জীবনানুসন্ধানী শাকুর মজিদ
শাকুর মজিদের পরিচয় অনেক। স্থপতি, নাট্যকার, ভ্রমণ কাহিনী রচয়িতা, তথ্যচিত্র নির্মাতা। আমার কাছে পরিচয় আমার বন্ধু। আজ তাঁর জন্মদিন। শাকুরের সাথে পরিচয় ১২ বছর আগে, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের আরও আগেই পরিচয় ছিল। হয়তো দেখা হয়নি, কিন্তু আমরা ছিলাম কাছাকাছিই। দয়াহীন, মায়াহীন, কানাগলির পরিচয়হীন, বিত্তহীন আমরা দু’জন প্রায় একই সময়ে মানুষের সন্ধান করেছি, মানুষ হওয়ার লড়াই করেছি।
লড়াই করে শাকুর বুয়েটের মতো বেশি মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, আমি তার এক বছর সিনিয়র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করেছি। প্রাইভেট টিউশন, সাংবাদিকতা করে চলতে হয়েছে আমাদের দুজনকেই। কিন্তু মেধার মতো শাকুরের সৃষ্টশীলতাও ছিল অনেক বেশি, অনেক বেশি গোছানোও তিনি। তাই খুব স্বল্প সময়েই একের পর এক সাড়া জাড়ানো সৃষ্টি করে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের আলোচিত হয়েছেন।
সমান তালে চলেছে সাহিত্যযাত্রা এবং স্থপতির পেশা। ভ্রমণ কাহিনীতে তার সমকক্ষ এখন আর কেউ এ দেশে আছে বলে জানা নেই এবং এই পরিচয়ের বহু স্বীকৃতিও আছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, শাকুরের বড় অবদান বাংলাদেশের লোক সাহিত্যের গভীরতাকে বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে আসা। বাউল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে তাঁর ‘মহাজনের নাও’ সেই অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়। নতুন করে করেছেন হাসন রাজাকে নিয়ে। আর লালনের কাছে গিয়েছেন বারবার।
ছোটবেলা কেটেছে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার মাথিউরা গ্রামে। ১২-১৩ বছর বয়সে বিদ্যুৎবিহীন, কাঁচা রাস্তাঘাটের গ্রাম ছেড়ে ঝা চকচকে ক্যাডেট কলেজে। সামরিক কায়দা, ব্রিটিশ সিস্টেমের এই পড়ালেখা করেও শাকুর সেনানিবাসের বাসিন্দা হননি। আবার স্থাপত্যের ছাত্র হয়েও লেখালেখি ছাড়েননি, যার উন্মেষ ঘটেছিল ছোটবেলাতেই। মাত্র ২০ বছর বয়সেই লিখেছিলেন ‘যাহা করো রে বান্দা আপনার লাগিয়া’ নামের এক নাটক।
এই লেখায় শাকুরের জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরছি না। চেষ্টা করছি তাঁর চোখ দিয়ে দেখতে, লেখকরা সমাজকে কীভাবে দেখেন, কীভাবে অনুসন্ধান করেন। ভালো লেখক আসলে ভালো পাঠক। ব্যাপক ভিত্তিক পড়ালেখা শুধু নয়, শাকুরের মনে রাখার ক্ষমতা আসীম। লেখা যদি সাধনা হয়, তবে তাতে নিরন্তর স্বতঃর্স্ফূতভাবে লেগে থাকার, জীবনকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করার, লেখাকে ভালোবেসে পথচলার দৃষ্টান্ত তিনি। বাস্তববাদী, সংবেদনশীল, পরিশ্রমী লেখককে প্ল্যাটফর্মটা নিজেই তৈরি করতে হয়, যেটা তিনি করতে পেরেছেন।
