সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
নিজের পিছে ইমাম হুজুরের গলার আওয়াজ পাইয়া জুলেখার দুই চক্ষের ভিতরে দুই তেজালো পানির নহর পলকে জাগনা দিয়া ওঠে। হেইর পর দবদবাইয়া হেই নহর নামতে থাকে নিচের দিগে।
কিন্তুক এইটা তো কান্দনের কাল না! না জুলেখার কান্দনের কাল এইটা; না তার মাওয়ের কান্দনের কাল এইটা!
এইটা হইলো প্যাছ-ঘোছ দূর করোনের খোন। অখন এইটা হইতাছে ভেদের কথা আঁতিপাঁতি ভাইঙ্গা-চুইরা খোলাসা করোনের কাল। জুলেখার সগল কথা কওনের খোন এইটা! জুলেখার সগল কথা মুরুব্বিগো হোনোনের খোন এইটা। অহন কাইন্দা কাল নষ্ট করলে চলবো! চলবো না।
‘অখন, মা-খালারা গো! আপনেরা আল্লার অস্তে চউখ পোছেন!’ ইমাম হুজুরে জুলেখার মা মাতারিরে কাতর গলায় মিন্নতি দেয়; ‘আপনে কান্দলে জুলেখার চক্ষের পানি না পইড়া থাকবো না! তাইলে উয়ে-না তার নিজের দিল ঠান্ডা করতে পারবো, না সগল কথা ভাইঙ্গা কওনের সয়-সুস্থির হালখান পাইবো!’
ইমাম হুজুরের কথাটা তো ফালাইয়া দেওনের কথা না! এই কথা হইলো দমে দমে মান্যি করোনের কথা। সেইটারে মান্যি করতে গিয়া জুলেখার মায়ে তরাতরি চউখ পোছে। চউখ পুইচ্ছা সেয় মাইয়ার দিগে চায়!
অম্মা! মাইয়ায়ও দেহি তুফান রকমে চক্ষের পানি ফালাইতাছে! কান্দে কোন কারণে এই সর্বনাশীয়ে! ক্যান আবার কান্দনের কুয়ারা জোড়াইছে উয়ে! ক্যান!
মাইয়ার দিগে চাইয়া এইবার আর তার পরানে কোনো প্রকার মায়া-রহম-আল্লাদ কিছুই ছল্লাত দিয়া ওঠে না! উল্টা আরেক কারবার ঘটতে থাকে দেহো মায়ের অন্তরে!
কী হয়! না; ফোঁপাইয়া—কঠিন রকম—গোস্বা উঠতে থাকে মায়ের পরানের ভিতরে! বহুত কড়ড়া গোস্বা!
হায় হায় হায়! কিমুন পাষাণীর পাষাণীরে পেটে ধরছে সেয়! ক্যামনে মাইয়ায় কোন পর-বেটার লগে বিয়া বইতে গেছে গা! ক্যামনে গেছে গা! মায়-বাপরে জিগানি না, জানানি না! একটা ডাক-খোঁজ তরি মাও-বাপেরে দেউন্তি না! এইটা ক্যামনে করতে পারছে হারামি মাইয়ায়! ক্যামনে সগলতেরে ঠকানি দিয়া মাইয়ায় গেছে গা কোন এক পর-বেটার লগে! এইটা ধরমে সইবো!
আছতাগফেরুল্লা! আছতাগফেরুল্লা! আউ ছি ছি!
এমুন নিদয়া-নিলাজরে পেটে ধরছে সেয়! ক্যান এমুন নাক-কাটী, দাগিরে পেটে ধরতে হইছে তারে! ধিক তার পেটেরে!
মাইয়ার মোখের দিগে চায় জুলেখার মায়; আর ভিতরে ভিতরে পরান তার ডরে, গোস্বায়, ঘিন্নায়, নাই জ্বালায় ছনছনাইতে থাকে! কপালে তার এটি কী লেখছে খোদায়!
অদিগে দেহো জুলেখার মায়ের ভিতরের এতোসব প্যাঁচগোছের কথা কেমনে জানি ইমাম হুজুরে এক ঝাপটে ধইরা ফালায়। হেইর পর আর নি ইমাম হুজুরে অই মাইয়ার সামনে তার মায়েরে এক দণ্ডের লেইগাও বইয়া থাকতে দিতে পারে!
