ডুব
শিল্পের তুলাদণ্ডে কাহিনীর কার্নিশে ভুল!
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/11/01/photo-1509517972.jpg)
আপনি চলচ্চিত্র ভালো না বাসুন, না বুঝুন তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ‘চিরকুট’-এর গান ‘কার্নিশে ভুল অবেলা বকুল’ আপনাকে আপ্লুত করবেই। শারমিন সুলতানা সুমি লিখিত আহা রে জীবন, আহা জীবনের অনুরণন ভক্তের অন্তরে চলতেই থাকবে। এটা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সদ্য মুক্তি পাওয়া মুভি ‘ডুব’-এ ব্যবহৃত একমাত্র গান। কিন্তু ‘ডুব’ নিজেই নিজের জন্য একটা ভয়াল ফাঁদ সৃষ্টি করে রেখেছে। ভালো ছবি নির্মাণ করবেন আবার কাহিনীর কার্নিশে গলদ রাখবেন—এমন একূল-ওকূল ছুঁয়ে থাকবার নিয়তিই যেন ‘ডুব’ আখ্যানের প্রকৃত ভাগ্যলিপি। জীবন জানালার কার্নিশে অবেলায় সুঘ্রাত বকুল পড়ে থাকলে সেটা সবক্ষেত্রেই 'ভুল' হিসেবেই পরিগণিত হবে এমনটা নাও হতে পারে।
‘ডুব’ নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে সরব আলোচনা চলছে। যে বিতর্কের শুরু ছবি মুক্তির আগে থেকে তার নিদান তো ঘটেইনি, বরং আরো ডালপালা মেলেছে। তবে ফিল্মি এই আলোচনাটাই হয়তো একদিন বাংলা চলচ্চিত্রকে পথ দেখাবে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি মানেই আলাদা কিছু। একপক্ষ তাঁর চলচ্চিত্রকে বাতিলের খাতায় ফেলে রাখে। আরেকপক্ষ ফারুকীকে সানন্দে আন্তর্জাতিকমানের নির্মাতার তকমা দিয়ে দেয়। এই দুপক্ষকে একপাশে রেখে আমরা বলতে পারি, বাঙালিয়ানার শেকড়ের সন্ধান ফারুকী এখনো পাননি অথবা তিনি সন্ধান করতে সচেষ্ট হননি। কাজেই তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের ভাষা সর্বজনীন বাঙালি অনুধাবন করতে পারবেন এমন ভাবনার সময় এখনো আসেনি।
প্রাচ্যের খ্যাতিমান নির্মাতা সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রকে দেখেছেন এভাবেত, ‘অন্যান্য শিল্পের মতো চলচ্চিত্রের কোনো অব্যর্থ থিওরি বা ফরমুলা নেই। কাহিনী অনুযায়ী, পরিচালকের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী, চলচ্চিত্রের রীতি পাল্টাতে বাধ্য। একই কাহিনীর একই দৃশ্য বিভিন্ন পরিচালকের ভাষা প্রয়োগের রকমফেরে বিভিন্ন রূপ নেবে এটা বলাই বাহুল্য।’ এ অর্থেই ‘ডুব’ ফারুকীর ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র বটে, কিন্তু এর ভাষাটিতে তিনি পূর্বসূরি বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অথবা কিয়রোস্তামিদের শব্দভাণ্ডারই ব্যবহার করবার প্রয়াস পেয়েছেন।
ছবি তৈরির প্রধান তিনটি কাজ হলো চিত্রনাট্য রচনা, তদানুযায়ী পরিবেশ বাছাই বা নির্মাণ করে চরিত্রানুযায়ী লোক দিয়ে অভিনয় করিয়ে ছবি তোলা এবং চিত্রনাট্য অনুযায়ী সেসব ছবিকে গুছিয়ে সাজানো। এই তিনটি কাজের মধ্যে চিত্রনাট্য ছাড়া বাকি কাজগুলোতে ফারুকী খুব ভালোভাবেই উতরে গেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো চিত্রনাট্যে যদি খুঁত থাকে, তবে ছবির অঙ্গসৌষ্ঠবে তার প্রতিফলন পড়ে। মূলত সেই প্রতিফলনটুকুই ‘ডুব’-এর সমালোচনার আসল জায়গা।
