স্মরণ

কেন হুমায়ূন আহমেদ

Looks like you've blocked notifications!

জনপ্রিয় একজন লেখকের প্রয়াণে গোটা জাতি যে আবেগসিক্ত হয়, নিমজ্জিত হয় শোকসাগরে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কীভাবে ভেঙে পড়েছিল কলকাতা শহর, তা আমরা দেখিনি। তবে বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে তাঁর একটা নিপুণ ছবি পাওয়া যায়। হুমায়ূনের শবযাত্রা দেখে, শহীদ মিনারে লাখো জনতার শোকবিহ্বলতা দেখে সেদিন আমার বারবার মনে পড়েছিল বুদ্ধদেবের সেই বর্ণনা। এত মানুষ, এত অশ্রু, এত ভালোবাসা হুমায়ূনের শবযাত্রার আগে আমি কখনো দেখিনি। সেদিন হুমায়ূন আহমেদ তা আমাদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

কেন হুমায়ূন আহমেদ? কী কারণে মানুষের বাঁধভাঙা এই উচ্ছ্বাস, কী কারণে এত শোক এত অশ্রু এত ভালোবাসা? একজন লেখকের জন্য পাঠকের ভালোবাসা থাকবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলে এত কেন? হুমায়ূন তা দেখাতে পারলেন কোন গুণে? কোন কারণে তাঁর উপন্যাস কিনতে, ছবি দেখতে, নাটক উপভোগ করতে ক্রেতা ও দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়তেন আর পড়ছেন, আর কেনই-বা তাকে বলা হতো জাদুকর? মৃত্যুর এতদিন পরেও কেন তিনি পাঠক-দর্শকনন্দিত?

হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, আমার বিবেচনায়, তিনি এ দেশের মানুষকে এ দেশের তরুণ-তরুণীকে গ্রন্থমুখী করতে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। যাঁরা পাঠ করতেন ‘দস্যু বনহুর’ কিংবা ‘মোহন’ সিরিজের বই, রোমেনা আফাজ ছাড়া যাঁদের গত্যন্তর ছিল না, তাঁরা  হাতে পেলেন ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, তাদের কাছে এসে দাঁড়াল হিমু শুভ মিসির আলীরা আর মুহূর্তেই সবার মন জয় করে নিলেন হুমায়ূন। তরুণ সমাজকে হুমায়ূন অলৌকিক শক্তি দিয়ে টেনে নিলেন তাঁর গ্রন্থভুবনে; যারা ডাঙ্গুলি খেলত আর আড্ডা দিত গলির মোড়ে, তারা হুমায়ূনের বই পেয়ে অভ্যস্ত হলো পাঠে। বোঝা যায়, একজন লেখকের  খেলাটা কোথায়?

অন্য একটা দিক থেকে বিষয়টাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা যায়। হুমায়ূন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে একটা জাতীয় রুচি তৈরি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন জাতীয় সম্পদ। কীভাবে? যদি না থাকত তাঁর উপন্যাস, তাহলে উৎসাহী পাঠক অন্যের লেখা উপন্যাসের দিকে হাত বাড়াত। বিদেশি উপন্যাস বিক্রি হতো, লাগত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সেসব বই আমদানির জন্য। অতএব, এভাবে হুমায়ূন যে অলক্ষে কী কাজটা করে গেছেন, একবার ভেবে দেখা যায় তো! তাঁর বই মুদ্রণ বাঁধাই বিক্রি, সেও তো এক বিরাট অর্থনৈতিক কাজ। কত মানুষ জড়িত এই কাজে। কেবল হুমায়ূনের বই মুদ্রণ বাঁধাই বিপণন করেই অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টিকে আছে এই বাংলাদেশে। আজকের এই পণ্যপূজাশাসিত পৃথিবীতে, পণ্যায়নের চোখ দিয়ে বিবেচনা করলে লেখক হুমায়ূন আহমেদের রচনাকর্মকে তো ভিন্ন একটা মাত্রায় দেখা যেতে পারে।

হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মের একটা বড় জায়গা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নানাভাবে নানা মাত্রায় তাঁর উপন্যাস নাটক চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন তাঁর বাবা। ওই অভিজ্ঞতাই ওই স্মৃতিই, ধারণা করি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিল্প সৃষ্টিতে তাঁকে বেশ তাড়া দিত। উপন্যাসে ছোটগল্পে নাটকে চলচ্চিত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি অখণ্ড ইতিহাস আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর এসব শিল্পকর্ম দেখে ও পাঠ করে এ দেশের তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারছে, জানতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কথা। সে হিসেবে, কালান্তরে হুমায়ূন আহমেদের এসব রচনা ও শিল্পকর্ম কেবল শিল্পই থাকবে না, হয়ে উঠবে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস সংগঠনের অপরিহার্য উপাদান।

হুমায়ূন আহমেদ যুব সরল সাবলীল ভাষায় উপন্যাস রচনা করেছেন। মানুষের হৃদয়ে পৌঁছবার অভূতপূর্ব এক শক্তি ছিল তাঁর। বোধ করি শরৎচন্দ্রও এখানে হার মানবেন তাঁর কাছে। হাস্য কৌতুক রঙ্গ-ব্যঙ্গের মাধ্যমে পাঠক ও দর্শকের হৃদয়ে অবলীলায় ঢুকে যেতে পারেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নাটক দেখতে বুঁদ হয়ে বসে পড়ে গোটা একটা জাতি, তাঁর চলচ্চিত্র দেখতে গোটা পরিবার প্রবেশ করে সিনেমা হলে। মধ্যস্তরের মানুষের মনস্তত্ত্বকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর করতলে নিয়ে খেলতে জানতেন, খেলাতে পারতেন। তাঁর কৌতুক নির্মল, তাঁর হাস্যরস অম্লমধুর। এই নির্মল অম্লমধুর হাস্যরসজ্ঞানই আমার বিবেচনায়, তাঁর সৃষ্টিকে এতটা জনপ্রিয় করেছে। পাঠকচিত্তে তিনি সঞ্চার করেন মাঙ্গলিক বোধ, তাদের করে তোলেন মানবতামুখী। পাঠকের সামনে মঙ্গলের বার্তাবহ কল্যাণের প্রতীক হয়ে হাজির হয় হুমায়ূনের হিমু শুভ্র মিসির আলিজা। তাঁর পাঠকরাই হয়ে ওঠে একজন হিমু, একজন শুভ্র, কিংবা অনেকজন মিসির আলী। সৃষ্টিকর্মে কল্যাণ, মঙ্গল আর মানবতার কথা বলেন বলে হুমায়ূনের রচনা, তাঁর নির্মাণ পাঠক-দর্শকের কাছে লাভ করে এত সহানুভূতি, এত ভালোবাসা!

আখ্যান-বর্ণনায় হুমায়ূন তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব একটা ঢং, বৃত্তান্ত বয়ানে তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটা কৌশল। ঢং আর কৌশলটা এতটাই সম্মোহনী ছিল যে, দুই শতাধিক উপন্যাস লিখেও সেখানে থেকে তিনি বের হতে পারেননি, কিংবা বের হতে চাননি। একবার, মাত্র একবার প্রবল পরাক্রম নিয়ে, স্বরচিত ওই ঢং আর কৌশল ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিলেন  হুমায়ূন আহমদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে। আমি নির্দ্বিধায় বলব, অন্য কিছুর জন্য না হলেও কেবল ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের জন্য হুমায়ূন আহমেদ টিকে যাবেন বাংলাভাষী পাঠকের কাছে। এ উপন্যাসে হুমায়ূন ইতিহাসকে দিয়েছেন অনন্য অবয়ব। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে হুমায়ূন ইতিহাস ও কল্পনার আনুপাতিক সম্পর্ক রক্ষা করে শিল্প-সৃজনে ঈর্ষণীয় সিদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে কল্পনার সত্যের জৈব-ঐক্য মিলনই ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের শৈল্পিক সার্থকতার প্রধান শক্তি-উৎসব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত মহাকাব্যিক এই নির্মাণটিই হুমায়ূন আহমেদকে অনাগতকাল ধরে পাঠকের হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

হুমায়ূন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ লেখক। লেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাও তিনি অবলীলায় পরিত্যাগ করেছেন। সৎ থাকতে চেয়েছেন নিজের কাছে, সমাজের কাছে। মাঙ্গলিক চেতনা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মের বিশিষ্ট লক্ষণ। এমন সৎ ও দায়বদ্ধ লেখক যে পাঠককে আকৃষ্ট করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক।