‘ডুব’ নিয়ে একটি সম্যক আলোচনা
১.
‘ছুটবে কোথায় প্রেম তাল কানা/গোপনীয়তার নেই মালিকানা/এই প্রেমিকেরও আসল ঠিকানা/দশ ফুট বাই দশ ফুট।’ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ ছবিতে ইরফান খান অভিনীত চরিত্র জাভেদ হাসানকে দেখে কবীর সুমনের এই গানটির কথাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আরো অনেকের কথা। সেগুলো বলছি ধীরে ধীরে।
ফারুকী একটি গল্প বলতে চেয়েছেন, সেটা কার সঙ্গে মিলে যায় সেটা মুখ্য নয়, সেই তর্ক প্রাসঙ্গিকও নয়, এর কারণ ছবির কোথাও বলা হয়নি এই ছবিটি বায়োপিক। তবে সজাগ দর্শক ঠিকই মিল খুঁজে বের করে নিতে পারবেন। সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। ফারুকীর চলচ্চিত্রটির চলচ্চৈত্রিক ভাষা নিয়েই মূলত আলাপ করব, আর কথা বলব চরিত্রগুলোর ট্রিটমেন্ট আর স্থান-কাল-পাত্রকে যেভাবে এই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা নিয়ে।
ছবির গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম : জাভেদ হাসান (ইরফান খান) একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, তার স্ত্রী মায়া (রোকেয়া প্রাচী)। তাদের এক কন্যা সাবেরি (নুসরাত ইমরোজ তিশা) আর এক ছেলে আহির (রাশাদ হোসেন)। নিতু (পার্নো মিত্র) জাভেদের মেয়ে সাবেরির ছোটবেলার বন্ধু। বড় হওয়ার পর নিতু জাভেদের ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করে। একসময় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রেম হয়। বিষয়টি প্রকাশ পায় পত্রিকায়। মেয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম, এটা নিয়ে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে জাভেদ সিদ্ধান্ত নেয়, সে নিতুকে বিয়ে করবে। সাবেরি ও তার মা মায়া জাভেদকে ছেড়ে ভিন্ন বাসায় থাকতে শুরু করে। জাভেদ তার ছেলেমেয়েকে ভালোবাসে, কিন্তু নিতুর চাপে সেটা প্রকাশ করতে পারে না। একপর্যায়ে আবেগের টানাপড়েন তীব্র হয় জাভেদের মধ্যে। আমরা দেখি সে মারা যায়। মৃত্যুর পর কবর কোথায় হবে, সেটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ‘নয়নতারা’ নামে জাভেদের যে শুটিংস্পট ছিল, সেখানেই কবর হয়। দশ ফুট বাই দশ ফুট, এই ঠিকানাতেই শেষ হয় প্রেমিক জাভেদের যাত্রা। ছবি এখানেই সমাপ্ত।
২.
