বাঙালি সংস্কৃতি ও রুপালি ইলিশ
সেকালে গঙ্গার ধারে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কথা প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়কে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে ইলিশ মাছ দেখলেই লোকে দাম জিজ্ঞাসা করে, এর কারণ কী?’ গোপাল উত্তর দিয়েছিল, ‘এটা বাঙালির স্বভাব মহারাজ। তবে আমি যদি ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরি, আমাকে কেউ দাম জিজ্ঞাসা করবে না।’ মহারাজ এ কথা একদমই বিশ্বাস করলেন না, ‘এ অসম্ভব, হতেই পারে না, লোকে দাম জিজ্ঞাসা করবেই!’
তারপর বাজির শর্ত অনুযায়ী ইলিশের দাম যেন কেউ জিজ্ঞেস না করে, সে জন্য গোপাল পরনের ধুতি খুলে মাথায় বেঁধে নিয়েছিল। নাঙ্গা অবস্থায় দেখে তাকে কেউ আর ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেনি। আর গোপাল ভাঁড়ও মহারাজের কাছ থেকে বাজি জিতেছিল একশ টাকা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইরাবতী, পদ্মা, মেঘনা, গঙ্গা, সরস্বতী বা সিন্ধু নদীর অববাহিকা ইলিশ মৌসুমে মাছে থাকে পরিপূর্ণ। যদিও স্বাদেগুণে পদ্মার ইলিশের ধারেকাছে স্থান নেই অন্য নদীগুলোর। নিজেদের জৈবনিক প্রয়োজনে উপকূলবর্তী সাগর থেকে উঠে এসে মানুষের রসনাতৃপ্ত করে ইলিশ। মানুষকে সুযোগ করে দেয় ইলিশ নিয়ে মাতামাতি করার। দক্ষিণ এশিয়ার ৫০-৬০ ভাগ ইলিশ বাংলাদেশে ধৃত হয়। ধৃত এই লাখ টন ইলিশে জীবিকা নির্বাহ করে অর্ধকোটি মানুষ। দেশ পায় হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। তাই আমরা উপমহাদেশের ২৬ কোটি ইলিশপ্রেমী মানুষ ভালোবেসেই ঘোষণা করে দিয়েছি মাছের রাজা ‘ইলিশ’।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে, ইলিশের উপাদেয় আস্বাদ নিয়ে একালেও মানুষের ঔৎসুক্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি; বরং ইলিশকেন্দ্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ রসনাবিলাসের সঙ্গে আমরা এখন নববর্ষ উদযাপনের মতো নানা উৎসব পার্বণের অনিবার্য অংশ করে নিয়েছি এই রুপালি ইলিশকে। ইলিশ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিদেশ থেকে অতিথিরা এলে আর কিছুতে না হোক এক টুকরো পদ্মার ইলিশ খাইয়ে খুশি করা চাইই চাই। জল ছাড়া ইলিশ বাঁচে না জেনেও ওপক্ষ জল না ছেড়েই ইলিশটা ঠিকঠাক নিয়ে নেয়। কারণ, পদ্মার ইলিশ ছাড়া ভারতীয়দের জামাইষষ্ঠীই হয় না, অগত্যা কী আর করা, ইলিশ রপ্তানি করেই আমরা প্রতিবেশীর মন জুগাই। আর এভাবেই এতদাঞ্চলে সাদা ইলিশ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সম্পর্ক বিনির্মাণের অন্যতম অনুঘটক।
এমন মনোলোভা স্বাদের ইলিশ যেমন আমাদের সংস্কৃতিকে পূর্ণতা দিয়েছে, তেমনি যুগে যুগে সাহিত্যসেবীরা ইলিশকে তাঁদের রচনার অংশ করে নিয়েছেন। নবম শতকের প্রাচীন সংস্কৃত পণ্ডিতরা ইলিশের তেলের নানা গুণাগুণ বর্ণনা করে ইলিশকে ‘বিজয়ের সুধা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইলিশ নিয়ে খুব বেশি মাতেননি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই দুই কবিরই শ্বশুরবাড়ি যদিও বাংলাদেশে, তবু ইলিশ নিয়ে তাঁদের রসনাবিলাসের ফিরিস্তি খুব বেশি নেই। কাজী নজরুল ইসলামের লেখার দু-এক স্থানে ইলিশ মাছের উল্লেখ থাকলেও কবিতায় তেমনটা নেই। পদ্মা এবং পদ্মার ঢেউ নিয়ে ‘পদ্মার ঢেউরে’ শিরোনামে তিনি তাঁর বিখ্যাত গানটি লিখেছিলেন। কিন্তু পদ্মার প্রধান অনুষঙ্গ ইলিশ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি নজরুল। অবশ্য নজরুলের মতো চির বিদ্রোহী কবির রসনাবিলাস নিয়ে কথা বলবার ফুরসত ছিল না হয়ত।
অন্যদিকে রবীন্দ্রকাব্যেও ইলিশের দৃশ্যমান হাবভাব নেই। তিনি পদ্মা নামের বোটে চড়ে পদ্মা নদী চষে বেড়ালেও ইলিশে তাঁর মন পড়েনি। তবে কি শ্বশুরবাড়ির ইলিশের স্বাদে কবি যথার্থ আপ্যায়িত বা তৃপ্ত হননি? সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয়। তবে জানা যায়, ইলিশের মৌসুমে পদ্মায় ইলিশ খুব সস্তা হয়ে গেলে প্রচুর ইলিশ মাছ কেনা হতো শিলাইদহের কাছারিবাড়িতে। সেই মাছ রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কৃষি খামারে মাটির নিচে পুঁতে সার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
রবীন্দ্র-নজরুলের উত্তরসূরি কীর্তনখোলা নদীপাড়ের বাসিন্দা কবি জীবনানন্দ দাশের মনও ইলিশে ভরেনি। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির হাজার রূপ ধরা দিলেও রুপালি ইলিশ সেখানে নাচন তোলেনি।
তবে ইলিশ মাছ নিয়ে সার্থক কবিতা লিখেছেন একমাত্র কবি বুদ্ধদেব বসু। তিনি ইলিশকে বলেছেন ‘জলের রুপালি শস্য’। তাঁর রচিত ‘ইলিশ’ কবিতা যেন যথার্থই ইলিশপুরাণ। বর্ষাকে করে দিয়েছেন তিনি ইলিশ উৎসব।
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস শর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতায় ছন্দে ছন্দে বর্ষাকে আবাহন করেছেন। ইলিশকে রেখেছেন তিনি বৃষ্টির স্বরূপ বন্দনায় :
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম|
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম। ...