‘ডুব’-এর সিনেমাটোগ্রাফিতে ইরানিয়ান কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়রোস্তামি কিংবা হালের আসগর ফরহাদী, রাশিয়ান তারকোভস্কির ছায়া খুঁজে পান বাঙালি চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। সংলাপে পরিমিতি রেখে শেখ রাজিবুল ইসলামের ক্যামেরাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করেছেন ফারুকী। নৈঃশব্দতা দিয়ে হাজার কথা অনুধাবন করানোর প্রয়াসও পেয়েছেন। কিন্তু দামি আসবাব কিংবা সেটের সামগ্রী অথবা পরিবেশের আর্টিস্টিক চিত্রকল্পকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকাংশে বাহুল্য নান্দনিকতার অতিশয়োক্তির সঙ্গে আপস করেছেন নির্মাতা। মূলত এটা হলো বাংলাদেশের আপামর সাধারণ দর্শকদের চলচ্চিত্র হয়ে ওঠবার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা। আপনি দেশের দর্শককে ম্যাচিওরড না করে উচ্চমার্গীয় চলচ্চিত্রের সমঝদার হতে বলতে পারেন না। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফারুকীর চলচ্চিত্র সাধারণের কাছে হয়ে যায় তথাকথিত ‘আর্টফিল্ম’ বা শ্লথগতির ‘টেলিফিল্ম’!
দেশি দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই চলচ্চিত্র অনেকটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ‘ডুব’ রাশিয়ার রাশিয়ার ৩৯তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কমেট সান জুরি প্রাইজ’ পেয়েছে। ছবির পোস্টার থেকে জানা যাচ্ছে, ‘ভ্যারাইটি’ পত্রিকা বলছে, ‘দরদি পরিচালকের দক্ষ হাতে বানানো ছবি। ইরফান খানের জাদুকরি অভিনয়ের পাশাপাশি বিশেষ করে বলতে হয় নুসরাত ইমরোজ তিশার কথা।’ ‘দ্য হলিউড রিপোর্টার’ বলছে, ‘ফারুকীর আগাগোড়া আধুনিক এই কাজটা দর্শকদের আচ্ছন্ন করে দেয়, গভীরভাবে ভাবায়।’ ‘স্ক্রিন ডেইলি’ লিখেছে, ‘মন্ত্রজালিক সিনেমাটোগ্রাফি। আবেগ উসকে দেওয়া সংগীত। বিশ্বমানের অভিনয়। পরম সংবেদনশীল পরিচালনা।’
ফারুকী ছবিটি নির্মাণকালেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, গল্পটি তৈরি হয়েছে পরিবারের প্রধান সদস্যের মৃত্যুর পরে দুটি পরিবারের অটুট বন্ধনের কাহিনী নিয়ে। যেখানে একজন মধ্যবয়স্ক লেখক এক তরুণীর প্রেমে পড়েন, যিনি তার মেয়ের বন্ধু। চলচ্চিত্রটির প্রধান ভাষ্য হচ্ছে যে, মৃত্যু সব সময় সবকিছু নিয়ে যায় না, অনেক সময় কিছু দিয়েও যায়।
সিনেমা মুক্তির আগে বেশিরভাগ পরিচালকই দর্শকদের আকর্ষণ বজায় রাখতে তাঁর গল্প অবমুক্ত করেন না। কিন্তু ফারুকী ‘ডুব’-এর কাহিনী নিয়ে বিস্তর জলঘোলা করেছেন। কখনো বলেছেন মৌলিক কাহিনী। আবার বলেছেন, লিজেন্ডারি ফিগার হুমায়ূন আহমেদের জীবন কাহিনী থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