একজন লেখক জীবনের সুখ-দুঃখ, চড়াই-উৎরাই, সফলতা-ব্যর্থতা থেকে সাহিত্যের রস সংগ্রহ করেন। চলমান সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজকে তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি বুঝতে পারেন। সমাজের বিভিন্ন ধর্ম ও পেশার মানুষের সম্পর্কে তিনি জ্ঞান রাখেন। ক্যাডেট কলেজের জীবন নিয়ে লেখা বইটি খেয়ালি, অনিশ্চিত কিশোর বয়সের ভাবনা, আর যুবক বয়সে প্রেমের, আলস্যের, দীর্ঘসূত্রতার হরেকরকম বই আছে তাঁর। এই বই পড়ার দুনিয়াটা আমাদের ছিল এবং আমাদের প্রজন্ম বারে বারে দেখেছে জীবন আর জীবিকার মিলমিশ হওয়া-না-হওয়ার বিচিত্র সব কাহিনী। এসবই কাউকে সাহিত্যিক করেছে, কাউকে গণমাধ্যমকর্মী।
ক্যাডেট কলেজ জীবনের বাল্যকাল অনেক নির্দয়, কিন্তু সহপাঠীদের দৌরাত্ম্যে নিজেকে বিনষ্ট হতে দেননি শাকুর। আর দেননি বলেই ভ্রমণ কাহিনীর পাশাপাশি ছুটেছেন লালনের কাছে, বাউল করিমের কাছে, হাসনজানের সন্ধানে, হুমায়ুন আহমেদের আড্ডায়। বন্ধুদের আড্ডায় দেখা শাকুরকে দেখলে বোঝা যায় কালো ফ্রেমের চশমার নিচে এক জোড়া সন্ধানী চোখ। কাউকে ইমপ্রেস করার কোনো দায় নেই তার। স্বচ্ছন্দ, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সন্ধান করেন যা তিনি চান, তা সে বাংলার লোক সাহিত্য, সঙ্গীত কিংবা লেচ ওয়ালেসার বাড়ি হোক।
তাই এই দৃষ্টি থেকেই যা লিখছেন তা এক্কেবারে আলাদা। নিজে ভালো আলোকচিত্রী। করিম বা হাসনরাজার নাটকে মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় পাক্কা আলোকচিত্রীর মতোই মাপছেন মানুষের চরিত্রের অতি সূক্ষ্ম খামখেয়াল। দ্বন্দ্ব সম্পর্কে অকপটে বলতে পারেন তিনি। তাই হাসনরাজার জমিদারির কথা যেমন বলেন, তেমনি তার জীবনের প্রেম, সঙ্গীত, জীবনের বিলাশ যে একেবারে নির্দোষ ছিল না তা-ও উঠে আসে। মানুষ ও সমাজের প্রতি দরদ, আর তা থেকেই সুর ও বাণীর মহিমায় শাহ আব্দুল করিম বা লালনের জীবনানুসন্ধান।
কী খাব, কী পরব, সেটা দর্শন-ভাবনা নয়। কিন্তু খাওয়া-পরা থেকে কী করে ন্যায়ের কথা ভাবতে পারি, প্রাণ, আশা, স্মৃতি, আকাশ, তেজের কথা বলি সেই আত্মবিচারই দর্শন। সত্যিকারের লেখক মানুষের এক বৃহৎ রূপকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে, ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে মুক্ত করে বৃহৎ মঙ্গলের দিকে ধাবিত করে। কিন্তু আমাদের মাঝে কত বিরোধ! আর কত আঘাত, কত ক্ষুদ্রতাকে জাগিয়ে তুলে রাজনীতির মতো সাহিত্যাঙ্গনকেও দখলের সংস্কৃতিতে পরিণত করেছি আমরা ! বিশেষ গোষ্ঠীর গণ্ডি, সংকীর্ণতার বাইরে নিজেকে নিতে পারা এই সমাজে সহজ নয়। রাজনীতির ময়দানের মতো এখানেও যে গ্রুপিংবাজরা আছে তা নেশা বা মাদকের মতো, লেখকের যুক্তিবোধ ও বোধশক্তিকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
আমার মনে হয়েছে শাকুর প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থেকেছেন সহিষ্ণুতার পথে চলতে। মুক্ত ভাবনা ও যুক্তির সংস্কৃতিতেই তাঁর আস্থা, তাঁর ভাবনা। যা বিশ্বাস করছেন তাই বলছেন এবং আগামীতেও বলবেন।