গল্প পড়ার গল্প
সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ তাঁর সমস্ত গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস বাক্সবন্দি করে রেখে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তা যখন ক্রমশ আবিষ্কৃত হতে থাকে, ধরা যায় এসব লেখা কবির খেয়ালে লেখা একটি বা দুটি গল্প বা উপন্যাস নয়। এসব লেখা তাঁর সৃষ্টিকর্মে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। জীবদ্দশায় কেউ জানল না, তিনি এই কাজটি নিভৃত মগ্নতায় করে গেছেন। জীবনানন্দ যে কাজটি এত গোপনে করে গেছেন, সমগ্র বিশ্বে তা বিরল। তাঁর গল্প ও উপন্যাস তাঁর সময় থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর এগিয়ে ছিল। তিনি গত শতাব্দীর তিরিশের দশক ও চল্লিশের দশকে যে গল্প ও উপন্যাস লিখেছিলেন, তা ওই সময়ে ছিল অচেনা। চিত্রময় গদ্য ভাষা, কাটা কাটা বাক্য, নাগরিক মনন জীবনানন্দকে একদম আলাদা করে দিয়েছিল। মাল্যবান, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী আমার প্রিয় উপন্যাস। তাঁর গল্প পড়তে গিয়ে টের পাই যে সময় তিনি লিখেছিলেন এসব লেখা পেনসিল কিংবা কলমে, সেই সময় আমরা হয়তো এই জীবন বোধের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলাম না।
আমি জীবনানন্দের সেই সব গল্প, মেয়েমানুষ, হিসেব নিকেশ, কথা শুধু—কথা, কথা, কথা, কথা, কথা, পূর্ণিমা, সঙ্গ নিসঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা-কামনার বিলাস, নিভৃতে পাঠ করি। ভোগী ও সুখী বিত্তবানের হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে আসে জীবনানন্দের গল্পে। ‘মেয়েমানুষ’ গল্পটির কথা মনে করি, হেমেন্দ্র-চপলা স্বামী স্ত্রী। সফলতা হেমেন্দ্রকে অহংকারী করেছে। সে ব্যবসা করে। দুপুরে বাড়ি ফিরে চপলাকে নিয়ে কোথাও একটা যাবে সে। রেসের মাঠে, সিনেমায়? না, চপলা যাবে না কোথাও। বিলাসে আলস্যে সে ক্লান্ত। জীবনানন্দের গল্প ও উপন্যাসের এসব মানুষ এসেছে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ধনী হয়ে ওঠা সম্প্রদায় থেকে। তিনি তাঁর সময়কে আত্মস্থ করেছেন তাঁর কবিতায় যেমন (মনে করুন ১৯৪৬-এর কথা), তেমনই তাঁর গল্পে। যেখানে কবিতায় অপারগ হয়েছেন, উপন্যাস গল্পের ভেতরে সেই আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে প্রবেশ করেছেন। হেমেন্দ্র আর চপলা নিজেদের মোটরে শেষ পর্যন্ত বেরোয় তাদের লীলা-দ্বিজেনের বাড়ির উদ্দেশে। মাঝপথে মোটর খারাপ হলে বাসে ওঠে। কিন্তু হেমেন যখন দ্যাখে বাসে চপলার পাশে বসে আছে কুলি জাতীয় একটি লোক, সে তাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে পৌঁছায় বন্ধু গৃহে। লেখক বিবরণ দিচ্ছেন হেমেন্দ্রর, ‘হেমেনের মুখও যেন তার ভুঁড়ির মতই : চপলার মুখও হেমেনের মতই যেন—কল্পনা বা স্বপ্নের কোনো চিহ্ন যেন এদের মুখায়বয়বের ত্রিসীমানায়ও কোনদিন ছিল না।’ তারা কত ধনী হয়েছে তা বাড়িতে বসে পরিমাপ করে চপলা। ঢনঢনিয়া মাড়োয়াড়ি মস্ত বড় এক ভোজ দিয়েছে, নিমন্ত্রিত লোকজনের ভিতর প্রায় শতখানেক নাম উঠেছে; হেমেনের নাম নেই। তারা এখনো ততো বড়লোক হয়ে ওঠেনি, যাতে খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠে। তারা ঢের পেছনে, অথচ তাদের বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে চলল। চপলা কখনো কখনো বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে, মানুষের ওপর, পৃথিবীর ওপর, নিজেদের জীবনের অকৃতকার্যতার ওপর। তারা চলল শ্যামবাজারে দ্বিজেনের বাড়ির পথে। সেই সাবেক শ্যামবাজার। তারা বাসা নিয়েছে বালিগঞ্জ এভিনিউতে। ব্যারিস্টার দ্বিজেন কিছুতেই ছাড়তে চায় না শ্যামবাজার। আসলে দ্বিজেন আর লীলার বনে না। লীলা খুব দাপুটে। চপলা, হেমেন ঢুকতে ঢুকতে লীলার চিৎকার শোনে। ভেবেছিল কাজের লোকের সঙ্গে লেগেছে, আসলে তা নয়, ডাইনিং রুমে প্রবেশ করে দ্যাখে লীলা রণচণ্ডী, দ্বিজেনকে ধমকাচ্ছে, একটি স্লাইস পাউরুটি হাতে দ্বিজেন চুপ করে বসে আছে। দ্বিজেনকে তারা ডাকতে চপলা বলে ওঠে, ওকে আর আস্কারা দিতে হবে না। দ্বিজেনকে প্রায় দলিত করেই রাখে লীলা।
