ভ্যালেন্টাইন পুরাণ

ফেব্রুয়ারির ১৪। সংখ্যায় কিংবা মাসের হিসেবে বছরের ৩৬৫ দিনের একটা দিন। আপাত দেখতে আর দশটা দিনের মতো হলেও এর গুরুত্ব যে কী আমরা সবাই সেটা জানি। কারণ এ তো ভালোবাসার দিন, কিউপিডের তাক করা তীরে হৃদয় পেতে দেওয়ার দিন। ভ্যালেন্টাইনস ডের পদবিতে ভর করে সারা পৃথিবীতে চলে ভালোবাসার আহ্বান, ভালোবাসার জয়গান। প্রিয়জনকে কবিতা, ফুল, রং-বেরঙের কার্ড আর চকোলেট দিয়ে চলে ভালোবাসার প্রকাশ।ভালোবাসা প্রকাশের আরো কত পথ যে আছে সে তো বলেও শেষ করা যাবে না! ভালোবাসা উদযাপনের, ভালোবাসা ঘোষণার এই দিনের আদিকথা জানতে গেলে তাকাতে হবে বহু পেছনে- রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন দিনগুলোর দিকে। ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তির গল্প সেখানেই।
খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে রাজা ন্যুমিতরা শাসন করছিলেন আলবা লঙ্গা রাজ্য। ক্ষমতা দখলের লড়াই তো আর আজকের বিষয় নয়, সৃষ্টির আদি থেকেই আছে। সেই ধারা জারি রেখেই রাজার ছোট ভাই আমিলুয়াস রাজাকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করে। ধর্মসম্মতভাবে সিংহাসনের কোনো উত্তরাধিকারী যেন না থাকে, সে উদ্দেশ্যে আমিলুয়াস বড় ভাই রাজা ন্যুমিতরার একমাত্র মেয়ে কুমারী সিলভিয়াকে সন্ন্যাসিনী হতে বাধ্য করে। সিলভিয়া এই নিষেধাজ্ঞার শৃঙ্খলে আটকে থাকতে চায়নি। তার দাবিতে সাড়া দেয় দেবতা মার্শ। অরণ্যের মাঝে মানুষ আর দেবতার প্রেমজ সংসর্গ ঘটে, জমজ পুত্রসন্তানের জননী হয় সিলভিয়া।
এ ঘটনা জেনে ফেলে আমিলুয়াস, সিলভিয়াকে বন্দি করে তার সন্তানদের হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এতটা নির্মম পরিণতি জমজ ভাইদের ছিল না। সেবিকারা শিশু দুটিকে একটি ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়ে ভাসিয়ে দেয় টাইবার নদীর স্রোতে। সেখান থেকে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে একটি মাদী নেকড়ে। শিশু দুটি বেড়ে ওঠে সেই নেকড়ের দুধ পান করে। ধীরে ধীরে শিশু দুটি বড় হয়। তারা পরিচিত হয়ে ওঠে রেম্যু ও রম্যুলাস নামে। পেশা হিসেবে তারা বেছে নেয় মেষ পালন।
একদিন রাজা আমিলুয়াসের মেষ পালকদের সাথে দুই ভাইয়ের ঝগড়া হয়, রেম্যুকে বন্দি করে রাজার কাছে নেওয়া হয়। এমন অবস্থায় আরেক ভাই কি হাত গুটিয়ে থাকতে পারে? রম্যুলাস তার বন্ধু ও সমর্থকদের নিয়ে রাজার বাহিনীকে আক্রমণ করে, কুচক্রী আমিলুয়াসকে হত্যা করে উদ্ধার করে ভাইকে। সেইসাথে মুক্ত করে তাদের পিতামহ ন্যুমিতারাকে।
পিতামহকে সিংহাসন বুঝিয়ে দিয়ে দুই ভাই ঠিক করে, তারা নিজেরাই একটি নতুন বসতি গড়ে তুলবে। দুই ভাই তাদের বন্ধু আর অনুসারীদের নিয়ে নতুন বসতি গড়ে তোলার জন্য যাত্রা শুরু করে অজানার উদ্দেশে। কোথায় নতুন বসতি হবে আর কে হবে তার রাজা, এই নিয়ে এবারে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। তারপর দুই ভাই মিলে নেয় বিচিত্র সিদ্ধান্ত। সবচে বেশি পাখি আসবে যার নজরে, সেই ঠিক করবে নতুন বসতি কোথায় হবে। আর হ্যাঁ, রাজার মুকুটও তার মাথাতেই উঠবে।
এরপর রম্যু দেখে ছয়টি পাখি আর রম্যুলাস দেখে বারটি পাখি। রম্যুলাস দাবি করে সে প্রথমে ছয়টি ও পরে ওই ১২টি পাখি দেখেছে, সুতরাং জয় তারই।