গোটা ছবিতে ক্যামেরার কাজ ও কোণ অর্থকে বহন করেছে যথাযথ। অর্থবহ এই সিনেমাটোগ্রাফি দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে ইতালির পরিচালক মিকেল্যাঞ্জেলো আন্তোনিওনির কথা। তাঁর ‘লাভেন্তুরা’ চলচ্চিত্রের কথা। যেখানে চরিত্রদের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখা যায় না। সেখানেও দুই বান্ধবী থাকে, থাকে প্রেম নিয়ে সংকট। সেই ছবির চরিত্রদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে টানাপড়েনের ভাগাভাগি করতে দেখা যায়। ফারুকীর ছবিতে প্রথম ও শেষ দৃশ্যে আমরা সাবেরি আর নিতুকে দেখি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, সংকট নিয়ে তারা মুখোমুখি হয় না। দুজনই সংকটকে সংকটের মতো করে থাকতে দিতে চায়। কেউই সমাধান চায় না। দ্বন্দ্বে যেতে চায় না।
ছবিটির আরো কিছু দৃশ্য দেখে মনে পড়ে ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি আর তাঁর কইকার ট্রিলজিকে (হোয়ের ইজ মাই ফ্রেন্ডজ হোম?, অ্যান্ড লাইফ গোজ অন, থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ)। বিশেষ করে জাভেদের পরিবার যখন বান্দরবানে সর্পিল পথ ধরে এগোতে থাকে বা সেখানে অবস্থান করে, তখন সেখানকার পাখির চোখ দিয়ে তাকানো ফ্রেমগুলো বা ঘাস ও বাতাসের খেলা যে ফ্রেমে ধরা পড়ে, কিংবা ঢাকায় কৃষ্ণচূড়ার দুলুনি, সেগুলো দেখলে ইরানি চলচ্চিত্রের সেই কবিকেই মনে পড়ে। ‘ডুব’ ছবিতে প্রকৃতির এই আপন খেলা আর পাহাড়ি বন্ধুর পথ মনে করিয়ে দেয় মানুষ এই সময় ও প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
‘ডুব’ তার সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে সংলাপের বাইরেও কিছু বলার চেষ্টা করেছে এবং সেটা বলতে পেরেছে। পুরো ছবিতে দেখবেন চরিত্র বা বস্তু, যেমন সাগরে সাম্পান ফ্রেমের একদিকে রয়েছে, অন্যদিকটি খালি। একটা জায়গায় দেখবেন লঞ্চের জানালা অর্ধেক খোলা, অর্ধেক বন্ধ। জাভেদ ও সাবেরি একদিকে, অন্যদিকটা ফাঁকা। পুরো ছবিতেই বারবারই এই বার্তা হাজির হয়েছে : কী যেন নেই, কিসের যেন একটা অভাব, কোথায় যেন অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গেছে শূন্যতায়। জাভেদই সেই শূন্যতা। শূন্য এমন এক সংখ্যা, যাকে বলা হয় প্লেস হোল্ডার, সংখ্যাতত্ত্বে তার গুরুত্ব অপরিসীম। জাভেদও সে রকম। সাবেরিদের পরিবারে জাভেদ স্মৃতিতে পরিণত হয়, বর্তমানে থাকে না, আবার অন্যদিকে নিতুর কাছে জাভেদ বর্তমানে থাকে, স্মৃতিতে জাভেদকে সে পায় না, কারণ জাভেদ পরিবারকে ভুলতে পারে না, সবটাতেই একটা অসম্পূর্ণতা ছিল, আর সেটাই যেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন পরিচালক। জাভেদের মৃত্যুর পর তাই মেয়ে সাবেরি ক্ষোভ নিয়ে বলে, জাভেদ হাসান তো পঞ্চাশ বছরে জন্মগ্রহণ করেছে, এর আগে তার আর কিছু ছিল না। পরিবার ও নতুন স্ত্রী কোথাও জাভেদ পুরোপুরি ছিল না। আদৌ পুরোপুরি থাকা কি সম্ভব? অভাবের ভাব যে সদা বিরাজমান। আমরা দেখি, জাভেদের প্রস্থানে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তাতে খুশি হয় মায়া। বলে, জাভেদ এখন আর কারো নয়। জাভেদ যেন শূন্যের মতোই জায়গাটা দখল করে থাকে শেষ পর্যন্ত, ঋণাত্মক বা ধনাত্মক কোনোদিকেই আর সে নেই। সে একটি অভাবের বোধ নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়।
