অগ্রন্থিত ছফা
শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য প্রসঙ্গে
ভূমিকা : সলিমুল্লাহ খান
শুনিতেছি—আমি লিখিতেছি ২০১৫ ইংরেজির মধ্যস্থলে—যে দেশে আমরা বাস করি হালে সেই দেশের গড়পড়তা আয়-উপার্জন বাড়িয়া গিয়াছে। দেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ভুক্ত দেশের তালিকায় উঠিয়াছে। হইতে পারে তাহার জায়গা তালিকার নিচের ঘরে। এই আয়বৃদ্ধির প্রধান কারক শ্রমিক শ্রেণী। তাহাদের গড়পড়তা আয় কত বাড়িয়াছে? যাহারা দেশে কাজ করিতেছেন তাহাদের এবং যাহারা দেশের বাহিরে কাজ করিয়া আত্মীয়-পরিজন পুষিতেছেন তাহাদের? কিন্তু মানুষ কেবল ভাত খাইয়া বাঁচিবে না। তাহার সাহিত্যও লাগিবে।
আশ্চর্য শুনাইতে পারে, এই শ্রমিকের দেশে শ্রমিক শ্রেণীর কোন সাহিত্য নাই। কথাটি আমার নয়। আজ হইতে ৩২ বছর আগে আমাদের দেশের সত্যদ্রষ্টা লেখক মহান আহমদ ছফা এই কথাটি উচ্চারণ করিয়াছিলেন। আমাদের দেশের লেখকেরা—অন্তত তাহাদের বেশির ভাগ—সামান্য অর্থে পাতিবুর্জোয়া বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ বলিতে যাহা বুঝায় শ্রেণী হিশাবে লেখকেরা বহু আগেই সেখানে পৌঁছিয়াছেন।
আজ কি সেই অবস্থায় কোন বড় মাপের ব্যয় বা পরিবর্তন হইয়াছে? দুঃখের মধ্যে বলিতে হইবে, হয় নাই। সেই কারণেও আহমদ ছফার এই লেখাটি আমাদের পাঠ্য-তালিকায় উঠিবার যোগ্য। আহমদ ছফা সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় এই লেখাটি ছাপা হইয়াছিল ইংরেজি ১৯৮৩ সালের ২৯ এপ্রিল। তরুণ গবেষক প্রিয়ম পাল ও তাঁহার সঙ্গীরা এই লেখাটি পত্রিকার ফাইল হইতে উদ্ধার করিয়াছেন।
এমন একটি তাজা লেখা আজও এদেশে খুব কম লেখকের পক্ষেই লেখা সম্ভব। আহমদ ছফার তুলনা দিবার মতন একজন লেখক সেদিনও খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন ছিল। আজও কাজটি সহজ নয়। খোদ লেখক শ্রেণীর [বা শ্রেণী ছিলকার] চরিত্র বিশ্লেষণ না করিয়া কোন লেখার বিচার করা সহজ নয়। আহমদ ছফার লেখায় এই বিচারের সূত্রপাত ঘটিয়াছিল। তিনি কাহাকেও ছাড়িয়া কথা বলেন নাই। তাঁহার অঙ্গীকার ছিল শ্রমিক শ্রেণীর সহিত। তিনি ছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্যিক। বিপ্লবী হওয়া ছাড়া তাঁহার অন্য বিকল্প ছিল না। তিনি কায়ায়, মনে, ও বাক্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সৈনিক ছিলেন। তাহার লেখা সেই বৃত্তির উর্দিবিশেষ।
২০০১ সালে নশ্বর আহমদ ছফার মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু অবিনশ্বর আহমদ ছফার মৃত্যু নাই। ‘শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য প্রসঙ্গে’ তাহার সাক্ষী। এই লেখায় বিপ্লবের জ্ঞান যেমন পাই, তেমনই পাই বিপ্লবী আবেগ। এই জ্ঞান ও এই আবেগ আজ কোথায় আর পাইব?
