গল্প পড়ার গল্প

যত্ন নিয়ে লিখতেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

Looks like you've blocked notifications!

দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন খবার্কৃতির মানুষ।  কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বে ও  লেখায় ছিলেন দীর্ঘ এক পুরুষ।  আরম্ভের  দিনে আমি এই মানুষটির সাহচর্য, পরামর্শ পেয়েছিলাম। অবশ্য সে খুব সামান্য দিন। ১৯৭৯-তে দীপেন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণ ঘটে। দীপেন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই নামি লেখক। তাঁর কাছে আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনেছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর কথা শুনেছি। সেই মৃত্যু নিয়ে তাঁর একটি অসামান্য প্রতিবেদন ছিল। আমি যখন তাঁকে দেখেছি, তিনি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক। এবং গল্প লেখক হিসেবে সম্মাননীয়। আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ দুপুর কাটিয়েছি পরিচয় দপ্তরে। আমি কপি ধরেছি, তিনি প্রুফ দেখছেন পত্রিকার। তার ভিতরেই মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর, সতীনাথ নিয়ে কথা বলছেন। কথা বলছেন বড়ে গোলাম আলী নিয়ে। খুব শান্ত স্বর। দীপেন্দ্রনাথ এক গল্প দুবার লেখেননি। অশ্বমেধের ঘোড়া আর নরকের প্রহরী মেলান যায় না। আবার নরকের প্রহরীর সঙ্গে মেলান যায় না পরিপ্রেক্ষিত বা শোকমিছিল। 

গল্পে ছিল তাঁর খুব যত্ন। প্রতিটি শব্দ, বাক্য যেন গুরুত্বপূর্ণ  হয়ে ওঠে তাঁর গল্পে। অশ্বমেধের ঘোড়া গল্পটি প্রেমের। পরিপ্রেক্ষিতও তাই। কিন্তু দুই গল্পে কত দূরত্ব। আমি তাঁর সেই আশ্চর্য গল্প অশ্বমেধের ঘোড়ার কথাই বলি। এই গল্প লেখা হয়েছিল আজ থেকে চৌষট্টি বছর আগে। অবাক লাগে এখনো এই গল্প অনুভূতির আলোয়  কী আশ্চর্য ছায়াই না ফেলে রেখেছে  বহু জায়গায়। কী অপূর্ব এর বুনোট। রেখা আর কাঞ্চন রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছে, কিন্তু সংসার পাততে পারেনি তারা। কাঞ্চন একটি কলেজের শিক্ষক। রেখাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর মযার্দা দেওয়ার সাধ্যই তার নেই।  কাঞ্চনের বাবার জাতের অভিমান। তারা কখনোই কাছাকাছি হতে পারে না এই শহরে। গঙ্গার ধারে বাবুঘাটে আসে গল্প করতে। সেখানেও রেহাই নেই। কাঞ্চনের সহকর্মী সুবিমল এসে বিরক্ত করে। সে তো জানে না তারা বিবাহিত দম্পতি। তাদের বিবাহের বর্ষপূর্তির দিনে তারা এসেছিল বাবুঘাটে। সেখানে একটি ফিটন গাড়ি দেখে ইচ্ছে হয় গঙ্গার ধার ধরে তারা ফিটন ভ্রমণে যায়। খিদিরপুর অবধি। রোগা একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ভাড়া ঠিক হয় দরাদরির পর আড়াই টাকা। 

সেই ফিটনের গাড়ি যেন অশ্বমেধের সেই ঘোড়া যার সন্ধানে ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গা এনেছিল। দীপেন্দ্রনাথের লেখার গুণে এই গল্প বহুমাত্রায় পৌঁছে যায় বারংবার। দীপেন্দ্রনাথ প্রেমের মুহূর্তগুলোকে বর্ণনা করেন অনুপম গদ্য আর চিত্রময়তায়। সেই যে তারা তখন ফিটনে, জানালা খোলা, বাইরে বৃষ্টি নামল। সারেঙ্গিতে গাঢ় পুরুষালি ছড়ের টানে চন্দ্রকোশ বেজে উঠল। রাধার চোখ, রাধার আঙুলে মিনতি! সঈ, কে না বাঁশি বাএ কালিনী নঈ কূলে। কড়ি মধ্যম সমুদ্র স্তম্ভের মতো কোমল ধৈবতে ভেঙে পড়ে কোমল গান্ধার ছুঁয়ে ষড়জে ফিরে এলো। আর বৃষ্টি দ্রুত হলো। চাকার শব্দ,ক্ষুরের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ...। 