নিতুর সঙ্গে যখন সম্পর্কের খবর প্রথম পত্রিকায় বেরোয়, তখন জাভেদের মানসিক অবস্থা বোঝাতে যে ক্যামেরা কোন ব্যবহার করা হয়েছে, ক্লোজ শটে, একটু বাঁকা করে, সেটাকে কিতাবি ভাষায় বলে ক্যান্টেড (canted) শট; অনেকে এটাকে অবলিক (oblique) বা ডয়েটশ (Deutsch) শটও বলে। এই বাঁকা করা শটের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় ছবির টালমাটাল পরিস্থিতি বা চরিত্রের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থাকে। এধরনের চলচ্চৈত্রিক ভাষা সিনেমার ইতিহাসে বহুবারই ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়, এই ভাষা প্রথম ব্যবহৃত হয় জার্মান ‘দ্য ক্যাবিনেট অব ডক্টর ক্যালিগারি’ (১৯১৯) ছবিতে। এই ক্যান্টেড শটের ব্যবহার ‘ডুব’ ছবিতে উপযুক্ত হয়েছে।
সিনেমাটোগ্রাফি ছাড়াও সম্পাদনার যে রীতি এই ছবিতে অনুসরণ করা হয়েছে, সেটাও বিশুদ্ধ একটি শটের পর আরেকটি শট বসানো বা জাক্সটাপজিশন (juxtaposition) নয়, রীতিমতো সময়কে নিয়ে খেলাধুলা করেছেন পরিচালক। এই জায়গায় আমার স্মরণে আসে জিল দল্যুজের কথা। ফরাসি এই দার্শনিক সিনেমাবিষয়ক দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি সময় ও ছবি নিয়ে আলাপ বিস্তার করেছেন। তিনি মুভমেন্ট-ইমেজ ও টাইম-ইমেজ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলছেন, সময়কে আমরা দুভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে পাই। একভাবে পাই, যেখানে সময় অতীত অথবা নৈর্ব্যক্তিক স্মৃতি, সেটি আমাদের কাছে ছায়ামাত্র বা ভার্চুয়াল বিষয়। আর আরেকভাবে আমাদের অভিজ্ঞতায় সময় ধরা পড়ে, সেটি হলো বর্তমান, যেটাতে আমরা বেঁচে থাকি। যে সময়ে বা দুনিয়ায় আমরা বেঁচে থাকি, সেটি আদতে ওই পেছনের স্মৃতিগুলোই অর্থদান করে। আমরা প্রতিদিনকার জীবনযাপন করি বটে, পেছন থেকে সেখানে কিন্তু অনবরত স্মৃতিরা হানা দেয়। বর্তমানে হানাদার স্মৃতিকে নিয়ে চলার নামই জীবন। আর সেটাই আমরা দেখি ‘ডুব’ ছবিতে।
সাবেরি ও নিতু দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একটি অনুষ্ঠানে, কিন্তু তাদের যাপিত সময়ে হানা দেয় স্মৃতি, যে স্মৃতিতে আমরা দেখি জাভেদ হাসানকে। স্মৃতির জাভেদ হাসানের বেঁচে থাকার ভেতর আমরা আবারও স্মৃতির আগ্রাসন দেখি, দেখি জাভেদ চলে গেছে মায়ার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের দিনগুলোতে। সেখান থেকে জাভেদকে ফিরে আসতে হয়, মায়ার টানে, কারণ মায়া বলে, এত পুরোনো কথা স্মরণ করছে কেন জাভেদ? এরপর নিতুর সঙ্গে সম্পর্ক, সেটা প্রকাশ্যে আসা, প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ, সন্তানদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া, সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত জাভেদ। একটা সময় আমরা দেখি সেও স্মৃতি হয়ে যায়। এভাবে মন্তাজে সময়ের সুতা স্মরণের পথ ধরে কখনো পরিচালক টেনেছেন, কখনো ছেড়েছেন, সময়কে পরিণত করেছেন এক স্থিতিস্থাপক বস্তুতে।
বর্তমানের ভেতর অতীতকে পুরে, অতীতের ভেতর আরো সুদূর অতীতকে পুরে, আবার ফিরে আসা বর্তমানে, এভাবেই ছবির ভেতর ডুব দেয় পরিচালক, ডুব দেয় দর্শক, এরপর ফিরে আসে, ভেসে ওঠে একরাশ শূন্যতা নিয়ে। চলচ্চিত্রের যে ভাষায় এ সময়ের পরিভ্রমণ সম্পন্ন হয়, তা বারবার আসলে দল্যুজের দর্শনের কথাই মনে করিয়ে দেয় : বর্তমানকে ভবিষ্যতে যেতে হয় অনবরত ভূতের হানাকে সঙ্গে করেই।
৩.
এবার আসি চরিত্রগুলোর কথায়। ছবিতে সাবেরির আবেগ যতটা প্রগাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে, ততটাই আড়ালে পড়ে গিয়েছে মায়া, জাভেদ ও নিতুর মানসিক অবস্থা। জাভেদের আবেগ অবশ্য অনেক জায়গাতেই বিজ্ঞাপিত, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে মায়া সে তুলনায় কম জায়গা পেয়েছে নিজেকে মেলে ধরতে। আর এই তিনজনের তুলনায় আমি বলব অবিচার হয়েছে নিতু চরিত্রটির প্রতি। এর কারণ পুরো ছবিতে একাধিকবার বলা হয়েছে, নিতু অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে জাভেদের সঙ্গে প্রেম করেছে, বিয়ে করেছে এবং এর পেছনে তার খ্যাতির প্রতি মোহ ছিল। আরো দেখানো হয়েছে নিতু অস্থিরচিত্ত, ঈর্ষাকাতর ও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একটি মেয়ে। কিন্তু সে কী করে জাভেদের মতো পরিচালকের প্রেমে পড়ল, তার কি কেবল ওসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যই ছিল? নাকি অভিনয়ের প্রতি প্রেম, পরিচালকের প্রতি ভালোবাসাটাও কাজ করেছে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা এই ছবিতে হয় না। ধরে নিই নিতু ও রকমই, তাহলে জাভেদের মতো পরিপক্ব মানুষ কী করে এই অপরিপক্ব ও লোভী নিতুকে গ্রহণ করল? এসব প্রশ্নের মুখে মনে হয়, নিতুর প্রতি পরিচালক আরেকটু সদয় হতে পারতেন। তা ছাড়া নিতুর চরিত্রকে নেতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করেও ছবির মূল বক্তব্য অক্ষুণ্ণ রাখা যেত। আমার মনে হয়েছে, অযথাই নিতুকে ‘খারাপ’ বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। সাবেরি তো তার জায়গা থেকে নিতুকে দোষারোপ করবেই। তাই বলে সেটাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে কেন? আরেকটি বিষয়, ছবিতে ভালো আর খারাপ, এ দুই মেরুই বা থাকতে হবে কেন?
জাভেদ অর্থাৎ ইরফান খান প্রসঙ্গে বলব, এই ভদ্রলোক অভিনয় তো ভালো করেন, কিন্তু উচ্চারণের কারণে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। ছবির দাবি অনুযায়ী সৈয়দপুরে বাড়ি জাভেদের। সেই অঞ্চলের মানুষের উচ্চারণ এমন মাড়োয়ারি ধরনের হয় না। তাঁর জায়গায়, কথার কথা বলছি, তারিক আনামকে কি ভাবা যেত না? বা অন্য কেউ? যাকে দেখতে ও শুনতে বাংলাদেশি মনে হয়? ঠিক আছে, বাজার অর্থনীতি আছে এর পেছনে, কিন্তু শিল্পটাও তো আছে! বাণিজ্যের কাছে এখানে শিল্প মার খেয়েছে বলেই মনে হয়। পরিচালক আপস করেছেন। এটা না করলে ছবিটি আরো ত্রুটিমুক্ত হতে পারত।
