কুরোসাওয়া কথা

চারাগাছের কথা

Looks like you've blocked notifications!

 

ভূমিকা

জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।

সাধারণত গ্রিনহাউসে আশ্রিত কচি চারাগাছের মতোই নিজেদের শৈশব কাটায় শিশুরা। এমনকি যদি কখনো বাস্তব দুনিয়ার বাতাস কিংবা বৃষ্টি এসে কোনো ফাটল ধরায়, তবু শিলাবৃষ্টি ও তুষারপাতের কারণে শিশুর মনোজগতে কোনো বিরূপ ছাপ পড়ে না হয়তো। শৈশবে আমিও এমন আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছি। জীবনে দমকা-হাওয়ার সত্যিকারের প্রথম অভিজ্ঞতাটি অর্জন করেছি মহাপ্রলয়ঙ্ককারী কান্তো ভূমিকম্পে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের মতো ঘটনা, এবং সেই দিনগুলোতে জাপানি সমাজের সংকটকাল ও উথাল-পাতালের কথা আমি কেবল শুনেছিই, যেন আমার চারাঘরের বাইরে বয়ে যাওয়া বাতাস ও বৃষ্টির মতো করে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করে যখন বের হলাম, তখনই প্রথমবারের মতো মনে হলো, যেন আমাকে পুতে দেওয়া হয়েছে বাইরে কোথাও। আমি নিজের ত্বকের ওপর অনুভব করতে শুরু করলাম দুনিয়ার নানা ঘটনার বাতাস ও বৃষ্টি।

১৯২৫ সালের কথা। তখন আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র; সে সময় জাপানে রেডিও সম্প্রচার প্রথমবারের মতো শুরু হলো। আমার যদি শুনতে ইচ্ছে নাও করত, তল্লাটে রেডিও তবু বেজেই চলত; ফলে একে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। আগেই বলেছি, তখনই স্কুলগুলোতে সামরিক শিক্ষার কোর্স চালু হয়েছিল, এবং দুনিয়া হয়ে উঠেছিল কোনো-না-কোনোভাবে দ্রুত ধাবমান ও শীতল। অতীতের সেই দিনগুলোতে এখন ফিরে তাকালে টের পাই, আকিতায় আমি যে গ্রীষ্মকালটি কাটিয়েছিলাম, সেটিই ছিল নিজের শৈশবের সর্বশেষ নির্ভাবনার জীবন।

তবে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ হয়তো আমার নিখাঁদ ভাবালুতার ফল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষে পড়ার সময়, আমার বয়স ছিল ১৬ বছরের মতো, তখনো একটা ক্রিস্টাল রেডিও সেটের চারপাশে খাবি খেতাম আমি। রোববারগুলোতে, আমি বাবার পাস সঙ্গে নিয়ে [তিনি কেন এটির অধিকারী হয়েছিলেন, সত্যিকার অর্থেই জানি না], মেগুরো রেসট্র্যাকে চলে যেতাম। সারাদিন সেখানে কাটাতাম ঘোড়া দেখে। ঘোড়া আমার শৈশব থেকেই প্রিয়। মা-বাবা আমাকে এক সেট অয়েল-পেইন্ট কিনে দিয়েছিলেন। ফলে টোকিওর শহরতলিতে গিয়ে, সেখানে দেখা প্রান্তিক জীবনের ছবি আঁকতাম। বেশ ভালোই দিন কাটছিল আমার।

এ সময়ে আমাদের পরিবার কোইশিকাওয়া ছেড়ে মেগুরো অঞ্চলে পাড়ি জমায়, আর তারপর সেখান থেকেও চলে যায় শিবুয়ার কাছাকাছি অঞ্চল-- এবিসুতে। এ সবই টোকিও অংশ। যতবারই বাড়ি বদলাতাম আমরা, নতুন বাড়িটি হয়ে ওঠত আগেরটির তুলনায় আরো ছোট ও কম সুন্দর। পরিবারের আর্থিক অবস্থা যে দিন দিন খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আমি তখন তা বুঝতে পারিনি। ফলে আমি তখনো, মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর, পেইন্টার হওয়ার বাসনায় মগ্ন ছিলাম।

এ পর্যায়টিতে এসে, পেশা হিসেবে কোন পথ বেছে নেব—সে বিষয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত ভেবে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। আজীবন ক্যালিগ্রাফি ভালোবাসা আমার বাবা, আমার লক্ষ্যের প্রতি সমবেদনা দেখিয়ে, বিরোধিতা করেননি। কিন্তু তখনকার দিনের যেকোনো মা-বাবার মতোই, তিনিও বলে দিলেন, এ জন্য আমাকে আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে হবে। সিজান ও ভ্যান গগের অনুরাগী হিসেবে আমিও মনে করতাম, এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা মানে শুধুই সময় নষ্ট করা। আর কোনো ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমার। তবু যদি দিতেই হয়, প্র্যাকটিকেল পেইন্টিং টেস্টে উৎরে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস যদিও ছিল, কিন্তু একাডেমিক কোর্স ম্যাটেরিয়ালের ওপর তা ছিল না একদমই। ফলে আমি ফেল করলাম ভর্তি পরীক্ষায়।

যদিও এ ব্যাপারটি বাবাকে বেশ হতাশ করল, তবু এর ফলে স্বাধীনভাবে নিজের স্টাডি করার পথেই হাঁটতে থাকলাম আমি। নিশ্চিত ছিলাম, এ বিষয়টি তাকে খানিকটা সান্ত্বনা দেবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ যে বছর শেষ করেছি, তখন আমার বয়স ১৮; তখন মর্যাদাপূর্ণ ন্যাশনাল নিতেন এক্সিবিশনে আমার আঁকা একটি পেইন্টিং জায়গা করে নিল। বাবা খুশি হলেন খুব। কিন্তু এর পরই ঝড় ও তুষারের ভেতর দিয়ে, একটা ঝড়ো পথে এগিয়ে যেতে হলো আমাকে।