সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
আন্ধা-ধোন্ধা বেহুঁশ হইয়া থাকা একটা শইল্লেরে নি ধইরা খাড়া রাখোন যায়! কোনো রকমেই যায় না। সেই শইল্লেরে দুই মাতারি ধইরা রাখলেই কী,আর তিন মাতারিয়ে ধইরা রাখলেই বা কী! অই নাই-হুঁশের দেহখানে না খালি কাইত হইয়া পইড়া যাইতে থাকে!
সেই বেহুঁশ শইলখানে না খালি পাও ভাইঙ্গা নিচের দিগে লেপ্টাইয়া পইড়া যাইতে চাইতে থাকে! এমনে বেঁকা তেমনে কাইত হইয়া কেবল না মাটিতে ঝুপ্পুর কইরা পইড়া যাইতে থাকে গা খোনে খোনে! তারে জাপোইট্টা ধইরা- খাড়া কইরা রাখোন- কী যাহা-তাহা কাম!
সেই কঠিন কর্মখান করতে থাকে জুলেখার মায়ে আর মংলার মায়! তাগো হাতের বেড় ফসকাইয়া জুলেখার বেহুঁশ শইলখান মাটিতে পইড়া যাওনের দশায় যায় গা কতোবার!
অর মায় তহন চিক্কুর দিয়া বেবোধা জুলেখারে নয়া কইরা জাবড়ানি দিয়া ধরে। সগল নিয়মবিধি পালন করুন্তি বন্ধ কইরা মাইয়ারে জাবরাইয়া খাড়া হইয়া থাকে সেয়। আর মংলার মায়রে কইতে থাকে আরেকদিগ দিয়া জুলেখারে ঝাপ্টানি দিয়া ধরতে। হায় হায়! খাড়ার তেনে পড়লে না মাইয়ার মাতা ফাইট্টা চৌচির হইয়া যাইবো! নাই-চিন্তায় জুলেখার মায় ধড়ফড়াইতে থাকে।
ইসসিরে খোদা! মাইয়ারে নিয়া কী ছিদ্দতের তলে না পড়োন লাগছে আবাগী মায়রে! জুলেখার মায়ের দিকে চাইয়া মায়ায়-দরদে কইলজা টপ-টপাইতে থাকে ইসুফ মিয়ার মায়ের । সেই যে; কথায় আছে না - কিসমতে যা লেখা আছে,তার বেশী মাইনষে না খাইতে পারে, না পিন্ধতে পায়! জুলেখার মায়ের কিসমতে এই জ্বালা-যাতনা, এই পিছার-বাড়িই লেইক্ষা থুইছে খোদায়! অহন মাইনষের খ্যামতা কী অরে উদ্ধার দেয়!
জুলেখার মায়ের লেইগা এই দুক্ষু পরানে নিয়া ইসুফ মিয়ার মায় জুলেখার শোধনের কাম-কাইজগিলি তরাতরি হাতে করতে থাকে। যত জলদি সেয় শোধন কর্ম শেষ করতে পারব, তত জলদি তো রেহাই পাইব এই দুই লাচার মাতারি, নাকি!
ইমাম হুজুরে কত কত নিয়ম-বিধি পালুন্তির ফরমাইশ দিতে থাকে ইসুফ মিয়ার মায়েরে।
কিন্তুক খোনে খোনে ঢুইল্লা পইড়া যাইতে থাকা মাইয়ারে কেমনে আর হুজুরের দেওয়া বিধিমাফিক টায়েটায়ে, নিখুঁত রকমে নিয়ম-শোধন দেয় ইসুফ মিয়ার মায়! দেওনের নি কোনো উপায় আছে!
সেই কারোনে সেয় করে কী- অন্তরে অন্তরে খোদাতাল্লার কাছে মাফ চাইয়া, কোনোমতে আধা-মাধা প্রকারে নিয়ম-করমগিলি সারে। অখন বেহুঁশটারে আগে ভালামতোন যতন তো দিয়া লউক তারা! পরে আল্লার রহমতে এই মাইয়ায় যখন হুঁশে আইব, সেই দিনে ভালামতে আরেকবার করোন যাইবো নে নিয়ম পালনি!