জাভেদের শ্বশুর ও শাশুড়ির অংশটি কি রাখতেই হতো? শ্বশুরের কৌতুকপূর্ণ ওসব কর্মকাণ্ড কি অপরিহার্য ছিল এই ছবির জন্য? যেমন কথা বলার ধরন, সংলাপ বা ভাতের থালা আছাড় মারা। এগুলো কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। যাই হোক, পরিচালক নিশ্চয় কমিক রিলিফের কথা বলবেন? একটি ‘সিরিয়াস’ ছবিতে এই কমিক রিলিফ না রাখলে কি এমন ক্ষতি হতো? ছবির বক্তব্য কি ফুটে উঠত না? দর্শককে হালকা বিনোদন দেওয়ার এসব লোভ, আমি বলব, পরিচালকের সংবরণ করা উচিত ছিল। এরপর নিতুর দেয়াল টপকানোর সময় দারোয়ানের সামনে পড়ার দৃশ্যটিও মনে হয়েছে, একটু চটুল বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা।
চটুলতা পরিহার করা গেলে এই ছবিটি আরো ঘন ও গাঢ় হতে পারত। আর ছবি মুক্তির আগেই হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে এই ছবি নির্মিত—এমন বিতর্ক চাউড় না হলে আরো ভালো হতো। অবশ্য এটার জন্য ছবি-সংশ্লিষ্টরাই দায়ী। এই একটি কারণে অধিকাংশ দর্শক একটি পূর্বধারণা নিয়ে ছবিটি দেখতে বসেছেন। অবশ্য যে গল্পটা ফারুকী বলার চেষ্টা করেছেন, সেটা যে হুমায়ূনের জীবন থেকে তিনি নেননি, সেটা হলফ করে বলতে পারবেন না তিনি। কাজেই অযথা বিতর্ক তৈরি না করে বললেই পারতেন, কথাসাহিত্যিকের জীবন থেকেই পেয়েছেন তিনি এই গল্পের প্লট।
গল্পের যে বক্তব্য, সেটা বলার জন্য যেমন কৌতুক দরকার ছিল না, তেমনি বান্দরবানের এক্সোটিক লুকটাও খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। তাহলে কি এই জায়গায় বিদেশি দর্শক মাথায় ছিল পরিচালকের? বিদেশি দর্শক মানে বিদেশের বাজারের কথাও বলতে হয়। আমি বলব, এসব বিষয়—বাইরের বাজার, দেশের বাণিজ্য, কৌতুক, চটুল দৃশ্য—বাদ দিতে পারলে ছবিটি সর্বাঙ্গীণভাবে চমৎকার হয়ে উঠতে পারত। তবে ওগুলো নিয়ে ছবিটি যে অসুন্দর হয়েছে, তা বলছি না; বরং বলব ফারুকীর আগের যেকোনো কাজের চেয়ে ‘ডুব’ অনেক পরিণত কাজ।
৪.
শেখ রাজিবুল ইসলামের সিনেমাটোগ্রাফি, রিপন নাথের শব্দ পরিকল্পনা, মোমিন বিশ্বাসের সম্পাদনা এবং সর্বোপরি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ‘ডুব’ এক শূন্যতার কথা বলে, মৃত্যুর মতো নিশ্চিত প্রাকৃতিক ঘটনার কথা বলে, বলে মানুষের শেষ শয্যার কথা, অস্তগামী সূর্যের আলোয় অগস্ত্যযাত্রার কথা বলে, সেই যাত্রায় সকলকেই ডুব দিতে হয়, ডুবে যাওয়া স্মৃতিগুলো মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে বর্তমানে। তাই তো বারবারই ঘুরেফিরে মৃত্যু প্রসঙ্গটি এসেছে ছবিতে। প্রকৃত মৃত্যুর আগেও যে মানুষ মারা যায়, সেটাও জাভেদ বলতে ভোলেননি। জীবন-নৌকায় ভাসতে ভাসতে মেয়ে সাবেরিকে জাভেদ বলছিল, ‘মানুষ মারা যায় তখনই যখন প্রিয়জনের সঙ্গে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়।’ তাই বলব, মৃত্যু বা শূন্যতাই এই ছবির মূল সুর।
‘ডুব’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন বাঁকের নির্দেশ করছে।