এসব দেখে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ডের কাছে তাঁর লিখিত আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, ফারুকী কিন্তু একবারও কোথাও কোনো বক্তব্যে বলেননি, এই ছবির গল্পের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কোনো মিল নেই। এটা শুনলেও আমি বিশ্বাস করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তিনি সেটা স্পষ্ট করে বলছেন না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ফারুকী ঘটা করে বলে দিয়েছিলেন, আমার ছবি কোনো উপন্যাস, গল্প, কবিতা কিংবা জীবনীগ্রন্থ থেকে বানানো নয়। এটা একটা মৌলিক গল্প, যার প্রধান চরিত্রের নাম জাভেদ হাসান এবং এখানে মেহের আফরোজ শাওন নামে কোনো চরিত্র নেই।
অথচ সিনেমা হলে গিয়ে প্রত্যেকেই লেখক হূমায়ূন আহমেদ, শিলা, গুলতেকিন কিংবা শাওনকে খুঁজে ফিরেছি। এবং আমরা চলচ্চিত্র পুরোটা দেখেই বুঝে গেছি হুমায়ূন আহমেদের জীবনের খণ্ডিত একাংশ নিয়েই ফারুকী তাঁর কথিত মৌলিক গল্প সাজিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অগোছালো গল্পের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া মুভিটিতে আমরা কিছু খুঁজে পাইনি।
ফারুকী আসলে কার গল্প বলতে চাইলেন, গুলতেকিনের, শিলার, হুমায়ূন আহমেদের নাকি শাওনের? ডুবটা আসলে কার? শাওনরূপী পার্নো মিত্র তথা নিতুর, নাকি হুমায়ূনরূপী জাভেদ হাসান তথা ইরফান খানের। অসম প্রেমের যে সোশ্যাল ট্যাবু তা ভেঙে দিয়ে প্রাগ্রসর চিন্তক না হয়ে ফারুকী কেন আঁকড়ে থাকতে গেলেন প্রাচীনপন্থায়? আর সব বিরাগ ঢাললেন তিনি তরুণী প্রেমিকার ওপর। প্রেমের যদি দায় থাকে তা সবার আগে বয়সী পুরুষ মানুষটির। মুভিতে যিনি চলচ্চিত্রকার এবং যাপিত জীবনে অতি বিলাসী। যদিও বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিলাসী জীবন ও ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি পুরোদস্তুর বেমানান। মুভির তরুণী অভিনেত্রীর বয়স কম বলেই তিনি আবেগ দিয়ে চলবেন, এটা স্বাভাবিক। আর সেই আবেগটিকেই নেতিবাচকভাবে কাটাছেঁড়া করলেন নির্মাতা। সব আলো ফেললেন চলচ্চিত্রকারের কন্যারূপী সাবেরী তথা নুসরাত ইমরোজ তিশার ওপর। এটা কেন? তিশা সুঅভিনেত্রী এবং নির্মাতার স্বজন বলে? ফারুকীকে কালোত্তীর্ণ নির্মাতা হলে ‘তিশাপ্রীতি’ থেকে বেরিয়ে আসবার উপায়ও খুঁজতে হবে বৈকি।
‘ডুব’-এ নিতু যদি ভিলেন হন, তবে ভিলেনেরও একটা জীবনদর্শন উপস্থাপন করা চাই। দ্বন্দ্ব ও ক্লাইম্যাক্স থাকা চাই। অথচ মুভিতে নিতু হলো নির্মাতার যাচ্ছেতাই খেলার পুতুল। চাননি তাই তাকে গুরুত্বহীন করে রাখা হলো। অথচ ফারুকী হুমায়ূন কাহিনীই বর্ণনা করতে চাইলেন। শাওন যদি ভুল করে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদও সেই ভুলের সমান অংশীদার। বয়স ও প্রজ্ঞায় বড় বলে হুমায়ূনের দায় শাওনের চেয়ে বেশি। শাওনের গর্ভে জন্ম নেওয়া দুই পুত্র নিয়ে হুমায়ূন অসুখী ছিলেন, এমনটা কেউ বলতে পারবেন না। ফারুকী তাঁর মনগড়া গল্পে এসবই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। শুধু শাওনকে একহাত নেবেন বলে? রাগ-বিরাগ দিয়ে কি শিল্প হয়? জানা গল্পের প্রতি যেহেতু সমান সুবিচার করতে পারেননি ফারুকী, সেহেতু যথার্থ উপমা ‘কাহিনীর কার্নিশে ভুল’!