মায়ে কতখোন পারবো নিজ অন্তরের জ্বালা-যাতনা অন্তরের ভিতরে চাইপ্পা থুইতে! বেশিক্ষণ না! সেই চেত, সেই ঘিন, সেই জ্বালা—ঝটকা দিয়া দিয়া বাইর হইতে বেশিক্ষণ লাগবো না!
তহন কাইজ্জা-কান্দাকাটি, বকাবাজি, চোপা চালাচালির ধুম পইড়া যাইবো। আসোল বিত্তান্ত হোনোনের আর তাইলে ফুরসত পাইবো না ইমাম হুজুরে! তহন, জুলেখারে আসোল শোধন দেওনের কামখানও হইয়া থাকবো আধা-খিছড়া!
না না না! অই শোধনের কামে যতো বাগড়া পড়বো, ততো না দেওভোগ গেরাম থাকবো ফাঁড়ার নিছে! হেইটা তো আর চলতে দেওন যাইবো না! কোনো রকমেই না!
এই ভাবনা মোনে নিয়া হুজুরে মংলার মায়রে কয়, ‘যা দেহি মা! হেগো বড়োঘরে গিয়া কয়টা জলচৌকি পাত গা তো! আমরা গিয়া হেই ঘরে বহি গা জুলেখারে লইয়া! অর কথাগিলি তো তরাতরি হোননের কাম গো!’
তার বাদে ইমাম হুজুরে জুলেখার মায়রে ফরমাইশ করে, ‘দেহেন গো লক্ষ্মী ! অহন খাওয়া-লয়ি কী করবেন, তরা কইরা শেষ করেন গো মা! জুলেখার বিষয়খান লইয়া কইলাম বহন লাগে আলা! মূল শোধন না দিয়া, হাত তুইল্লা বইয়া থাকোন কইলাম অনায্যি কাম হইবো গো!’
আর খাওয়া-লয়ি! গলা দিয়া একটা ভাতের নলা নি আর নামবো জুলেখার মায়ের! আগে সেয় হুইন্না লইবো মাইয়ার সর্বনাশের সগল বিত্তান্ত, হেশে ভাত খাইবো না পানি খাইবো—হেইটা বুঝ করবো নে কপাল-পোড়া মায়! তয়, মংলার মায় খাইলে খাইয়া লউক দুগা!
মংলার মায় কয়, তার খাওন লইয়া চিন্তার কাম নাই। হেয় এক ফাঁকে দুগা খুদ-ভাজা খাইয়া লইছে। ভাত তার অহন না খাইলেও চলবো! কিন্তুক জুলেখায় তো পাতে বহা! উয়ে খাওন শেষ কইরা লউক? মংলার মায়ে হুজুররে জিগায়।
‘না না! জুলেখায় যে কোনোমতে একটা দানা গিলে, এমুন অবস্থায় নাই! অরে হাত ধোয়াইয়া দেন গো মা-সগলেরা!’ হুজুরে মাতারিগো হাঁক দেয়।
জুলেখারে বহানের লেইগা ঘরের ভিতরে জায়গা করলে কী, মাইয়ায় সেইনে বইতে যায়ই না। সেয় কয়, সেয় উঠানের আমগাছ তলে বইবো। তার যা কওনের আছে, সেই কথার সগলই তারে কইতে হইবো আসমান-জমিন- বিরিক্ষি-বাতাস-পানি-চান্দ-সুরুজরে সাক্ষী কইরা! তার খসমে তারে এমুনই করতে কইয়া দিছে! মাথার কিরা দিয়া অইই করতে কইয়া দিছে সেয়! জুলেখায় নি সেই হুকুমের অমান্যি করতে পারে! জীয়ন্তে তা পারে না!
নিজের কোলের এই এট্টুক মাইয়ার মোখে এমুন পাকনা কথা নি সইজ্জ হয় মায়ের! কী কয়! কী কয় অই পয়মালের ছাওয়ে! বাপে জানে না, মায় জানলো না—বিয়া হইয়া গেলো! কে দিছে কার বিয়া! এমুন বেশরম বেলেহাজ ঢেমনি—ক্যামনে হইছে তার সেই দুধের ছাওয়ে! এইটা তার মাইয়ায় না! এইটা তার মাইয়ায় না!