শোধন-গোছল শেষ করাইয়া তরাতরি মাতারি তিন জোনে জুলেখারে ঘরে নেয়। তাগো আগে আগে যায় ইমাম হুজুরে। সেয় যায় ঘরের সর্বদিগে সোনা-রূপা ভিজাইন্না পানি ছিটাইতে ছিটাইতে। অইটাই সর্বশেষ শোধন কর্ম।
সর্বকর্ম ভালাভালি সাইরা ফালাইয়াও শান্তির মোখ দেখোনের নসিব হয় না জুলেখার মায়ের। মাইয়ারে শোয়ান্তি দিতে গিয়া সেয় দেখো কী এক নয়া যাতনায় পড়ে!
হয় কী, চেতনহীন মাইয়ারে ঘরে নিয়া মায় তো তারে বিছনায় শোয়ান্তি দিতে যায়; তেমুন সোমে পিছের তেনে ইমাম হুজুরে নিষেধ দিয়া ওঠে। 'করেন কী! করেন কী মা সগলেরা! মাইয়ারে বিছনায় নেন ক্যান! না না! অরে বিছনায় হোয়াইয়েন না!'
ক্যান ! ক্যান ! ঘরের লোক ঘরের বিছনায় হুইব ; এই কামে নিষেধ দেয় ক্যান হুজুরে! বিছনায় হোয়াইতে বাধা কিয়ের!
'হোনেন গো মায়েরা! বাধা আছে। বিষম বাধা আছে। জুলেখায় এতকাল আছিল নিরুদ্দিশ! এক হিসাবে তারে মউতাই ধইরা নিতে হইছিল লোক-সগলের। মউতারে তো বিছানে রাখনের বিধি নাই!'
'হুজুরে এইটা কী কয়!' জুলেখার মায়ে কিছু কওনের আগে ইসুফ মিয়ার মায়েই ইমাম হুজুরের লগে কটকটানি শুরু করে; 'যহন নিরুদ্দিশ আছিলো,তহন যা মোনে করোনের করছে লোকে। অহন সেই কথা দিয়া ফল কী! জুলেখায় অখন ফিরা আইছে। জ্যাতারে মউতা বানানি আবার কোন দেশি কতা!'
জুলেখায় যে ফিরা আইছে সেইটা ঠিক। কিন্তু কোনখান তেনে আইছে উয়ে, সেইটা তো জানোন যায় নাইক্কা! কই আছিলো, কী হালে আছিলো, কেমনে আছিলো তার কিছুই তো জানোনের কোনো উপায় দেহা যাইতাছে না! আর,ফিরাই যুদি আইছে; তাইলে এমুন বেহুঁশ দশা নিয়া আইছে ক্যান! জাগনা-চেতনা নাই ক্যান অর!
জুলেখায় যুদি হুঁশে থাকত,তাইলে বিষয়খান পরিষ্কার জাইন্না, সেইমতে বেবস্থা নিতে পারত হুজুরে। অবস্থা বুইজ্জা দোষ-কাটানি দিয়া সায়-শান্তি হালে জুলেখারে ঘরে থির করতে পারতো সেয় ! কিন্তু সেইটা করোনের কোনো উপায় কি কেউই পাইছে? পায় নাই। কোনো কিছু ভাইঙ্গা কওনের অবস্থায়ই নাই জুলেখায়।
অখন তাইলে- কিছুই না জাইন্না- মাইয়ারে বিছান দেওন কোনপ্রকারে ঠিক কাম হইবো? কোনো মতেই সেইটা ঠিক কর্ম হইবো না। আন্দাজে কিছু করলে ভালার ভালা কিছুই হইবো না। উল্টা, এই ভিটিত অহিত নামোনের বেবস্থা করা হইবো। নাই-ছুতায় গরদিশরে নামাইয়া আনা হইবো - আসমান তেনে!
গেরামে গরদিশ আইলে তো খালি এক বাড়িতেই সেই গরদিশ আইটকা থাকবো না! গেরামের সগল বাড়িতেই গিয়া হাজির হইবো ! অমঙ্গল-খরাপি গিয়া কোনো ভিটিতেই হাজিরা দিতে ছাড়ব না ! তহন কী উপায় হইবো!
