্যা বিষয়ে পড়তে বিদেশে পাঠান। বাংলার কুটির শিল্পের উন্নয়নেও কাজ করেছেন তিনি। তাই সার্বিক বিবেচনায়, বাঙালির স্বভাব ও বাঙালির দুঃখ-বেদনা এবং সংকটকে তাঁর মতো আপন করে আর কেউ উপলব্ধি করতে পারেননি।

আরো কিছু তুলনা-প্রতিতুলনার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ডেরেক ওয়ালকটকে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের মতো ওয়ালকটও প্রধানতম বহুমাত্রিক মেধার কবি। প্রবন্ধসাহিত্য ও লোকনাট্যে খ্যাতি লাভ করেছেন। উল্লেখ করার মতো চিত্রশিল্পীও ছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে এগিয়ে সংগীত বা গীতিকবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা-প্রধান গানের মতো অনেক গীতিময় কবিতা লিখেছেন ওয়ালকট। কবিতায় সুরবাঁধার রীতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে জনপ্রিয় হলে ওয়ালকটের অনেক কবিতা সংগীতে রূপান্তরিত হতে পারত। স্পিরিচুয়ালিটি রবীন্দ্রনাথের মতো ওয়ালকটের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। ওয়ালকট নিজেও বলেছেন, “I have never separated the writing of poetry from prayer. I have grown up believing it is a vocation, a religious vocation।” রবীন্দ্রনাথ কথাটা একটু অন্যভাবে বলেছেন, “আমার কাব্যসাধনার একটিমাত্র পালা। সে পালার নাম সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধনের পালা”। অর্থাৎ দুজনের অধ্যাত্মসাধনা সর্বজনীন চেতনা দ্বারা পরিশুদ্ধ।  দুজনই ভূদৃশ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাকারী হলেও সমাজের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনকথা তুলে ধরেছেন কাব্যভাষায়। ফলে তাঁরা যেমন রিয়েলিস্ট তেমন রোম্যান্টিকসও। দুজনই দুই মহাদেশীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাঁদের লেখায়। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ালকট বহুভাষী পণ্ডিত ছিলেন। একঅর্থে ভাষাবিদও। ‘ভাষাপ্রধান’ কবি হিসেবেও তাঁদের আখ্যায়িত করা চলে। শিমাস হিনি ওয়ালকটের ‘Schooner Flight’ কবিতা প্রসঙ্গে যে বলেছেন, “Walcot has discovered a language woven out of dialect and literature neither folksy nor condescending… evolved out of one man’s inherited divisions and obsessions.”—তা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে খাটে।

রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও চর্চাকে তাঁর অনেক সমালোচক ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয়’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তার উত্তর তিনি নানাভাবে দিয়েছেনও। পরোক্ষভাবে একজায়গায় বলেছেন, “এ কথা মানি না। যা সত্য তার জিওগ্রাফি নেই। ভারতবর্ষও একদিন যে সত্যের দ্বীপ জ্বালিয়েছে তা পশ্চিম মহাদেশকেও উজ্জ্বল করিবে, এ যদি না হয় তবে ওটা আলোই নয়। বস্তুত যদি এমন কোনো ভালো থাকে যা একমাত্র ভারতবর্ষেরই ভালো তবে তা ভালোই নয়, এ কথা জোর করিয়া বলিব। যদি ভারতের দেবতা ভারতেরই হন তবে তিনি আমাদের স্বর্গের পথ বন্ধ করিবেন, কারণ স্বর্গ বিশ্বদেবতার।” এই অভিযোগের আরো সরাসরি উত্তরটা আমরা পেয়ে যাই ডেরেট ওয়ালকটের উক্তিতে। কারণ ওয়ালকটও স্বদেশে অনুরূপ সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তিনি তাঁর ইংরেজি ভাষাচর্চা প্রসঙ্গে বলেছেন, “I am primarily, absolutely a Caribbean writer. The English language is nobody’s special property. It is the property of the imagination: it is the property to the language itself…” তবে ইংরেজিকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলেও দুজনেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। মাতৃভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে বলেছেন, “কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়।” ওয়ালকট তেমন ক্যারিবীয় আদি ভাষাগুলোর জন্যে আকুতি জানিয়ে তাঁর ‘St. Lucia’ কবিতায় বলেছেন : “Come back to me/ my language/ Come back/ cacao/ grigri/ solitaire/ oiseau.” তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনদর্শনের চূড়ান্তপর্যায়ে এসে জার্মান মহাকবি গ্যেতের মতো তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পরিচয় থেকে ‘মুক্তি’ নিয়ে নিজেকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে ভেবেছেন। একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ওয়ালকটের ভেতরেও। ওয়ালকট নিজেকে বিশ্বনাগরিক ঘোষণা দিয়ে ‘The light of the world’ কবিতায় বলছেন, “There was nothing they wanted, nothing I could give/ but this thing I have called-The Light of the World.”

আলোচনার ইতি টানার পূর্বে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ-ওয়ালকট কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) যে বলেছেন, “Do I contradict myself? Very well, then, I contradict myself; I am large—I contain multitudes.’ [Section 51, Song of Myself] তা দুই মহাদেশের এ-দুই প্রধান কবি বললেও যেন মানিয়ে যেত!

 

ঋণস্বীকার

১. তর্কে-তদন্তে পাওয়া রবীন্দ্রনাথ, শামসুজ্জামান খান

২. রবীন্দ্রনাথ: স্বদেশভাবনা, আবদুশ শাকুর

৩. রবীন্দ্রনাথ : বাউলসংস্কৃতি ও অন্যান্য, আবুল আহসান চৌধুরী

৪. রাজনীতির রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ আবুল কালাম

৫. উপনিবেশবাদ উত্তর-উপনিবেশবাদ ও রবীন্দ্রনাথ, মাসুদুজ্জামান

৬. When the Poet Is a Stranger: Poetry and Agency in Tagore, Walcott, and Darwish by Khaled Mattawa

৭. Loss and Recovery of Identity in Derek Walcott’s Dream on Monkey Mountain by Raad Kareem

৮. Treatment of Hybridity in the Poetry of Darek Walcott by Dr. M Nallathambi

Mapping Roots in Derek Walcott’s Omeros by Maeve Tynan

৯. The Quest for Caribbean Identities: Postcolonial Conflicts and Cross-Cultural Fertilization in Derek Walcott’s Poetry by Catherine Douillet