‘তারকা আর চরিত্রের পোশাক নকশা দুটি ভিন্ন বিষয়’
১৯৫০-এর দশক থেকে শতাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন ভানু আথাইয়া, তবে কোনো নির্মাতা বা অভিনয়শিল্পী হিসেবে নয়, একজন কস্টিউম ডিজাইনার বা পোশাক নকশাকার হিসেবে। গুরু দত্ত, রাজ কাপুসহ ভারতের প্রখ্যাত অনেক নির্মাতার কাজ করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্মাতা রিচার্ড এটেনবোরোর গান্ধী ছবিতে পোশাক নকশা করে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভানু অস্কার পান ১৯৮৩ সালে। ভারতের চলচ্চিত্রশিল্পে ভানুর পাঁচ দশক পূর্তিতে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ত্রিশা গুপ্ত। ভানু ও ত্রিশা গুপ্তের কথোপকথনটি তেহেলকা ডটকম থেকে এনটিভি অনলাইনের জন্য অনুবাদ করেছেন প্রদীপ দাস।
প্রশ্ন : মুম্বাই চলচ্চিত্রশিল্পে একজন পোশাক নকশাকার হিসেবে আপনি কীভাবে কাজ শুরু করেন?
ভানু আথাইয়া : জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘ইভস’স উইকলি’র দুটি পাতায় আমি কাজ করতাম। যেখানে আমি চিত্রাঙ্কন করতাম ভারতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। আমার ফ্যাশন ইলাস্ট্রেশন অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র তারকাদের নজর কাড়ে। তাঁরা আমার সম্পাদককে বুটিক (হালফ্যাশনের প্রসাধনসামগ্রীর দোকান) প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন এবং প্রতিষ্ঠার পর আমি সেখানে পোশাকের নকশাকার হিসেবে কাজ শুরু করি। ওই বুটিকে কামিনি কোশাল, নার্গিস থেকে শুরু করে রমানন্দ সাগর সবাই আসতেন। এর মধ্যে কামিনি কোশাল প্রথম আমাকে একটি কাজ দেন। আমি তাঁর ব্যক্তিগত ওয়ার্ডরোবের নকশা করতে শুরু করি এবং খুব তাড়াতাড়ি তিনি আমাকে তাঁর শাহেনশাহ, চালিস বাবা আউর এক চোর-এর মতো চলচ্চিত্রে পোশাক নকশাকার হিসেবে কাজ করতে বলেন।
প্রশ্ন : গুরু দত্তের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয় হয়?
ভানু : গুরু দত্তের মেয়ে আর আমি একসঙ্গে জেজে স্কুলে পড়াশোনা করেছি। আমার ইলাস্ট্রেশন আমাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। কালা ঘোড়া আর্টিস্ট সেন্টারে মকবুল ফিদা হুসাইন ও কৃষাণ খান্না সঙ্গে আমার প্যান্টিংও প্রদর্শিত হয়েছিল। গুরু দত্ত আমাকে কাজ করতে বলেন সিআইডি ছবির পোশাক নকশাকার হিসেবে।
প্রশ্ন : যখন আপনি চলচ্চিত্রে পোশাক নকশাকার হিসেবে কাজ শুরু করলেন, তখন কীভাবে কাজটি করতেন?
ভানু : চলচ্চিত্রনির্মাতারা আসলে কী করতে চান, সে সম্পর্কে তাঁদের একেবারে পরিষ্কার ধারণা থাকত। শিল্পনির্দেশক ও নির্মাতা একসঙ্গে দর্জিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন, সেখানে অভিনয়শিল্পীরাও যোগ দিতেন। আমি মূলত নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতাম।
প্রশ্ন : নির্দিষ্ট করে বলবেন, আপনি কোন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন?
ভানু : ঠিক কোন জায়গায় কী করা দরকার, সে বিষয়ে গুরু দত্ত খুব স্পর্শকাতর ছিলেন। এ ক্ষেত্রে সাহেব বিবি আউর গোলাম-এর কথা বলা যেতে পারে। যেখানে গুরু দত্ত মনে করলেন, আমার কলকাতা ঘুরে আসা দরকার। তাই আমাকে কলকাতার পুরোনো জমিদারবাড়ি, দোকানপাট ঘুরে দেখতে হয় এবং কথা বলতে হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে। গুরু দত্তের সঙ্গে আমি যেসব চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, সেগুলো বাস্তবতাকে ধারণ করত। বিপরীতে রাজ কাপুর চাইতেন অদ্বিতীয় কিছু। সে জন্য সত্যম শিবম সুন্দর, প্রেম রোগ-এর স্বপ্নের দৃশ্য, যেখানে অ্যারাবিয়ান নাইটের কল্পনা তুলে ধরা হয়েছিল কিংবা হান্নায় পাকিস্তানি জিপসির দৃশ্যে; এসব ক্ষেত্রে আমাকে অনেক বেশি সৃজনশীল হতে হয়েছিল। হিন্দি চলচ্চিত্র সব ধরনের চাহিদাই তৈরি করে। গান, স্বপ্নের দৃশ্য, বৃষ্টির দৃশ্য-সবকিছুই একজন পোশাক নকশাকারকে কাজের সুযোগ করে দেয়।
প্রশ্ন : কোন পোশাক বা ‘লুক’ কি আপনি তৈরি করেছিলেন, যা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল?
ভানু : ওয়াক্ত (১৯৬৫) ছবিতে ফিটিং সালোয়ার-কামিজের নকশা করেছিলাম, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর আগে নারীরা বড় কার্তুজ ও ডাম্পি সালোয়ার পরত। তারপর ব্রহ্মচারীতে (১৯৬৮) মমতাজ মাধবানি যে কমলা রঙের স্টিচড শাড়ি পরে, সেটিও পরে অনেক নকশাকার নকল করেন। নিকাতে আমি তৎকালীন একটি নবাবি নকশার কাজ করি, সেখানে আমি সূচিকর্ম বা চিকনের কাজের ওপর গুরুত্ব দিইনি, দিয়েছিলাম হায়দরাবাদের মুক্তার অলংকারের ওপর।
প্রশ্ন : পোশাক নকশাকার সম্পর্কে হিন্দি চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
ভানু : একজন পোশাক নকশাকারের উচিত চলচ্চিত্রের পুরো কাঠামোরই নকশা করা। লগন-এর কথাই ধরা যেতে পারে, গ্রাম থেকে শুরু করে ব্রিটিশ এলিট সকলের পোশাকই আমাকে নকশা করতে হয়েছিল। অস্কারের একটি নিয়ম হচ্ছে, একজন ব্যক্তিকেই চলচ্চিত্রের সব পোশাক-পরিচ্ছদ নকশা করতে হবে। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই, এমনকি বর্তমানেও, অভিনয়শিল্পীর পোশাকের নকশা করে একাধিক কস্টিউম ডিজাইনার এবং অনেক সময় এ কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। তারকা আসে আর বলে, ‘আমার পোশাকের নকশা নেন, একরকমভাবে নিলেই হলো।’ ১৯৮০ সালের দিকে অনেক পোশাক নকশাকার চলচ্চিত্রশিল্পে কাজ করতে আসে। একজন তারকা আর একটি চরিত্রের পোশাক নকশা করা পুরো ভিন্ন বিষয়। বলা যেতে পারে, দুটি ভিন্ন কাপের চা।