গল্প পড়ার গল্প
খোয়াব দেখা মানুষের কথাকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন তাঁর সৃজনশীলতার শীর্ষে, তখন তাঁর প্রয়াণ হয়েছে ৫৪ বছর বয়সে। জন্মেছিলেন ১৯৪৩-এ, প্রয়াণ ১৯৯৭-এ। তিনি কলকাতায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। খুব সম্ভবত ১৯৯৬-এ। একটি পা তখন বিযুক্ত হয়েছে, হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলেন। এক সন্ধ্যায় তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। কী প্রাণশক্তি মানুষটির ভেতরে। আমি তাঁর দুটি উপন্যাস, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ তখন পড়ে তাঁর অনুরাগী। গল্পের প্রতি অনুরাগ তো ছিলই। সেই সন্ধ্যায় ইলিয়াস অনেক কথা বলেছিলেন। শুনেছিলেনও। তিনি জমি, মাটি, মানুষ, চাষবাস... সবই জানতেন। চিনতেন বাংলাদেশের গ্রাম। ‘খোয়াবনামা’ লেখার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন খোয়াবের সঙ্গে বাস্তবের মিল ও তফাৎ খুঁজে পেতে বুঝি। সেই পা হারিয়েছিলেন অস্ত্রোপচারে।
ইলিয়াসের গল্প পড়লে ধরা যায়, তিনি যেন খোয়াব দেখা মানুষের কথাই লিখে গেছেন সারা জীবন। বাংলাদেশের গল্প বদলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। একটি জাতি গোরস্তানে যেতে যেতে ফিরে এসেছিল, সেই কথা তিনি তাঁর গল্পে-উপন্যাসে লিখে গেছেন। আমার মনে পড়ছে, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ গল্পটির কথা। আবার স্বাধীনতার পর হিন্দুদের বাংলাদেশে ব্রাত্যজনের জীবনযাপনও তাঁর গল্প হয়ে উঠেছে। ‘খোয়ারি’, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ পড়লে তা ধরা যায়। ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পে অনেক দিন বাদে প্রদীপ এসেছে তার পিসির বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তারা এ দেশ (বাংলাদেশ) ত্যাগ করে চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। প্রদীপ ১২-১৩ বছর আগের শহরটা চিনে নিচ্ছিল আবার। কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার হয়েছেও। সে খুব সূক্ষ্ম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তা ধরতে চেয়েছেন নানা অনুভূতির মধ্য দিয়ে। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর স্বর শোনা গেছে স্পষ্ট। তিনি নিজেও বাংলাদেশের লিরিক পত্রিকায় ১৯৯২ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যখনই দেশটিকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে, দেশের হিন্দুরা মাইনরিটি হয়ে গেল। তিনি ছিলেন ছোটগল্পের সূক্ষ্ম শিল্পী।
‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পে ভারত থেকে আসা প্রদীপ তার পিসতুতো ভাই ননীদার আড়তে যায়। ভেবেছিল, তাকে দেখে সকল কর্মচারী ব্যস্ত হয়ে উঠবে। তারা তো তাকে চেনে। কিন্তু গিয়ে দ্যাখে, ননীদাই নেই। কর্মচারীরা তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। বাবু নাই বলে হিসাব মেলাতে লাগল। প্রদীপ ভাবে, পিসির বাড়িই চলে যায়। সেই ভালো। ননীদা কখন ফিরবে, তা জানে না। তখন আড়তের সামনে একটি রিকশা এসে থামে। লাফ দিয়ে নেমে পড়ে ১৮-১৯ বছরের দুটি যুবক। ওরা ঢুকতেই আড়ত তোলপাড় হয়ে গেল। আসেন, বসেন করে আহ্বান জানিয়ে তাদের বলে, বাবু একটু এসডিও অফিসে গেছে। তারপর এসডিও অফিস থেকে ননী সাহাকে ডেকে আনা হয়। তাদের ডানহিল সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন, রসমালাই খাওয়ানো এবং কনফারেন্সের চাঁদা দিয়ে বিদায়।
ননীদার মেয়েটি বড় হয়েছে। যারা টাকা আদায় করে, যাদের নিয়ত তোয়াজ করে ননীদা, তাদের ভয়েই ননীদার মেয়েটি কলেজে যেতে পারে না। সপ্তাহে তিন-চারটি কনফারেন্স লেগে আছে। ব্যবসা কী করে হবে? টাকা তো তোলাবাজদের পেটেই যাচ্ছে। এই গল্পে সংখ্যালঘুর স্বর আছে ব্যপ্ত হয়ে। তার ভেতরে, স্মৃতি, শিকড় উপড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া, বুড়ি পিসিমার ভালোবাসার স্বরে মিলেমিশে গেছে। একটা দেশ কত রকমে জড়িয়ে থাকে মানুষের জীবনে, একটা জীবন কত স্মৃতি বাহিত হয়ে ওঠে, গল্পটি পাঠ যেন সেই এক মায়াময় অভিজ্ঞতা। সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারটির ভেতরে গোপনে চারিয়ে গেছে নিরাপত্তাহীনতা। তা আছে সূক্ষ্ম হয়ে। দেশ ছাড়ার উপায় নেই। ইন্ডিয়ায় গিয়ে ব্যবসা হবে? পাকিস্তানে যে অনিরাপত্তা ছিল, তা বদলায়নি বাংলাদেশ হয়েও। এই গল্পে পিসিমা যেন সেই বাংলাদেশ হয়ে আছেন, যে বাংলাদেশ ছিল সংখ্যালঘুর স্বপ্ন। যে জীবনে তিনি এখনো লগ্ন হয়ে আছেন, তা বড় স্নিগ্ধ।