নিজেগো বেখেয়ালের কারোনে গেরামের বেবাকতেরে বিপদে ফালানি কী মাইনষের কাম হইবো! অমুন অনাজ্জি কাম করলে খোদায় নি সইবো !
সেই চিন্তা মাথায় নিয়াই না হুজুরে জুলেখারে এমুন মাটিতে শোয়ানের নিয়ম পালনি করতে কইতাছে! সেই কারোনেই কইতাছে যে, জুলেখার হুঁশ আওয়া তরি কয়টা দিন এমনেই যাউক। থাকুক মাইয়ায় মাটিতে শোয়া। থাকুক সেয় উত্তর সিথানে পড়া। তারবাদে চেতন আইলে, নয়া কইরা বিধি পালনি দিয়া,তারে তোলন যাইবো নে চৌকিতে!
মাইয়ারে মাইজ্জালে,পাটির উপরে শোইয়াইতে জুলেখার মায়ের কইলজা ছিঁড়া যাইতে থাকে। তার সোনার নিধি! তারে নিজ ঘরের চকিটায় তরি ঠাই দিতে পারবো না তার মায়ে! এইটা কেমুন নিয়মের কথা কয় হুজুরে! কোন কাইল্লা নিয়ম!
কিন্তু মোখ ফুইট্টা কোনোপ্রকার বাদাবাদি করার কোনো সাহস হয় না তার! মাইয়ারে আরো কতো ঝাড়ফুঁক দেওন লাগবো, আরো কতো রকমে শোধন দেওন লাগবো - সেইসবের কী কোনো লেখা-জোখা আছে! সেই সগল কর্মে ইমাম হুজুরে আইয়া আগলানি না দিলে; উপায় কী হইবো ! এমুন মাইনষেরে নি বেজার করোন যায়! যায় না।
মোনের দুক্ষু মোনে থুইয়া জুলেখারে ঘরের মাইজ্জালে, পাটির উপর, শোওয়ায় তার মায়। হুজুরে যেমনে উত্তর সিথানে, ডাইন কাইতে শোয়াইতে কয়; তেমনেই শোয়াইয়া পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতে থাকে সেয়।
বাইরে ফিনফিন্না বাতাস থাকলে কী; ঘরের ভিতরে দেহি দোপোর না হইতেই বেধুম গরম লাগা ধরছে!
ইমাম হুজুরে কয়, 'অহন অরে কিছু খাওয়ান গো আপনেরা! কিছু দেন অর মোখে। পেটে খাওন গেলে মাইয়ায় পুরা জাগনা পাইলে পাইতেও পারে!'
এমুন বেহুঁশ, বেধোন্ধা হইয়া পইড়া রইছে যেই মাইয়ায়,তার মোখে কেমনে খাওন দেওন যাইবো! আর,তারে গিলানই বা যাইবো কী! ভাত মোখে দিয়া ফল নাই। না হেইটা মাইয়ায় চাবাইবো, না গিলবো !
তগ-নগদ আর কী দেওন যায় !
ইসুফ মিয়ার মায় কয়, অখন এই আধা-মরার মতোন ছেড়ীরে এট্টু দুধ খাওয়ানই হইবো ঠিক কাম।
দেওভোগ গেরামের কোনো মাইনষের কোনো ঠেকার কালে মংলার মায়রে কিছু করোনের লেইগা কোনোকালেই কোনো ফরমাইশ দেওন লাগে নাই! সেয় আপনার তেনেই সগলতেরে আগগানি-পাচ্ছানি দেয়। সগলতের হাতের লাঠি হইয়া লগে লগে ফিরে।
আউজকা জুলেখার মায়ে এই যে মাইয়ারে খাওয়ানির চিন্তায় দাপানি খাইতাছে; এমুন সোমে সেয় কী খাড়াইয়া খাড়াইয়া তামশা দেখবো! তেমুন নাদানির কর্ম করোনের লেইগা হের বাপে হেরে পয়দা করে নাই!