‘ডুব’ কি ট্র্যাজেডি? ট্র্যাজেডি প্রসঙ্গে মহামুণি অ্যারিস্টটল বলেছেন, ট্র্যাজেডি হলো একটি গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তনবিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ, ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণাত্মক নয়, নাটকীয়; আর এই ক্রিয়াভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্য দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলোর পরিশুদ্ধি ঘটায়’!
আমরা ‘ডুব’-এ অ্যারিস্টটল বর্ণিত তেমন কোনো বিমোক্ষণ পাইনি। একমাত্র সাবেরী ছাড়া কোনো একটি চরিত্রেরই ডিটেইলিং নেই। ঘটনা পরম্পরাও সুগ্রন্থিত নয়। সম্পর্কের টানাপড়েন কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিব্যক্তি দর্শককে খুব বেশি আবেগতাড়িতও করেছে বলে মনে হয়নি। আখ্যানটিকে পুরো ট্র্যাজিকমেডিও হয়ে ওঠেনি। বাল্যবন্ধু সাবেরী আর নিতুর মিলনটাও ঠিক স্পষ্ট নয়! এটার কারণ কি তবে এই যে, জানা কাহিনীর প্রতি নির্মাতা নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও সমান সংবেদনশীল থাকতে পারেননি সে জন্য?
পাশ্চাত্যের শিল্পবোদ্ধারা শিল্পকে আনন্দদানের বাহন হিসেবে বিবেচনা না করে মানবজীবনের একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। যদিও প্রাচ্যের শিল্পতাত্ত্বিক সেলিম আল দীন বলতেন শিল্পের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত মানুষকে আমোদিত বা বিনোদিত করা, তাই আখ্যানের শেষে সমাজ বা মানব হিতকর কোনো বিশেষ বার্তা দেওয়াটা জরুরি নয়।
যেকোনো শিল্পীরও লক্ষ থাকে ‘সাবলাইম’ তথা মহত্তম শিল্প বিনির্মাণের। আনন্দদানের মধ্য দিয়েই তাকে নিজস্ব মাধ্যমে মানবজীবনের গল্প বুনতে হয়। যে গল্পটি কারো জানা নেই এমন আখ্যান রচনার মাধ্যমে আনকোড়া জীবনবোধ উপস্থাপন করতে হয়। যার রস আস্বাদনে দর্শক বা স্রোতা নিজেও এক মহত্তম উপলব্ধি নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করেন; আর এটাই হয় শিল্পপদবাচ্য। জানা গল্পের বিশৃঙ্খল বুনন দিয়ে সেই মহত্তম শিল্পের সাধনা কি ফারুকীর সাজে? আমাদের আরো আলোচনা-সমালোচনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেইসব আলোচনার সারবত্তা থেকেই নির্নিত হবে ফারুকীর ‘ডুব’ কি চলচ্চিত্র শিল্পের উৎকর্ষতা নাকি নিমজ্জন!
তবু ‘ডুব’-এর নান্দনিকতা, সৌন্দর্য, সিনেমাটোগ্রাফি দর্শককে যারপরনাই মুগ্ধ করছে। ‘ব্যাচেলর’, ‘চড়ুইভাতি’, ‘টেলিভিশন’ কিংবা ‘পিঁপড়াবিদ্যা’কে নির্মাতা ছাড়িয়ে গেছেন। সমালোচনা সত্ত্বেও প্রশংসাও তাই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রাপ্য। মানবীয় সম্পর্ক, অসীম শূন্যতা, ব্যথাহীন জমে যাওয়া অভিমান, জলে ভাসা পদ্ম জীবনের যে গল্প নির্মাতা শোনালেন চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে তার শিল্পমূল্যও অপার।