প্রাণের তীব্র তাগিদ, গভীর ভালোবাসা এবং শেষ পর্যন্ত সর্বপ্রকার শ্রমের সৃজনীক্ষমতার প্রতি অবিচল আস্থা না থাকলে কেউ শ্রমিক শ্রেণীর লেখক হতে পারেন না। এ সবই যথেষ্ট নয়, আরও একটি জিনিশ অবশ্যই থাকতে হবে। সেটি হলো প্রখর ঘ্রাণশক্তি। যে লেখা ঘ্রাণ দিয়ে শ্রমিককে আকৃষ্ট করতে পারবে না তা কখনও শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য হতে পারে না। এই ঘ্রাণশক্তি সেই বস্তু যার বলে পুত্র মাকে রাতের অন্ধকারেও অতি সহজে চিনে নিতে পারে।
পড়াশুনা করে, চলমান ইতিহাসের গতিধারা অবলোকন করে, শ্রমিক জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরাখবর সংগ্রহ করে একটা আরোপিত কর্তব্যবোধের তাগিদে কেউ কেউ শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য রচনায় এগিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু এ সকল লেখকের রচনায় সে ঘ্রাণক্ষমতা কদাচিৎ জন্মায়। শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার সরল প্রস্তুতি থাকলেই [কেবল] লেখকের চেতনায় ফুলের সুবাসের মতো বিপ্লবের ঘ্রাণশক্তি সঞ্চারিত হতে পারে। এটা সেই শক্তি যা শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের সাহিত্যে শ্রমিক-কৃষক-কর্মজীবী মানুষের সাহিত্য একেবারে নেই বললে অবিচার করা হবে। কিন্তু দুয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ লেখকের নাম বাদ দিলে আমাদের দেশের প্রায় সকল প্রধান কবি-সাহিত্যিকের বেলাতেই এ ঘ্রাণশক্তি অনুপস্থিত বললে খুব বেশি অত্যুক্তি করা হবে না। আমাদের সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণীটির অস্তিত্ব না থাকার দরুণ লেখকদের রচনায় বুর্জোয়া [জীবনের] প্রসারতা এবং জীবন অভীপ্সা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা। তাই এখানকার লেখকদের প্রায় সকলেই পাতিবুর্জোয়া। পাতিবুর্জোয়াসুলভ দোলাচলবৃত্তি এবং অন্যান্য চারিত্র-লক্ষণ এঁদের রচনায় অত্যন্ত প্রকট। সমাজে যখন একটা আন্দোলনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এঁদের বেশির ভাগই তখন দল বেঁধে, মিটিং করে, ইউনিয়ন গড়ে কাগজে বিবৃতি দিয়ে সদলবলে বিপ্লবী সেজে যান। আবার অন্যসময় প্লেনে চড়ে লন্ডন-নিউ ইয়র্ক যাবার বাসনা পোষণ করেন। লন্ডন-নিউ ইয়র্কে যাবার বাধা থাকলে মস্কো বা পিকিং চলে যান। আমাদের দেশের পাতিবুর্জোয়াদের শ্রেণীসীমা অতিক্রমণ ঘটে এই পদ্ধতিতে।
এরা কখনো কখনো শখ করে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য গল্প-কবিতা ইত্যাদি লিখে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্যানপ্যানানির স্তর অতিক্রম করে সেগুলো মেহনতি জনগণের কঠিন করুণ বাস্তবতার পাশও ঘেঁষে না। এই শ্রেণীর লেখকদের আনুগত্য আসলে নিজেদের শ্রেণীটির প্রতি। আপন বিষয় অতিক্রম করে তাঁরা কোথাও যান না। রক্ত, ঘাম এবং শ্রমের হুঙ্কার নিয়ে যখন প্রবল প্রাণাবেগে কোনো নবীন কণ্ঠ অস্তিত্ব ঘোষণা করতে চেষ্টা করে [তখন] তারা কঠিন উপেক্ষা অথবা নিরব ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তার সৃষ্টিশীলতা সমূলে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
যেহেতু এই পাতিবুর্জোয়াদের কোনো সামাজিক অঙ্গীকার নেই তাই তারা অঙ্গীকারের সাহিত্যও রচনা করতে পারে না। খুঁটিতে বাঁধা পশুর মতো আপন শ্রেণী অস্তিত্বের চারপাশে ঘুরপাক খাওয়াই এদের প্রিয় স্বভাব। কোন সামাজিক ঝড়ে যখন সমগ্র পাতিবুর্জোয়া অস্তিত্বটি থরহরি কম্পমান হয়ে ওঠে তখনই তারা সমস্বরে জয়ধ্বনি দিয়ে পাইকারী বিপ্লবী সেজে যায়। তাছাড়া এদেশের তথাকথিত বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কতিপয় পোষা লেখক-সাহিত্যিক আছেন। আপনাপন দলের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা ঢেকে রাখার জন্য ভাষা-ছন্দের আলোয়ান বানানোই হলো তাঁদের কাজ।
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রেই এই পাতিবুর্জোয়াদের অখণ্ড এবং একচ্ছত্র প্রতিপত্তি। তাদের ঘোষিত বিশ্বাস যাই হোক না কেন স্বার্থসূত্রে সকলেই একই পাটাতনের বাসিন্দা। কেউ কাউকে বেশি ঘাটায় না। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে অলিখিত একটা ভদ্রলোকী চুক্তি রয়েছে। রেডিও-টেলিভিশন, সরকারী-আধা সরকারী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসমূহ ছাপাখানা এবং প্রকাশনা সবটাই তাদের দখলে। এটা এমন একটা জাল যে এক জায়গায় হাত পড়লে সমস্তটা নড়ে ওঠে এবং সবাই নতুনের জন্ম রোধ করার জন্য সচেতন এবং সতর্ক হয়ে ওঠে।
সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য এই গোটা প্রেক্ষাপটটার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। যে সকল নকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল জনগণের কথা বলে কাজের ক্ষেত্রে জনগণের সাংস্কৃতিক উত্থানের বিরোধিতা করে প্রয়োজন হলে [তাদের] চ্যালেঞ্জ করতে হবে। জনগণের রাজনীতির একটা বুনিয়াদ বা ভিত্তিভূমির অন্তত কল্পচিত্র খাড়া করাও তাদের কর্তব্যের আওতার বাইরে নয়। তাছাড়াও শ্রমিক শ্রেণীর সাহিত্য রচনার জন্য আরো দুটি জিনিশ অত্যন্ত প্রয়োজন। একটা হলো বিপ্লব সম্পর্কিত জ্ঞান, অন্যটা বিপ্লবী আবেগ। শ্রেণী হিশেবে পাতিবুর্জোয়ারা দুটোর কোনটারই অধিকারী নয়।
(আহমদ ছফার এই অগ্রন্থিত রচনাটি প্রথম ২৯ এপ্রিল ১৯৮৩ সালে ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়। বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)