সেয় যে কোন ফাঁকে নিজের বুঝ-মতোন গিয়া মাঝারি কাঁসার-বাটির এক বাটি কুসুম কুসুম গরম দুধ লইয়া আইছে জুলেখার লেইগা,সেটা কেউই খেয়াল করে নাই! অই কুসুম গরম দুধ বেহুঁশ জুলেখার মোখে তোলোনের লেইগা বড় একখান ঝিনাইও সোন্দর ধুইয়া-পাখলাইয়া লইয়া আইছে সেয় ! দেইখ্যা জুলেখার মায়ের দুই চোখ দিয়া পানির নহর ছোটে! আহাহারে! আবাগী মাওটারে কেমুন ছেমা দিয়া থুইছে এই দুখখিনী মংলার মায়! আল্লায় অর ভালাই করুক!
ঝিনাই দিয়া দিয়া জুলেখার মোখে দুধ তুইল্লা দিলেই কী সেইটা গিলতে পারে মাইয়ায়! পারে না। অর মোখ বাইয়া দুধ মাটিতে টপ্পর-টপ্পর পইড়া যাইতে থাকে।
অখন কী করা!
একটা কামই অখন করোনের আছে। সেটা হইলো জুলেখারে কায়দা কইরা গিলাইয়া দেওন। তিন মাতারির একজনে যুদি জুলেখার থোতা ধইরা মোখটা ফাঁক কইরা রাখতে পারে,তাইলে ঝিনাই দিয়া সেই মোখে দুধ ঢালোনও যাইবো; মাইয়াটারে সেইটা গিলানও যাইবো !
তাইলে থোতা ধইরা থাকোনের কামখান মংলার মায়ই করতে পারব । নিজের মাইয়ারে খাওয়ানের কর্মখান করুক জুলেখার মায়ই । সগলতেরে যুদি বাতাস করোন লাগে ,তয় সেইটা করতাছে ইসুফ মিয়ার মায়।
যেমুন সাব্যস্ত করা হয়,সেই মতে খাওয়ানির কাম শুরু করে জুলেখার মায়ে। দেখো ! কত ভালা মতে, কেমুন সোন্দর অস্তে অস্তে, সেই দুধ গলা দিয়া নামতে থাকে জুলেখার!
ঝিনাই ঝিনাই দুধ মাইয়ার মোখে তুইল্লা দিতে দিতে মায়ের চক্ষের সামোনের দুনিয়া, আসমান-জমিন সব খুয়া খুয়া,ঝাপসা, ঘুটঘুট্টি হইয়া যায়!
আরে নসিব! নিজের সোনার টুকরারে মায়ে কী হালে ফিরত পাইছে! মাইয়ায় তার জিন্দা, না মরোনের রাস্তায় পড়া? সেই বিষয়খান মায়েও নি সঠিক রকমে বোজতাছে! হায় রে হায়! জুলেখায় দেখো পইড়া রইছে কেমুন নিঃসাড়, তাল-বোধ ছাড়া অবস্থায়। নাকের সামোনে হাত রাখলে বোঝোন যাইতাছে যে,দম আছে। এদিগে ঠেলা-ধাক্কা, ডাক-চিক্কুর দিয়াও হুঁশ আনোন যাইতাছে না! কী হইছে মাইয়ার! কী!
এই মতে ক্রমে তিনদিন তিন রাইত যায়। এই তিনদিন তিন রাইত জুলেখার চক্ষে-মুখে কী শইল্লে - কোনোরকম এট্টু চেতনের নাম-নিশানাও পাওয়া যায় না। মংলার মায়রে নিয়া দিনে- রাইতে ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা মাইয়ারে পাহারা দিয়া যায় জুলেখার মায়ে।
কিন্তুক পাহারা যেমুন তেমুন, অই শইল্লেরে খাওন তো দেওন দরকার ভালা মতোন ! এত্তা বড়ো জুয়ান ছেড়িরে খালি কয় বাটি দুধের উপরে কেমনে রাখোন যায়! শইল ভাইঙ্গা যাইব না তাইলে! ভাবনা-চিন্তায় জুলেখার মায়ে ছ্যারাভ্যারা হইয়া যাইতে থাকে।
তেমন চিন্তার কালে দেখো মংলার মায়ে কোনো বুদ্ধি করে! দেইকখ্যা জুলেখার মায় আবার কান্দন ধরে। এমুন মায়াও মাইনষে মাইনষেরে করতে পারে এই দুনিয়ায়! এমুন মায়া-বাসনা করোনের দিল কই পাইছে মংলার মায়!
