সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
আবার নয়া কইরা শোধন-গোছল দিয়া জুলেখারে দোপোরের খাওন খাইতে বহায় মায়ে। রান্ধন ঘরের মাইজ্জালে পিঁড়ি পাততে পাততে খোনে খোনে মায়ের দুই চউখ পানিতে টুবটুবা হইয়া যাইতে থাকে!
হায় রে! সেই একদিন গেছে! আর এই একদিন!
মাঝখানে দেখো কেমনে কেমনে গেছে গা পাঁচ-পাঁচটা বচ্ছর!
পাঁচ বচ্ছর আগে এমুনই তো চৈত মাইস্যা দিন আছিলো সেইটা!
আছিলো না এমুন দোপোরের কাল! দোপোরের ভাত খাইবো বইল্লা মাইয়ারে পাঠাইছিলো না তার মায়ে গোছল করতে! সেই মাইয়া! আস্বপনের স্বপন! কাঙালের শেষ কড়ি! সেই মাইয়া!
মাও-বাপের না-বুঝ মাইয়াটা! আল্লায় তারে শেষ কাটালে ফিরাইয়া দিছে। শুক্কুর আল্লার দরবারে!
কিন্তু আউজকার দিনে কইলজার টুকরা মাইয়ারে আহ্লাদ করোনের বাপে কই! বাপে দুনিয়ায় নাই। সেয় তো গেছে। লগে কইরা সংসারের সুখেরেও লইয়া গেছে।
মায়ে যে মাইয়ারে যতন দিয়া ঢাইক্কা থুইবো, বিধবা মায়ে টেকার সেই জোরই বা পাইবো কোনখানে! কোনোমতে না মায়ে দুগা খুদ-কুঁড়া জোগাড় কইরা-জোড়াতালি দিয়া না নিজ দেহখান জিয়াইয়া থুইছে!
আবাগী মাওয়ে কী দিয়া মাইয়ারে খুশি করবো! সম্বল বলতে আছে কী তার! এট্টু ভালা-বুরা কিছু যে রান্ধবো মাইয়াটার লেইগা, জিনিস জোগাড়ের সেই খ্যামতা আর কী মায়ের আছে! কড়ির সম্বল বলতে অখন কী আছে! কিচ্ছু নাই!
আউজকাও মায়ে রান্ধাইছে গিমা শাক। সেই পাঁচ বচ্ছর আগেকার চৈত মাইস্যা দোপোরে যেমুন মাইয়ার লেইগা রান্ধছিলো জুলেখার মায়!
পাঁচ বচ্ছর আগের সেই দিনের মতোনই অনেক বেশি কইরা রসুন আর হুগনা মরিচ দিয়া বাগার দেওয়া হইছে গিমা শাকেরে। বাগারের পর বড়ো ভালা গন্ধ দিতাছে! বোঝা যাইতাছে শাক রান্ধোনটা ভালা হইছে! অখন আলা মাইয়ার মোখে মজা লাগলেই অয়!
আর আছে সেই চাপিলা মাছের চুকা! যেই চুকা খাওনের লেইগা উতলা আছিলো জুলি পাঁচ বচ্ছর আগের দিনখানে! আউজকাও তেমুন চুকাও রান্ধাইছে জুলেখার মায়।
সেই যে গোছল কইরা আইয়া গরম ভাতে চুকার সান দিয়া খাইবো কইছিলো মাইয়ায়; সেই খাওন মোখে তোলোনের কিসমত তো তারে দেয় নাই খোদায়!
তার বাদে আর নি মায়ে কোনোদিন একবারের লেইগা, ভুল কইরা হইলেও কোনোসোম, অই চুকা মোখে তোলছে! মোখে দেওয়া দূর, কোনোদিন রান্ধেও তো নাই! আউজকা ঘরের মাইয়া ঘরে আছে। ফিরা আইছে সেয়! আউজকা মাইয়ার পছন্দের সেই খাওন কি মায়ে না রাইন্ধা পারে!
তয় আউজকা জুলেখার মায়ে এই রান্ধা-বাড়ির কামে হাত দিতে পারে নাই। মাইয়ার চেতন আইছে একদিগে, আরেকদিগে তার মায়রে নয়া কইরা নামতে হইছে মাইয়ার শোধন কর্মে। সেই শোধন কি ছুতানাতা কারবার! একটার পর একটা—দুনিয়ার কাম!
তহন কী থুইয়া কী করে জুলেখার মায়! কোনদিগ থুইয়া কোনদিগে যায় সেয়! রান্ধন দেখতে গেলে মাইয়ার শোধনের কাম পইড়া থাকে। আবার শোধন লইয়া পইড়া থাকলে মাইয়ার দোপোরের খাওনের কী উপায় হয়!