চপলা তার স্বামীর সঙ্গে অমন পারে না। বিস্মিত হয় সে। তখন ঘটনাক্রমে চপলা চেয়ার থেকে পড়ে যেতে দ্বিজেন তাকে তুলে ধরতে লীলা খুব খারাপ ভাবে তিরস্কার করে দ্বিজেনকে। অনাত্মীয় চপলার গায়ে হাত দিল কী করে দ্বিজেন? দ্বিজেনকে সন্দেহ করে লীলা। চব্বিশ ঘণ্টা হাইকোর্টে কী করে দ্বিজেন তা সে জানে। এর ভেতরে আবার ব্যবসা ফেঁদেছে, জে-বি-অ্যান্ড কোং। লীলা বলে, দ্বিজেন সমস্ত দিন, প্রায় এগারো-বারো ঘণ্টা নানা মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করে বেড়ায়। তা শুনে চপলা বলে, হেমেন তো প্রায় আঠারো ঘন্টা বাইরে থাকে, কাজেই থাকে তো। লীলা তখন হেমেনের টেকো মাথা আর বোঁদা চেহারার খুব নিন্দা করে বলে, ওই চেহারা দেখে কোন মেয়ে আসবে? কিন্তু এই কথায় অপমানিত বোধ করে হেমেন বলে ওঠে, সে যদি চায়, এখনো কুড়ি পঁচিশটা মেয়েমানুষ তার পায়ে এসে পড়বে।। চপলা শুনে, লীলাকে বোঝায়, এত দিনের সংসার তাদের, কোনো একটি দিনও অন্য মেয়েমানুষের দিকে তাকাতে দ্যাখেনি সে তার স্বামীকে। লীলার কথা হলো, হেমেনের যেন পৌরুষই নেই, তাই সে অকলঙ্ক। হেমেন অপমানিত বোধ করে। সে গর্জন করে বলে, সে তার চরিত্র হাতে করে বসে নেই, একদিনেই কলকাতা শহরকে সাঁওতাল পরগনা করে তুলতে পারে। কথায় কথায় ক্রুদ্ধ হেমেন, চপলা আর লীলাকে নিয়ে দ্বিজেনকে বলে, এইসব ঠানদিদি-ঠাকমার মতো আধবুড়ি মেয়েমানুষরা তাদের চেহারা নিয়ে ঠাট্টা করে! গল্প ক্রমশ গোপন হিংস্রতায় পৌঁছে যেতে থাকে।
সেদিনের পর হেমেনের মন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। কী হবে ব্যবসা করে? মিথ্যে তো বলেনি লীলা। সে কিম্ভুতকিমাকার এক পুরুষ হয়ে গেছে। তার দিকে কোনো মেয়েই ফিরে তাকায় না। চপলাও তো মেদের পাহাড়। পরিবার বাদ দিয়ে এ জীবনে অন্য নারীর স্পর্শ তো চাই। ব্যারিস্টার দ্বিজেনের তা হয়। হেমেনের মনে হয় দ্বিজেন অনেক নারী নিয়ে জীবনকে ভোগ করছে। কিন্তু এই নিয়ে কথা পাড়লে, দ্বিজেন বুঝিয়ে দেয়, তাদের বয়স হয়েছে। তাদের দিকে কেন আসবে কোনো কুড়ি-বাইশ, তিরিশ-বত্রিশের মেয়ে। হয় না। হতে পারে না। আসলে তাদের জীবন ফুরিয়ে গেছে। হেমেন শুনতে শুনতে টের পায় সে তবু চপলার ভালোবাসা পায়, কিন্তু দ্বিজেন?
হেমেন বলে, চলো ঘুরে আসি গাড়ি নিয়ে। ব্যবসার কাজ নয়, কিন্তু ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয় বিমনা হেমেনের। ফিরবে রাত হলে। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে বলে দ্বিজেন যায় না। হেমেন চলে যায়। দ্বিজেন একটা ট্যাক্সি নিয়ে তাকে অনুসরণ করে বালিগঞ্জ এভিনিউ অবধি গিয়ে হেমেনের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দ্যাখে মেদবাহুল্যে ঢাকা পড়া চপলাকে। কিন্তু সে জানে ওই মেদের নিচে এখনো একটি হৃদয় বেঁচে আছে। কী আশ্চর্য এই গল্প। রাত বাড়লে দ্বিজেন বেরিয়ে যাবে। যেতে হবে তাকে। কেননা গিন্নিরাও চায় যে তাদের স্বামী আসুক, এই অতিথি বেরিয়ে যাক। বেরিয়ে যেতে হয় তাকে। জীবনানন্দের এই গল্প লেখা হয়েছিল সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগে। ভাবুন পাঠক আপনি। হ্যাঁ, আপাতত বিরতি। এখনো কত গল্প না বলা রয়ে গেল। লিখব নিশ্চয় কোনো একদিন।