দুধ ছাড়া জুলেখার মোখে আর কী দিলে অর উবকার হইব ! মংলার মায়ে সেই নিয়া এই-সেই ভাবনা করতে করতে আঁতকা তার মাথায় আহে- অর মোখে সাফ-সাফা, গরমা-গরম ফেন যুদি দেওন যায় কতখোন পরপর; তাইলে একটা কামের কাম হয়!
গেরামের সগলতের ঘরেই তো নানান সোমে নানান জোনে ফেন খাইতাছে নিত্যি! ফেন কী ফালা-ছড়া করোনের জিনিস নি! মোনে মোনে সেই বুঝ নিয়াই মংলার মায় করে কী, গরম গরম ফেনে এট্টু নুন দিয়া আইন্না জুলেখারে সোন্দর গিলানি দেওয়াইতে থাকে।
হউক ফেন! কিন্তুক পেটে তো যাইতাছে এট্টু কিছু! এমনে-সেমনে এই দিয়াই তো বাঁচনের তাগদখান অইতাছে জুলেখার শইল্লে ! নাইলে কইত্তেনে কেমনে কী হইত ! এই ডর ভিতরে নিয়া কতকখোন পর পর পানিরে, দুধরে, ফেনরে বেবোধা জুলেখার মোখে দিয়াই যাইতে থাকে একেক জোনে।
আর, কেমুন আচানকের বিষয় ! সেই সগল খাওনের জিনিসই জুলেখায় সোন্দর প্যাল- প্যালাইয়া গিল্লা নিতেও থাকে ! দেইক্ষা মোনে হইতে থাকে, য্যান কত বচ্ছর ধইরা এই পানি-কাঞ্জি ভিতরে যায় নাই অর!
পইল্লা দিন জোর কইরা মোখ খোলাইয়া দুধ ফেন গিলানি দেওয়াইতে হইছিলো ; কিন্তু দুই দিনের দিন কী মোনে কইরা মায়ে দুধভরা ঝিনাইখান মাইয়ার মোখের সামোনে নিতে নিতে ডাক দিয়া ওঠে, 'মাগো ! মোখখান খোলো তো! নেও তো দেহি মা- এই যে দুধটুক মোখে নেও !'
ওম্মা! কী আচানকের কারবার! সেই ডাক হুইন্না মাইয়ায় সোন্দর মোখ ফাঁক করে! এই এট্টুখানি, হাছা-মিছা কোনোরকম ফাঁক করে ঠিক; কিন্তু করে তো ! হেইটা দিয়া কী বোঝায়! বোঝায় না যে, উয়ে হুমুইর দিতেছে? উয়ে চেতন ফিরা পাইতাছে অস্তে অস্তে?
হুজুরে কয়, এইটা বড়োই ভালা আলামত। অর আত্মায় যে দেহ-পিঞ্জরে ফিরা আওনের রাস্তা বিছরাইতাছে,এইটা হইলো তারই নিশানা। অখন করতে হইবো কী- এট্টু পরপর জুলেখারে খালি হালকা-পাতলা ঠেলা-গুঁতা আর ধাক্কা দিয়া দিয়া দেখোন লাগব সেয় চেতন হয় কি না!
তবে অই হালকা ঠেলা-ধাক্কায় কোনোই ফায়দা হয় না। একেবারে পইল্লা দিনে জুলেখায় যেমুন নিঃসাড় আছিলো,তেমুন নিঃসাড়ই পইড়া থাকে মাইয়ায় বরাবর। এই মতে ক্রমে তিন দিন তিন রাইত যায়।
তারা য্যান তাগো লগে লগে মায়ের পরানের আশা- ভরসারেও টাইন্না লইয়া যায় গা!
তার অন্তর তারে য্যান কইতে থাকে,আর ভরসা করোনের কিছু নাই ! মাইয়ার জাগনা মোখ আর দেখোনের কিসমত নাই তার! এমনে চেতন ছাড়া থাকতে থাকতেই মাইয়ার শইল ছাইড়া যাইবো গা মাইয়ার রূহু ! মায়ের লগে একটা কোনো সুখ- দুক্ষের কথা কওনের হুঁশখানও পাইব না মাইয়ায়! কিছুতেই পাইব না !