সেই মুশকিলের আসান দিতে কে আর আউগ্গায়! আউগ্গায় মংলার মায়!
মংলার মায়ের রান্ধন নিয়া জুলেখার মায়ের পরান পরথমে এট্টু খুচখুচাইলেও, অল্প পরেই সেই খুচখুচানি নাই হইয়া যায়। অই মাতারি রান্ধনের হাত যাহা-তাহা হাত না! তার রান্ধন নিয়া তার দুশমনে ইস্তক কোনো বেঁকা কথা কওনের ফাঁক পায় নাই কোনোদিন! কেউই সেই রান্ধনরে কোনো পিক দিতে পারে নাই জিন্দিগীতে!
শাক চুকা ভর্তা—যা রান্ধুক সেয়, জব্বোর সোয়াদের হয়! তাইলে আউজকা জুলেখার মায়ের ডর কিয়ের! মংলার মায়ের রান্ধা খাইতে জুলেখার তো কোনোই বেমজা লাগবো না!
তয় জলদি জলদি জুলেখারে খাওয়াইয়া আজাইর হইয়া থাকতে কইয়া গেছে ইমাম হুজুরে। সেয় জহুরের নমাজের কাম-কাইজ শেষ কইরাই আইয়া পড়বো। আইয়া বোলে জুলেখারে লইয়া বহোন লাগবো তার। ভাইঙ্গা-চুইরা আতিপাতি কইরা বোলে তারে হোনোন লাগবো সগল কথা।
কোন কথা ইতি-বিতি খোলাসা কইরা হোনন লাগবো হুজুরের!
এই যেমুন, কই গেছিলো গা জুলেখায়! কই আছিলো! কেমনে আছিলো, আবার কেমনে আইলো নিজেগো গেরামের সীমানায়! সেয় আইলোই যুদি, তয় ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় আইয়া বইয়া রইছিলো ক্যান! বাইত আইতে কী দোষ আছিলো!
জুলেখার মায়ে দুই হাত বাইন্ধা কতো মিন্নতি দিলো হুজুররে। কতো না বুঝ মানাইতে চেষ্টা করলো সেয়! কতো প্রকারে না কইলো যে, যা হইছে হইছে! যা গেছে গেছে। অখন আর ওই বিষয়রে ঘুটুনি দেওনের কাম নাই! হুজুরে তো না-বুঝ কেউ না! সেয় গেরামের সগলতের তেনে বুঝদার। মাইয়ায় তার ফিরত আইছে, এইটার তেনে বড় আর কিছু নাই জুলেখার মায়ের কাছে!
আর কিছু হোনোনের কোনো খায়েশ নাই তার। হুজুরে আলা খ্যামা দেউক। থাকুক মায়ের কোলের ধন মায়ের কোলে! শান্তি হালে থাকুক আলা তারা মায়ে-ঝিয়ে! অতো কিছু হুইন্না কোন ফল ফলবো!
কিন্তু হুজুরে জুলেখার মায়ের কোনো একটা কথা যুদি কানে নিতো! এট্টু যুদি গেরাজ্জি করত জুলেখার মায়ের মিন্নতি! হের সেই এক কতা।
জুলেখার হারানী বিষয়ের সগল বিত্তান্ত আতিপাতি কইরা না হোনোনের ফল ভালা হইবো না! জুলেখার ভালাইয়ের লেইগাই সগল কিছু ভালারকমে জানোন লাগবো! নাইলে নয়া কইরা বিপদ-বালাই আইতে পারে! হেইটা ঠেকাইবো কেটায়!
আর বিপদ-বালাই! আর কোন বালাইয়ের আহোন বাদ রইছে! আর কোন গরদিশ আইবো! কোনটা আহোনের বাকি? কোনটা!
মায়ে ছিঁড়া আঞ্চল দিয়া চক্ষের পানি পোছতে পোছতে মাইয়ার লেইগা পাতিলেম্বু কাটে। উয়ে না গিমা শাগের লগে লেম্বু খাইতে চাইতো, একেবারে ছোটোকাল তেনে!
পাতে বইয়া জুলেখায় দেহো কিমুন ঠ্যাটা কারবার করতে থাকে! অর সামোনে অর মায় বহা। সেয় তার মাইয়ার পাতে খাওন-তরকারি। সেয়ও আজাইর হাতে বহা না!