জুলেখার মায়ে চিক্কুর দিয়া মাটিতে আছড়াইয়া পড়ে। এইটা কেটায় আইয়া হাজির হইছে তার জুলেখার ছুরত ধইরা! তার মাইয়ায় তো এমুন চশমখোর, নিলাজ আছিলো না! কোনোকালে আছিলো না। ও পাক পরোয়ার দীগার! এইটা কেটায়!
অখন, জুলেখার মায় যুদি এমনে চিক্কুর-ডিক্কুর দিয়া চলে, তাইলে সেই আওয়াজ পাইয়া এই ভিটিতে গেরামের মাইনষেরা আইয়া ভিড় বান্ধাইতে কতখোন! তহন, হইবো নি সর্বনাশ খান! সর্বলোকের সামোনে ভেদের কথা কইবোই বা কেমনে জুলেখায়; আর হুজুরে সেইটা দশ কানে দিতে দিবোই বা কেমনে!
মাইয়াটার মান-ইজ্জত বাঁচাইয়া তো চলোন লাগবো আগে! দশ লোকের সামোনে আদত কামের কাম দেহো গা কিছুই হইবো না। হইবো খালি আজাইরা পেঁচাল। হেইটা নি আর হইতে দেওন যায়! যায় না যায় না!
‘দেহেন গো মাতারি, ভালা করতাছেন না কিন্তুক কামটা!’ উতলা হইয়া ইমাম হুজুরে কঠিন গলায় খেজি দেয় জুলেখার মায়রে, ‘আপনের নাইলে মান-ইজ্জতের ঠেকা নাই, তিনকাল পার কইরা হালাইছেন আপনে। কিন্তুক এই মাইয়াটার কইলাম পুরা জিন্দিগি পইড়া রইছে! আগে আমরা কয়জোনে ঠান্ডা মাতায় হুনি অর গোমোরের কথাটি। হুনি, কেমনে কিয়ের তেনে কী হইছে! হুইন্না, নিজেরা ভাও মতোন বুঝ-বেবস্থাখান করি! খামাখা ঘরের কতা পরের কানে দেওনের লেইগা আপনে ফাল পাড়তাছেন ক্যান গো?’
হুজুরের কথা কানে যায় কী যায় না, জুলেখার মায় ধুছমুছাইয়া উইট্টা বয়। লগে লগে মোখের বিলাপরেও সেয় মোখের ভিতরে জাইত্তা মারে।
হায় হায় হায়! হুজুরের কতা তো এট্টুও মিছা না! মাইয়ার কলঙ্ক-কতা দশ কানে গেলে গেরামে তিষ্টানের নি আর কোনো উপায় থাকবো! জিদ্দের ঠেলায় সেয় করতাছিলো কী এইটা! এইটা নি কোনো সাব্যস্ত মাইনষের কাম! মাতা নষ্ট হইয়া গেছে তার! নাইলে এমুন আকাম সেয় করা ধরছিলো কোন হিসাবে!
হেগো মায়ে-ঝিয়েগো কতা আর কান্দনের আগা-মাথা কিছুই ধরতে পারে না মংলার মায়। কিন্তু সেয় দরকারের কামের বিষয়খান তো সগল সোমেই ঠায়ঠিক হালেই বোঝে। সেই বুঝ ধইরাই মংলার মায় জলচোকিটি সোন্দর মতোন আইন্না উঠানের আমগাছটার ছেমায় থোয়। কী মোনে কইরা জানি জুলেখাগো ছোটো হোগলার পাটিটাও একদিগের ছেমায় বিছায়। তার বাদে সেয় জুলেখারে তার হাতের ডেনায় ধইরা অস্তে অস্তে হাঁটাইয়া আইন্না খাড়া করায় আমগাছের তলে।
অখন, হুজুরে আলা যা কওনের কউক জুলেখারে!