চাইর দিনের দিন ভোর-বিয়াইন্না বেইলে জুলেখার মায় মনস্থির করে যে, আলা সেয় তার মাইয়ার লেইগা জালালি খতম দেওয়াইয়া দিব।
জালালি খতম দিবই দিব সেয়। আর দেরি করোনের কিছু নাই। অই খতম দেওয়াইবো সেয় আউজকাই। যুদি ইমাম হুজুরের হাত খালি থাকে, তাইলে অই খতম দেওনের কামটা আউজকা হইতে দোষ কী!
এই একখান খতম! বহুত আগুইন্না বহুত তুফাইন্না এক খতম। এই খতম পড়াইতে হয় বহুত বুঝ-বুদ্ধি কইরা। পড়াইতে হয় একেবারে শেষ ঠেকার সোমে। নাইলে এরে যেমনে-সেমনে, যখন-তখন,যে কোনো কামের লেইগাই দিয়া দেওনের কোনো বিধি নাই। মুরুব্বিরা কড়া নিষেধ দিয়া থুইয়া গেছে।
তারা কইয়া থুইয়া গেছে যে; হালকা বেপারে এই খতম দিছ, তো মরছ। জালালি খতম দিবা তুমি কঠিন বালা-মুসিবতের একেবারে শেষ সময়ে। যখন দেখবা বিপদ-বালাই কাটানির আর কোনো রাস্তা তোমার সামনে নাই; কোনো উপায় তোমার সামনে নাইই; তখনই খালি তুমি দিতে পারবা এই খতম।
আরো এক কামে এই তুক্ষার খতম দেওনের হুকুম দিয়া গেছে তারা। কইয়া গেছে যে; যখন দেখবা কোনো বিমারী মর মর হইয়া রইছে বহুত দিন, ভুগুন্তি খাইতে খাইতে পেরেশান হইয়া যাইতাছে, কিন্তু কোনো প্রকারেই তার দমখান বাইর হইতাছে না; সেই বিমারীরে অই আজাব তেনে রেহাই দেওনের লেইগা,তারে এহছান দেওনের লেইগা- দিতে হইব এই জালালি খতম।
বালা-মুসিবতের বাড়িতে এই খতম যেদিন দেওয়া হয়; তারবাদে তিন দিনও পার হয় না, বালা-মুসিবত কই যে উইড়া যায় গা- কেউ কইতেও পারে না।
অদিগে বিমারী-বাড়িতে ফলে অন্য ফল। খতম দেওয়ার পরে তিনদিনও পার হইতে পারে না, আল্লার হুকুম থাকলে বিমারী পুরা ভালা হইয়া বিছনায় উইট্টা বয়। নাইলে আল্লা-পাকে তারে তুইল্লা নিয়া যায় গা। তিন দিন পুরা হওনের আগেই তার মউত হয়। জালালি খতমের গুণে বিমারী এই প্রকারে রেহাই পায়।
নিজের মাইয়ার লেইগা সেই আগুইন্না খতমখান দিয়া একবার দেখতে চায় জুলেখার মায়ে,কী আছে তার কিসমতে! আর তো এমনে এমুন আধা জিন্দা আধা বেহুঁশ লাশ লইয়া পইড়া থাকোন যায় না!
এমনে এমনে আর কত! এমনে এমনে আর কয়দিন দেখব মায়!
আর তো সওয়া যায় না দেওভোগ গেরামের দশ মুখের দশরকম কথা! গেছে তিনদিন ধইরা জুলেখার মায়রে হাবি-জাবি নানান আজাইরা কথা কইতে কেউই ছাড়ে নাই।
মাইয়ায় এদিগে বেহুঁশ পইড়া রইছে পাটির উপরে; বাঁচব না মরব 'সেই চিন্তায় মায়ের পরান জারেজার। অদিগে গেরামের সগলতে খোনে খোনে এই বাড়িতে আইয়া কতো নাই-কথা কইয়া মায়ের কইলজারে ছেঁদা-ছেঁদা কইরাই যাইতে থাকে !