তখন বৃষ্টির ছাঁট থেকে তাদের বাঁচাতে সহিস পর্দা ফেলে দেয়। দুই পাশে দুটি চামড়ার পর্দা ঝুলে পড়ায় তারা সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুজনে অন্ধকারে বসে থাকে। এই শহরে তাদের জন্য কোনো নির্জনতা নেই। নতুন এই অপরিসীম নির্জনতার ভিতর প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিনে কাঞ্চন ডাকে রেখাকে, ‘বউ’ বলে। রেখা অনেক অনুনয়ে ‘স্বামীন’ বলে উত্তর করে দুহাতে মুখ ঢেকে ঝিরঝির করে হেসে ওঠে। কী অপূর্ব প্রেমের মুহূর্ত রচিত হয় দুজনের ভিতর!  কী আশ্চর্য ভালোলাগা। কাঞ্চন চোখ বন্ধ করে অশ্বের হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি শুনতে লাগল।  তখন গাড়ির ভিতরে নিজের সঙ্গে করে আনা মালাটা কাঞ্চনের হাতে পরতে চায় রেখা। গাড়ি থেমে যায়। সহিস তাদের ডাক দেয়। খিদিরপুর এসে গেছে। রেখার  সেই মালা পরা হয় না। নেমে আড়াই টাকা ভাড়া শোধ করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয় কাঞ্চন। সহিস দাবি করে পাঁচ টাকা। বলে ওঠে, ফুর্তি করবেন, হোটেল ভাড়া ভি দিবেন না ? কাঞ্চনের হাতে ছিল রেখাকে পরিয়ে দেওয়ার মালাটি। দুহাতে কান চাপতে গিয়ে তা  ধুলোয় পড়ে যায়। এই নিদারুণ অপমানের ভিতরে তখনই যেন অশ্বমেধের ঘোড়ার শোনিতে যজ্ঞের আহুতি পূর্ণ হয়। 

এই গল্প দীপেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে সময়ে তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সম্পূর্ণতাকে বারবার স্পর্শ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পড়ছে। যতবার পড়ি মুগ্ধ হই।  দীপেন্দ্রনাথের আর এক গল্প ‘ঘাম’-এর কথা বলি। এই গল্প লিখে তিনি তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে নিন্দিত হয়েছিলেন যে সেই কাহিনী শুনেছি। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত এই গল্প হ্যাপিভ্যালি রেস্তোরাঁর বেয়ারা বিষ্টুচরণের। রেস্তোরাঁটি পার্ক স্ট্রিটে। সেখানে ইউনিফর্ম পরিহিত বিষ্টুচরণ টেবিলে টেবিলে ঘোরে খদ্দের সামলাত। খদ্দের নারী পুরুষ পয়সা দিয়ে গান শোনে। রাত ১২টায় শেষ খদ্দেরটি চলে গেলে ঝাড়পোঁছ করে বিষ্টুচরণ বেরোতে পারে। বাইরে বেরিয়েই গরম বাতাসের হল্কা টের পায়। সেকেন্ড ক্লাস ট্রামের ফাঁকা বেঞ্চিতে সে নিজেকে জুড়ায় বাইরের হাওয়ায়। অত রাতে বস্তিতে এলোকেশীর কাছে ফিরে বিষ্টুচরণের বিচিত্র ঘর-গেরস্তি আরম্ভ হয়। এলোকেশী সাতবাড়ি খেটে বেড়ায়। এলোকেশী তার বউ নয়, কিন্তু দুজনে পরস্পরকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। দীপেন্দ্রনাথ এক ঘর্মাক্ত রাতের কথা লিখেছেন এই গল্পে। অত রাত। বিষ্টুচরণ একা বিছানায় শুয়ে, এলোকেশী তার কাজ সারছে। বিষ্টুচরণ জানে তার মতো কপালফাটা কেউ নেই। সারাদিন হ্যাপিভ্যালিতে দু-পায়ে খাড়া থেকে সবার ফুর্তির সাক্ষী থাকতে হয়। কিন্তু নিজের শুধু খাটনিই সার। তার নিজের আরাম কই? এলোকেশী সেই দমবন্ধ রাতে নিজের কাজ শেষ করে বিছানায় আসে। বন্ধ ঘর। গুমোট গরম। এলোকেশী তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ছটফট করে সে। এলোকেশীর শরীরের ঝাঁঝালো গন্ধ, ঘামের গন্ধ তাকে টানছে বটে, কিন্তু নিজের কপালের জন্য একটা রাগ আছে তার নিজের ওপর। সে নিজের ঘামঝরা মুখটি এলোকেশীর ভেজা পিঠের ওপর ঘষতে ঘষতেও টের পায় কিসের যেন অভাব। আরো কিছু চাইছে সে।  

দীপেন্দ্রনাথ এই গল্প এমন ভাবে এঁকেছেন যে সেই রাতের ঘাম লালায় পাঠক ক্রমশ আক্রান্ত হতে থাকে। গভীর রাতের বস্তি, তার হল্লা, খঞ্জনি, গান, কান্না সব ঘিরে আছে বিষ্টুচরণ ও এলোকেশীকে। নোংরা মশারির ভিতরে দুজন। মশা পিনপিন করছে পুরুষটির কানের কাছে। এলোকেশী বসে অন্ধকারে মশা মারে। হ্যারিকেনের আলো তাকের ওপর রাখতে বেরিয়ে আবার মশারি গলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। কী বিচিত্র এক ভালোবাসার গল্প এই ঘাম। আসলে শ্রম-ঘামের সঙ্গে তাদের বেঁচে থাকা একাকার হয়ে গেছে। সেই ছাপ্পান্ন বছর আগে লেখা এই গল্পে দীপেন্দ্রনাথের যে সাহসী বিচরণ তা সেই সময়ে গেল গেল রব তুলেছিল রক্ষণশীল কমিউনিস্ট পার্টিতে। অথচ গল্প তো রক্ত-মাংসের মানুষের। দীপেন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে হারাবেন না কোনোদিন।