সেয় তাল-পাঙ্খা দিয়া খোনে খোনে হপ্পায় চেতন পাওয়া মাইয়াটারে বাতাস দিয়া যাইতাছে। বাতাস সেয় ধুইচ্চা দিতাছে না। দিতাছে এট্টু পরপর। দিতাছে রইয়া-সইয়া। ধুইচ্চা বাতাস করতে থাকলে মাইয়ার যুদি আবার দোম-ফাঁপোর লাগে! তাইলে তো আবার বিপদ! মাইয়ার অসুইক্ষা শইল না!
সামোনে-পিছোনে বহা দোনো মাতারিই দেহে, জুলেখায় সানকির ভাত খালি লাড়ে-চাড়ে; খালি লাড়ে-চাড়ে। মোখে আর দেয় না! এক নলা ভাতও তারে মোখে তোলতে দেখা যায় না!
অর ভাত লইয়া লাড়া-চাড়ির ভাব দেইক্ষা পষ্ট মোনে হইতে থাকে যে,খাওন মোখে দিতে য্যান জুলেখার ডর করতাছে!
‘কী মা! জুলি! খাওন মোখে দিতাছো না ক্যান গো মা, তুমি?’ জুলেখার মায় হরদিশা পরানে মাইয়ারে জিগায়।
হায় রে হায়! ভিতরে ভিতরে তার মোন যেইটা নিয়া হেই কুনসুম তেনে কু গাইয়া যাইতাছিলো, হেইটাই দেহি হাছা হইয়া গেছে!
জুলেখার মায়ের খালি মোনে অইতাছিলো যে, তার মাইয়ায় নি আবার বেজার হয় খাওনের এই গরিবী হাল দেইখ্যা! এই এত্তাদিন পরে বাইত আইয়া যুদি অর মোনে দুক্ষু ওঠে যে, মায়ে এমুন শাক-পাতা হাবিজাবি রান্ধলো! আর কিছু জোটলো না পাতে দেওনের লেইগা!
দেহো! যেই ডর করতাছিলো মায়ে, হেইটাই তো হাছা হইয়া গেলো! মাইয়ায় যে খাওন মোখে নিতাছে না! অহন উপায় কী! না-বুঝ মাইয়ারে অহন কী দিয়া ঠান্ডা করে দুক্ষিনী মায়!
‘মাগো! খাওন লইয়া এমুন ফেলা-ছড়া করোন নাই, মা!’ মায় কয়। ‘অহন এই আবি-জাবিটুক দিয়াই খাও মা!’ মায়ে মাইয়ারে তোষামোদ করতে থাকে। ‘রাইতে দুধ দিয়া ভাত খাইও নে। মিঠাই আছে ঘরে। আউজকার দিনটা কষ্ট করো এট্টু, ধন! কাউলকা তোমারে মলুন্দি মাছের চরচরি রাইন্দা দিমু নে মায়! কাউলকার তেনে আর খাওনের কষ্ট অইবো না গো মা, তোমার!’ মায়ে মাইয়ার ডাইন হাতখান নিছে-পোছে আর ঘুইস্সা ঘুইস্সা কান্দে।
‘দুই-চাইর নলা মোখে দেন মা!’ পিছে বইয়া বেজার মোখে জুলেখারে বাতাস করতে করতে খোসামোদ করে মংলার মায়েও, ‘আপনে না খাইলে আপনের মায়েও তো দাঁতে কুটাটা কাটবো না গো সোনা!’
এতো যে খোসামোদ, এতো যে মিন্নতি করা হইতাছে জুলেখারে; তার কিছুই য্যান অর কানে যাইতাছে না লাগে! সেয় থালের ভাত যেমুন লাড়তাছিলো ঘাটতাছিলো, তেমুনই কইরা যাইতে থাকে। একটা লোকমাও মোখে দেয় না। তোলেই না।
জুলেখার মায়ে আর মংলার মায় বইয়া বইয়া টাসকি খাওয়া চউখ দিয়া সেই বিত্তান্ত দেখতে থাকে। এইটা কী বেপার! এইটা কী করতাছে উয়ে! খাওন লইয়া এমুন বেত্তমিজি তো উয়ে আগে কোনোসোম করে নাই!
কোনোকালেও করে নাই। অখন করতাছে যে! ক্যান করতাছে! এইটা কোন জুলেখায়! ময়-মুরুব্বির কথা কানে নেয় না ! আদব-লেহাজ সব ধুইয়া খাইছে মাইয়ায়! এমুন তো আছিলো না উয়ে! আগে তো এমুন আছিলো না!