তারা তাগো মোনেরে এট্টু জিগায়ও না যে, তাগো অই কথাটি হুইন্না জুলেখার মায়ের কইলজার পানি কইলজায় থাকবো, না শুকাইয়া যাইব! জুলেখার লগে লগে আঁতকা দেওভোগ গেরামের মাইনষেও কি হুঁশহারা হইয়া গেল! সগলতের কী হইল!
লোকে আইয়া তার মাইয়ার হুঁশ ফিরানের লেইগা নানান কিসিমের টোটকার কথা যত না কইতে থাকে, তার তেনে শতগুণ বেশি কওয়া-বুলি করে অই জালালি খতমের বিষয়খান । তারা জুলেখার মায়ের মোখ বরাবর,একেবারে খোলাসা কইরা তো আর কয় নাই। কইছে ঠারে-ঠোরে, ঘুরান্তি- পেচান্তি দিয়া।
তবে লোকসগলতে কিন্তু মংলার মায়রে কি ইসুফ মিয়ার মায়রে অই কথাটা কইছে ভাইঙ্গা-চুইরা। এমনে জিন্দা লাশ লইয়া কয়দিন পইড়া থাকবো এই বাড়ির মাতারিয়ে! আর, গেরামের সগল জোনেই বা কয়দিন এমুন জিন্দা লাশরে গেরামে রাইক্ষা দিন পার করব!
পোলাপান নিয়া ঘর করে না তারা? কোনো একটা কুফা যুদি লোকের সংসারে আইয়া হাজির হয়,তহন ঠেলা সামলানি দিব নে কেমনে লোকে! এইটা জুলেখায়,না কোনো জ্বিন-ভূতে আইছে জুলেখার ভাও ধইরা - সেইটা কে কইতে পারে? মাইনষে কোনোসোম এমুন জীয়ন্তে মরা হইয়া পইড়া থাকছে? দুনিয়ার কোনো লোকে হোনছে এমুন আচানক কথা? হোনে নাই।
মাইনষের এমুন নাই কথার ঠেলায় জুলেখার মায়ে তরাসে না পইড়া পারে! বেদিশা-বেজাহানী না অইয়া পারে নি এই রাঁড়ী-আবাগীয়ে! নসিবে আলা যা লেখছে মাবুদে তাই হইবো নে ! কিন্তু লোকের কুকথারে বন্ধ না কইরা কেমনে এই আকাইম্মা মায়ে দানা-পানি মোখে দিবো !
মাইনষের কথার এই যাতনায় জুলেখার মায়ে এই তিন দিন তিন রাইত খালি পিনপিনাইয়া কান্দছে। কান্দছে আর খোনে খোনে ঝিনাই দিয়া দিয়া মাইয়ার মোখে দুধরে, ফেনরে দিয়া গেছে। লোকে যতো যাই কউক,মায়ের চউখে তো কোনো ভুল দেখতাছে না! কিয়ের জ্বিন-ভূত! অই যে তার মাইয়ার চান-মোখখান দেখা যায়! সেই মোখ দেখতে দেখতে মায়ে নি অন্তরের ফোঁপানি অন্তরে চাইপ্পা রাখতে পারে! হায় রে নসিব!
বিধি কোন হিসাবে কী করে- সেইটা কেবল তুমিই জানো রে বিধি!
দেখাইয়া ক্যান বঞ্চিত করল সেয়, এই তিনকূলে কেউ না থাকা দুকখিনীরে! মাইয়ারে যুদি সেয় ফিরতই দিল; তারে এমুন জিন্দা-লাশ কইরা ফিরত দেওন লাগব!
এই যে পোড়া-কপালী জুলেখার মায়ে! তার না আছে শইল্লের তাগদ; না আছে পুত-ক্ষেত, না আছে মাথার উপরে কোনো ময়-মুরুব্বির ছেমা। তাইলে একলা সেয় কেমনে এই আধা মরারে সামলায় ! আর কেমনেই বা সেয় লোকের চোপার মোকাবিলা করে!