ইলিয়াসের অন্য এক গল্প, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ইলিয়াস ঢাকা শহরের একেবারে হতদরিদ্র মানুষকে চিনতেন। তাদের কথা নিয়েই তো ‘চিলেকোঠার সেপাই’ লিখেছিলেন। সেই যে রিকশাওয়ালা খিজির, বাংলা সাহিত্য কি তাকে ভুলবে? তেমনি এক চরিত্র ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ গল্পের লালমিয়া। সে যে খোয়াব দ্যাখে ঘুমের ভেতর, তা সাতকাহন করে শোনায়। আসলে খোয়াব দ্যাখে, না খোয়াব বানায়, তার ঠিক নেই। তার স্বপ্নগুলো জাল (মিথ্যা), না সে স্বপ্নের জালে ক্রমাগত জড়িয়ে যায়, এই নিয়ে গল্প। লালমিয়ার যে খোয়াবে আরম্ভ হয় গল্প, সেই খোয়াবের বুড়ো মুসল্লির পায়ের পাতাটি পেছনে। তা নিয়ে শ্রোতারা সন্দেহ প্রকাশ করলেও লালমিয়া তার বয়ান থেকে পিছু হটে না। স্বপ্নের ভেতরে নামাজ পড়তে পড়তে তার পাশে বসা বুড়োর পায়ের পাতাটি সে অমনি দেখেছিল। এই কাহিনী, পায়ের পাতা উল্টো করে বসান বিদেহী, লোকসমাজে প্রচলিত। আমি তো ছেলেবেলায় তা শুনেছি। লালমিয়া নাজির আলির মোরগ-পোলাওয়ের দোকান দ্যাখে। সেই দোকানেই কাজ করে যে কিশোর বুলেট, সে লালমিয়ার স্যাঙাৎ ইমামুদ্দিনের ছেলে। ইমামুদ্দিন মুক্তিতে নাম লিখিয়েছিল, তাই মরেছে। তার বউকে মিলিটারি তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। বুলেট তার দাদির কাছে মানুষ। তার স্বভাবটি হয়েছে তার বাবা ইমামুদ্দিনের মতো। লালমিয়ার কথায় শুধু সন্দেহ প্রকাশ করে। এই গল্প সেই ইমামুদ্দিনেরও, যে কি না মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে আহুতি দিয়েছিল।
এই কাহিনী নাজির আলির, যে কি না পাকিস্তানি মিলিটারির খিদমত খাটত। মিলিটারিকে জানান দিত মুক্তির পক্ষের লোকজনের সুলুক। লালমিয়া ছিল নাজির আলির লন্ড্রির ইস্ত্রি করা মজুর। লন্ড্রিটা নাজির আলি দখল করেছিল ঢাকায় মিলিটারি নামলে হিন্দু এক পরিবার প্রাণের ভয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলে। খোয়াব দেখা বা খোয়াব তৈরি করা লালমিয়ার স্বভাব। সেই কৈশোর থেকে ইমামুদ্দিনের সঙ্গে তার স্যাঙাতির সময় থেকেই সে বানায়। সিনেমা দেখে এসে সাতকাহন। ইমামুদ্দিন সন্দেহ প্রকাশ করত। লালমিয়া সেই স্বপ্ন কিংবা তার অলীক গল্প-কাহিনী নিয়েই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিল। আর কাটাল ইমামুদ্দিনের মা, বুলেটের দাদি, আর কাটায় বুলেট। সকলেই নিজের মতো করে স্বপ্ন তৈরি করে নেয়। বুলেটের দাদি তার স্বপ্নের ভেতর দিয়েই ইমামুদ্দিনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা করে তোলে। সে হানাদার পাকিস্তানি মিলিটারিকে মেরেছে দেশের মুক্তির জন্য। নাজির আলিকেও। সমস্তটিই তার ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন। রাজাকার নাজির আলি বাংলাদেশের জন্মের পর ঢাকা থেকে পালিয়েছিল। তারপর সব ম্যানেজ করে আবার ফিরে এসে দখল নিয়েছে নিজের ক্ষমতার। ছেলেবেলা থেকে দাদির মুখে বাবার কাহিনী, বীরত্বের কথা শুনে শুনে বুলেটের ভেতরেও স্বপ্ন তৈরি হয়। সেও তার বাবাকে নিয়ে গল্প বানায়। কী অসামান্য ইলিয়াসের এই কথন।
বিভ্রম ও বাস্তবতা দুই কীভাবে মিলিয়ে মিলিয়ে পৌঁছেছেন এমন এক বৃত্তান্তে, যা কি না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সমাজকে চিনিয়ে দেয় বিন্দুতে বিন্দুতে। মুক্তিযুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষের অংশগ্রহণে সমগ্র এই গল্পই হয়ে ওঠে যেন এক স্বপ্নবৃত্তান্ত। ইলিয়াস নগরবাসী নিম্নবর্গের মানুষকে চিনতেন যেভাবে, সেই চেনা আমাদের সাহিত্যে, দুই বাংলাতেই বিরল। লালমিয়া ছিল নাজির আলির কর্মচারী। লালমিয়া মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। কিন্তু লালমিয়া ইমামুদ্দিনের এতিম বাচ্চা আর তার মায়ের জন্য আশ্রয় জোগাড় করেছিল। তার জীবনের অন্তর্গত হয়েই আসে এই সব। সে নাজির আলি নয়, সে লালমিয়া। সে যাদের দ্যাখে খোয়াবে, তাদের পায়ের পাতা পেছনে। তারা সমুখে এগোতে গেলে পেছনে চলে যায়। পেছনে হাঁটা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না, তাই খোয়াব তাকে ভয়ার্ত করেনি। এই গল্প এক আশ্চর্য কথন। ইলিয়াস নিজেই নিজের সঙ্গে তুলনীয়।