মুরুব্বি দুইজোনে ভিতরে ভিতরে এমুন আফসোস নিয়া নিজেগো কপালে মারতে থাকে। হায় হায় করতে থাকে। কিন্তুক মোখে জুলেখারে কিছু কওনের শক্তিটা অয় না তাগো।
কতোক্ষণ খাওন লইয়া জুলেখার কিরতিখান চাইয়া চাইয়া দেখে তার মায়। কতোক্ষণ সেয় চুপ্পে চাপ্পে নিজের কপালে মাইরা, তার বাদে আবার খোসামোদ করা ধরে মাইয়ারে। ‘মাগো! কী করতাছো এইটা! পাতের ভাত লইয়া এমুন হেলা করলে, খোদাতালায় মাইনষের কিসমত কাইট্টা নেয় গা মা! দুগা ভাত মোখে নেও!’
‘গেলো পাঁচ বচ্ছর আমারে একটা ভাতের দানাও মোখে তোলতে দেয় নাই মা, আপনেগো জামাইয়ে!’ এই এতখোনে মায়ের দিগে বেদিশা চক্ষে চাইয়া কান্দা শুরু করে জুলেখায়, ‘হেগো দেশে ভাত খায় না কেউঅই মা!’
কী! কী কয় এইটা মাইয়ায়! জামাই! জামাই আইলো কইত্তেনে! হারানী যাওনের আগে জুলেখারে তো অর মা-বাপে বিয়া দিয়া সারতে পারে নাই! জুলেখায় তাইলে এটি কী কইতাছে!
‘আমারে হেয় শরিয়ত মাইন্নাই বিয়া করছে মা। আমারে হেয় নিয়াই আগে বিয়া করছে। তার বাদে সংসার শুরু করছে হেয় আমার লগে! আপনেরে দুইটা জমক নাতি-নাতকুঁড়ও দিছে গো মা, খোদাতাল্লায়! জমক দুইজোন।’
কে! কে বিয়া করছে তার জুলেখারে! মায়ের পরান ডরে-ভাবনায় আঁতকা ধগবগাইতে থাকে। কোন দেশি পোলা! কেমুন বংশের পোলা এইটা! কেমুন ঘরের পোলা যে, সেয় একবার আইয়া জুলেখার বাপ-মায়ের লগে চক্ষের দেহাটা তরি কইরা যায় নাই!
কেমুন মা-বাপের পোলা অইটা! আর কেমুনই বা তার মায়-বাপে! নাদানের নাদান! আমাইনষের ছাওয়েরা! তাগো ভিতরে এই দানাইটুক তরি নাই যে, মাইয়ার মাও-বাপেরে একটা খবর দেওন লাগে! বাপ-মায়রে মাইয়াটার একটা খবর ইস্তক দেওনের গরজো নাই যাগো ভিতরে, হেরা কেমুন মানুষ ! কেমুন মানুষ এগিলি!
দুক্ষে-জ্বালায় জুলেখার মায়ের ভিতরে কিমুন বলক যে ওঠতে থাকে! সীমাছাড়া চেত তার ভিতরে বলকাইয়া যাইতেই থাকে।
‘মা! ও মা! হোনো! আমি কী কই হেইটা হোনো! যাগো দেশে আমি সংসার করছি; হেরা কইলাম মানুষ না! হেরা মানুষ না! হেরা জানি কারা!’ জুলেখায় তার মায়েরে অই কথাখান কইয়াও সারে না, মংলার মায়ের পুরা শইল্লে মাঘ মাইস্যা হিম ঠান্ডা বাতাসের ঝাপোট লাগা ধরে। আল্লা মাবুদ! হেগো জুলেখায় এটি কী কয়! কী কয়!
‘এটি তুমি কী কও গো মা! এটি কেমুন কতা কও?’ দুয়ারের সামোন তেনে বেচইন গলায় ইমাম হুজুরে জুলেখারে জিগায়।
জুলেখা গো বাইত ইমাম হুজুরে কোনসোম আইলো! দুই মাতারি তো হের আওনের কোনো আওয়াজ পায় নাই! হুজুরে কয়, কেমনে আওয়াজ পাইবো! জুলেখারে খাওয়ানী লইয়া মাতারি দুইজোনে যেই বেতালার বেতালা হইয়া আছিলো!
হুজুরের পায়ের আওয়াজ তাগো কানে ঢোকবো কোনখান দিয়া!
কিন্তু অহন তো হুজুরের পাওয়ের আওয়াজ পাওয়া, না-পাওয়া নিয়া চিন্তা করোনের কোনো ফুরসত নাই! অহন হগলতেরে বইতে হইবো আসোল গুরুতর বিষয়খান নিয়া।
কী সেই গুরুতর কাম? কোনটা ?
জুলেখার হউর বাড়ির বিত্তান্ত-কথা জানোন্তিই অখন একমাত্র তুফান গুরুতর কাম।
(চলবে)