তিনদিন তিন রাইত মাইয়ারে নিছা-পোছা দিতে দিতে ক্রমে জুলেখার মায় নিজের মোনরে শক্ত করে। দিব আলা সেয় তার মাইয়ার লেইগা জালালি-খতম। চাইর দিনের দিনই দিবো । হেইরপর তার কিসমতে থাকলে মাইয়ায় বাঁচবো, নাইলে যাওনের অইলে যাইব গা আল্লার দরবারে! জুলেখার মায়ে আর মিছা দরদ কইরা টাটাইব না।
এইমতে মতি থির কইরা জুলেখার মায় চাইর দিনের দিন বিয়ান বিয়ানই মংলার মায়রে মজিদে পাঠায়। তারে পাঠায় ইমাম হুজুররে এট্টু খামাখা কইরা ডাইক্কা আনোনের লেইগা। ফজরের নমাজের পর এই বিয়ান বেইলটুকেই হুজুররে যা এট্টু আজাইর পাওয়া যায়! ঠেকা পড়লে এই সোমেই তারে ডাক দিতে কইয়া গেছে তো হুজুরে নিজের মুখে।
মংলার মায়রে মজিদে পাঠাইয়া সেয় নিজে যায় মাইয়ারে খাওয়ানের দুধটুক জ্বাল দিয়া আনতে। এই কয়দিন জুলেখার মায় এট্টুখোনের লেইগাও মাইয়াটারে একলা থুইয়া কোনো দিগে যায় নাই।
হেদিন তার ভিতরে কী জানি কী বুঝ আহে! মোনে মোনে সেয় নিজেরে কয়, থাকুক না মাইয়ায় কতখোন একলা পড়া। ঘরের ভিতরেই তো আছে ! আর রান্ধনঘরও তো এই চক্ষের সামোনেই। এইনে ডরের কী আছে!
ডরের কিছু নাই! ইমাম হুজুরে আওনের আগে আগে দুধটুক জ্বাল দিয়া ফালাইলে হাত তার আজাইর থাকে। শান্তিহালে হুজুরের লগে খতমের কথাখান কওন যায় তাইলে! বেহুঁশ মাইয়ারে একলা থুইয়া সেয় তরাতরি যায় দুধ জ্বাল দিতে।
দুধ জ্বাল দিয়া জুলেখার মায়ে রান্ধন ঘর তেনে খালি বাইর হইছে, অমনেই সেয় দেখে ইমাম হুজুরে আইয়া উঠানে খাড়া। তার পিছে খাড়া মংলার মায়ে।
'কি গো? কি গো জুলেখার মা? আপনে যে রান্ধন ঘরে! জুলেখার লগে কারে থুইয়া আইছেন? হেরে না একলা থুইতে নিষেধ দিছি আমি!' হুজুরে কড়া একখান খেইক্কানি দিতে দিতে জুলেখা গো বড় ঘরের দিকে যাওয়া ধরে। তার লগে লগে মংলার মায়ও তরাতরি কইরা ছুট দেয়। তাগো পিছে পিছে আগানি দেয় জুলেখার মায়।
ঘরে ঢোকতে গেলে পইল্লাই চক্ষে পড়ে জুলেখার শিথানের দিকখান। শিথানে দেওয়ার বালিশ পাটিতে পইড়া রইছে বেঁকা- তেছরা হইয়া । সেই বালিশে জুলেখার হুঁশ-ছাড়া মাথাটা দেখি নেতাইয়া পইড়া নাই!
নাই ক্যান!
কী হইলো! কী হইলো ! তাগো তিনোজোনের কইলজা ধক কইরা ওঠে। জুলেখায় নাই ক্যান পাটিতে! হায় হায় ! এইটা কেমুন সর্বনাইশ্যা কথা! জুলেখায় কই!
তারা তিন জোনে ঠকঠকাইতে ঠকঠকাইতেই ভালা কইরা চাইয়া দেখে, দেখো কী আচানকের বিত্তান্ত! জুলেখায় সুন্দর উইট্টা বইয়া রইছে! পুরা জাগনা পাওয়া, পুরা হুঁশ-অলা জুলেখায় চাইয়া চাইয়া তাগো দেখতাছে দেহি!
কেমনে জাগনা পাইছে মাইয়ায়! কেমনে!
(চলবে)