‘মা গো জুলেখা! ঠান্ডা হালে বইয়া তোমার অন্তরের কতা কী কওনের আছে, কও আলা মা!’ ইমাম হুজুরে কয়।
‘ক! ক তুই আবাগী, ছার-কপালি মাইয়া! কিয়ের তেনে কী ঘটাইছস তুই!’ জুলেখার মায় ঘুসঘুসাইয়া কান্দতে কান্দতে মাইয়ারে কথা দিয়া বাড়ি মারা শুরু করে।
তার মাইয়ায় সেই কথার বাড়ি খাইতে খাইতে খাড়া হইয়া থাকে। খাড়া হইয়া থাকে সেয়, কিন্তু ভাবে মোনে হইতে থাকে য্যান সেয় সেয় মরার মাইনষের মতোন মাটিতে পড়া। চোখ তার খোলা, কিন্তু সেই চউখ য্যান কাছের দুনিয়ার কিছুই দেখতে পাইতাছে না!
মাইয়ার চউখ চাওন দিয়া থাকে তার সামোনের দিগে। সামোনে বহুত বহুত দূরে অই দেখা যায় আসমান! সেই আসমান কাইত হইয়া অই দেখা যায় নাইম্মা গেছে মাটির দিগে। কতোদূরে গেলে পাওয়া যাইবো সেই দেশ—যেইনে আসমানের কিনারা আইয়া জমিনেরে ধরছে! সেই দেশে যাওনের লেইগা হাঁটা ধরবো অখন জুলেখায়! যাওন ধরবো সেয় অখন সেইদিগে? সেইনে গেলে শান্তি পাইবো তার অন্তর? পাইবো?
জুলেখার পরানটা ক্যান জানি সেইনে যাওনের লেইগা ধড়াক-ফড়াক কইরা ওঠে। অনেক ধড়ফড়াইতে থাকে তার অন্তর। আর, তার হাত-পাওয়েরা কইতে থাকে যে; আর তারা খাড়া থাকতে পারতাছে না। আর পারতাছে না। আর পারবো না!
জুলেখায় তরাতরি ধুপ্পুর কইরা লেট দিয়া বইয়া পড়ে উঠানের খরখরা মাটিতেই। আছে উঠানে পাটি পাতা; থাকুক। সেই পাটিতে আর অখন জুলেখার দরকার নাই। আছে উঠানে জলচোকি রাখা; থাকুক। জুলেখার সেই আসনে কোনো কাম নাই। অখন তার আর পাটিই কী, মাটিই কী!
অইত্তো ইমাম হুজুরে বইয়া বার চাইতাছে তার ভেদের কতা হোনোনের লেইগা! অইত্তো জুলেখার মায়ে মাইয়ার চিন্তায় পরানের ভিতরে কতো লাজ-ঘিন লইয়া ঠাটার মরার লাহান পইড়া রইছে! হেগো তো অখন সগল ভেদের বিত্তান্ত কইয়া ঠান্ডা না করলেই না!
করবো। তাগো ঠান্ডা করবো জুলেখায়। সব কতা কইবো সেয়! কইবো কিয়ের তেনে কেমনে কী হইলো!
সাক্ষী থাকো রে জমিনের মাটি! সাক্ষী থাকো তুমি। আমি সগল ভেদের কথা লোকসগলের কানে দিতাছি।
সাক্ষী থাকো গো চৈতমাইস্যা বাতাস!
হেদিনও তোমাগোই সাক্ষী রাইক্ষা মায়ের মাইয়া এই জুলেখায় অচিন পন্থে পাও বাড়াইছিলো রে! সেই জুলেখায় অখন সেই কথা কইবো রে আসমান জমিন! কইবো তোমা গো সাক্ষী থুইয়া!
‘হোনেন হুজুর! মা গো! তুমিও হোন! হেই দিনকা, হেই চৈত মাইস্যা দিনে—আমি তো গেছি ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায়! গেছি তোমারে না কইয়া মা! তোমার চক্ষেরে ভেলকি দিয়া গেছি! তুমি তো রান্ধন ঘরে! ধরতেও পারো নাই তোমার কোলের ধনে কোন কাম করতে যাইতাছে! গেছি খালি ধুমাধুম কয়টা ডুব দিয়া আওনের লেইগা!’ জুলেখায় পাঁচ বচ্ছর আগের চৈতমাইস্যা হেই দোপোরের পরস্তাব কওয়া ধরে।
(চলবে)