এপ্রিল ২১, ৭৫৩ (খ্রি.পূ.) রম্যুলাস নতুন বসতির নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু রম্যু বাধা দিলে তাকে হত্যা করা হয়। তারপর রম্যুলাস নতুন বসতির নাম দেয় 'রোম'। নিজেকে ঘোষণা করে রোমের প্রথম রাজা হিসেবে।
নতুন বসতির সবচে বড় সংকট হলো, সেখানে স্ত্রী লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। রাজা রম্যুলাস তাই বুদ্ধি করে কনস্যুলা উৎসবের ঘোষণা দেয় এবং প্রতিবেশী জনবসতি থেকে সাবাইনদের আমন্ত্রণ করে। সাবাইনরা স্ত্রী-পুত্র কন্যা, দাস-দাসীসহ রোমানদের কনস্যুলা উৎসবে যোগ দিতে চলে আসে। উৎসব চলছে, এরই মধ্যে হঠাৎ রোমানরা ধারণ করে অস্ত্র। তারা সব পুরুষকে চলে যেতে আদেশ দেয়। সেইসাথে জানিয়ে দেয়, তারা যদি তাদের স্ত্রী, সন্তান ও দাসীদের অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেতে চায় ৭০০ কুমারীকে উপহার হিসেবে রেখে যেতে হবে।
৩৭৫ (খ্রি.পূ.) অব্দেও রোমানদের জন্মহার আশানুরূপ না থাকায় তারা নতুন একটি উপাসনালয় নির্মাণ করে দেবী জুনোর নামে। তারপর তারা লুপের্কালিয়া নামের এক উৎসবের আয়োজন করে ফ্রেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে। এই উৎসবে তারা দুটি পুরুষ ছাগল ও একটি মাদী কুকুর বলি দিত। বিশ্বাস ছিল যে, এতে তাদের জন্মহার বৃদ্ধি পাবে এবং শিশু মৃত্যুহার কমে আসবে। এই উৎসবের আগের দিন রোমানরা খুঁজে নিত তাদের নিজেদের সঙ্গী, আর এ বিষয়কে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করত।
পোপ গেলাসিউস তার শাসন কালে (৪৯২-৪৯৬ অব্দ ) প্যাগানদের ধর্মীয় উৎসবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এই পুরনো আচারকে 'সেন্ট ভ্যালেনটাইন দিবস' নামে পুনঃ স্থাপন করে। এর আগে প্যাগানরা যখন খ্রিস্টানদের নিপীড়ন, জুলুম ও হত্যা করেছিল, তখন অনেক শহীদের নাম ছিল ভ্যালেনটাইন।
এর আগে সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোদিউস বিশ্বাস করতেন যে অবিবাহিত পুরুষরা তুলনামূলক ভাবে বেশি শক্তিশালী ও অনুগত হয়। এ কারণে তিনি সৈন্যদের বিবাহ প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এই নিষেধাজ্ঞাকে মেনে নেয়নি এক সৈনিক, নাম তার ভ্যালেন্টাইন। রাজার আদেশকে উপেক্ষা করে সে গোপনে বিয়ে করে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। এই ঘটনা বেশিদিন গোপন থাকে না, প্রকাশ হয়ে যায় অচিরেই। এরপর রাজার আদেশে প্রেমিক ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগ থেকেই সৃষ্টি ভালোবাসা দিবসের, ভ্যালেন্টাইন’স ডের।
আজকের ভালোবাসা দিবস উদযাপনের সময় রম্যুলাস, রম্যু, রোমান মিথোলজি, প্রাচীন উৎসব কিংবা খ্রিস্টান চার্চ ব্যবস্থার কথা আমাদের হিসেবে আসে না। ফুল, চিঠি, কার্ড কিংবা চকোলেটের মতো উপহার দিয়ে বিশ্বজুড়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যের সাথে ভালোবাসার ভাব আদান-প্রদান করে। তবে প্রাচীন দিনের মতো আজও এই দিনে আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার দিন। রীতিনীতিতে হয় তো এসেছে পরিবর্তন, তাতে কি? আজ ভালোবাসার দিন, সেই প্রাচীন লুপের্কালিয়া উৎসবের মতো আজও দিনটি পছন্দের মানুষকে বেছে নেওয়ার; আপন করে চাইবার!
‘উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন?’