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুম-বাগানের ফুল।
একইভাবে কবি ফররুখ আহমদও শ্রাবণ বৃষ্টিধারাকে ইলিশের ঝাঁকের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন :
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
আসলো উড়ে মেঘের ঘুড়ি।
হাওয়ায় বাজে রেশমি চুড়ি
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি।
ইলিশের প্রেমে পড়ে আমাদের কালের সবচেয়ে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ‘ইলিশ রান্না’ শীর্ষক বই লিখে গেছেন :
‘খাওয়াদাওয়ার পর রাতভর শুধুই ইলিশের গল্প। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি না যমুনার ইলিশের? সুরমা নদীতে যে ইলিশ ধরা পড়ে তার স্বাদ গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো। তার কী কারণ? এই নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা। একজন আবার শোনালেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খাওয়ার ইলিশের গল্প। স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশ মাছের নাক থেঁতো হয়ে যায়। সেই সব নাক ভাঙা ইলিশই আসল পদ্মার ইলিশ।
এর পর শুরু হলো ইলিশ রান্নার গল্প। দেখা গেল সবাই ইলিশ রান্নার কোনো না কোনো পদ্ধতি জানে। ভাপে ইলিশ, চটকানো ইলিশ, শুধু লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে সেদ্ধ ইলিশ। গভীর রাত পর্যন্ত গল্প চলতেই লাগল।’
ইলিশের সাংস্কৃতিক মূল্য নির্ধারণে আজকাল দেশ-বিদেশে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। সেসব গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য ছাড়াও ইলিশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জীবিকা সৃষ্টির মূল্য রয়েছে। একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইলিশের এই চার বিষয়ের আর্থিক মূল্যমান পরিমাপ করেছে গবেষকরা। তাতে এর খাদ্যবহির্ভূত গুরুত্বের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ইলিশ। ইলিশের যথার্থ পরিচর্যা এখন দেশের জিডিপিরও অন্যতম ভরসা।
গবেষণা বলছে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের কাছে ইলিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ওডিশা, বিহার ও আসামেও বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে ইলিশের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। পয়লা বৈশাখ, জামাইষষ্ঠী ও পূজায় ইলিশের ব্যবহার এখন নিয়মিত।
সমাজে পুলিশ আর ইলিশের গুরুত্ব ও মূল্যমানের সাযুজ্য বোঝাতে ওডিশায় একটি প্রবাদই চালু আছে, ‘মাছ খাও তো ইলিশ, চাকরি করো তো পুলিশ’।
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা একদিন বাজার থেকে নিজের পরিবারে জন্য মোটে চার টুকরো ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কাক এসে ছোঁ মেরে ইলিশের পোঁটলা নিয়ে গেল। নিরুপায় হোজ্জা কাকটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘তুই মাছ নিয়ে কী করবি? রান্না তো আর করতে পারবি না!’ কাকও হেসে উত্তর দিল, ‘পদ্মার ইলিশ এত স্বাদ যে, রান্না না করেও তা খাওয়া যায়!’
বর্ষা এলেই বাঙালি এমন সুস্বাদু ইলিশের স্বাদ পেতে বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। রোজকার প্লেটে ইলিশ না থাকাটা যেন অনাহারীতার স্বাক্ষর। বর্ষার মেঘমেদুর দিনে বৃষ্টির রিমিঝিম শব্দের সঙ্গে কাঁচা লঙ্কাসমেত ধূমায়িত ইলিশের ঘ্রাণে বাঙালির রসনা পায় তৃপ্তকর যৌবন। তখন বাঙালির কণ্ঠে বাজে সেই যৌবনের গান, আহা ইলিশ!’
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।