‘মণিহারা’ : ঠাকুর ও রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মণিহারা’ গল্পটি যেমন বহুল পঠিত, তেমনি সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মণিহারা’ও বহুবার প্রদর্শিত। এই দুই সৃষ্টির রাজনৈতিক তফাত নির্দেশ, দুই প্রধান চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ ও শেষে নোক্তা আকারে ঠাকুরের নারী ভাবনা-এই ত্রয়ীকে দিয়েই সাজানো হয়েছে বর্তমান রচনা। ভূমিকা দীর্ঘ না করে আমাদের নাতিদীর্ঘ আলাপ শুরু করা যাক।
‘মণিহারা’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছেন উত্তম পুরুষে, এই পুরুষটি আর কেউ নয়, ফণিভূষণের ভূত। যদিও কৌশলে ভূতের গল্পটি আমরা শুনি ইশকুলমাস্টারের মুখে। মানে মাস্টারই ভূতকে ভূতের গল্প শোনায়। আর চলচ্চিত্রে আমরা প্রথম থেকেই পাই ইশকুলমাস্টারকে, সেখানে ভূত ফণিভূষণের প্রবেশ পরে ঘটে। এটি একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ঠাকুর আমাদের এই গল্পে প্রবেশ করান ভূতের হাত ধরিয়ে, আর রায় আমাদের গল্পে টেনে নিয়ে যান একজন শিক্ষকের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রের ভাষায় পিওভি বা পয়েন্ট অব ভিশন ঠাকুরে একরকম, রায়ে অন্য রকম। যাঁরা গল্পটি পড়েছেন এবং চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন ভূত ওরফে ফণিভূষণ একজন নব্য ধনী আর ইশকুলমাস্টার নিম্ন মধ্যবিত্ত। চট করে এই মাস্টারের সম্পর্কে ঠাকুরের ভাষ্যটা শুনে নিলে পরে কাজে দেবে-
“ভদ্রলোকটি স্বল্পাহারশীর্ণ, ভাগ্যলক্ষ্মী কর্তৃক নিতান্ত অনাদৃত। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদেশি চক্রের যেমন একরকম বহুকালজীর্ণ সংস্কারবিহীন চেহারা, ইঁহারাও সেইরূপ। ধুতির উপরে একখানি মলিন তৈলাক্ত আসামী মটকার বোতাম-খোলা চাপকান...”
ইশকুলমাস্টার সম্পর্কে এই পর্যবেক্ষণ ভূত ফণিভূষণের। গল্পের গোড়াতেই আমরা এই পর্যবেক্ষণ পাই। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ইস্কুলমাস্টারের সামাজিক মর্যাদা কী আর তাঁর প্রতি ভূতের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বা কেমন। আমরা মানে পাঠক বা দর্শক প্রথমে যার হাত ধরে গল্পে প্রবেশ করি, তার সাথেই নিজেকে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করি বা আইডেন্টিফাই করি। গল্পের শুরু থেকেই উত্তম পুরুষে ‘আমি’, ‘আমি’ করে ফণিভূষণ ওরফে ভূত কাহিনীর সঙ্গে আমাদের জড়িয়ে ফেলতে থাকে। চলচ্চিত্রে এই চিত্র আমরা পাই না। কাজেই দেখা যাচ্ছে দুই ধরনের ডিসকোর্স বা বয়ান দাঁড়া হচ্ছে দুই মাধ্যমে। সাহিত্যে পাচ্ছি ভূতের ডিসকোর্স আর চলচ্চিত্রে ইশকুলমাস্টারের। ঠাকুর জোর দিচ্ছেন ভূতের ওপর আর রায় জোর দিচ্ছেন মাস্টারে।
তো এই দুই ডিসকোর্স থেকে আমরা কোন ধরনের সত্য পাচ্ছি? ফরাসি মনোবিশ্লেষক ও দার্শনিক জাক লাকাঁ ডিসকোর্সের একটি কাঠামোর কথা বলেছেন ১৯৭৫ সালে, যা পরে প্রকাশ পায় লাকাঁর বিংশতম বক্তৃতা সংকলনে। সেখান থেকে ধার নিয়ে যদি ‘মণিহারা’ গল্পের ভূত ও চলচ্চিত্রের মাস্টারের দুই বয়ান বা ডিসকোর্সের একটি কাঠামো দাঁড় করাই, মন্দ হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে ভূতের ডিসকোর্স:
ভূত ---> পাঠক
সত্য গল্প
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে ইশকুলমাস্টারের ডিসকোর্স :
মাস্টার ---> দর্শক
সত্য গল্প
এখন দুজনের ডিসকোর্স বা বয়ানে আমরা দুই রকম বাস্তবতা পাই। স্বভাবতই ভূতের ডিসকোর্সের সত্য আর মাস্টারের ডিসকোর্সের সত্য এক নয়। এদের গল্পটা আপাত এক হলেও ভিন্নতাও আছে। একটু পরই সেই ভিন্নতা নিয়ে আমরা আলাপ করব। বিষয়টিকে আরো নির্দিষ্ট করে বললে সুবিধা হয়। ভূতের ডিসকোর্সকে আমরা ধরি ঠাকুরের বয়ান, অপরদিকে ইশকুলমাস্টারের ডিসকোর্সকে আমরা ধরি রায়ের বয়ান। ঠাকুর একরকম সত্যকে ধারণ করে একভাবে গল্পটি বলেছেন পাঠককে, রায় ইশকুলমাস্টারকে সম্বল করে ভিন্ন সত্য হাজির করেছেন দর্শকের সামনে, গল্পটিও বলেছেন একটু আলাদা করে।
এখন পাঠক বা দর্শকের কাছে দুই স্রষ্টা কোনো সত্য নিয়ে হাজির হয়েছেন এবং কেন, এই প্রশ্নের সুরাহা করাটা জরুরি। এর মাধ্যমেই আমরা ঠাকুর ও রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
১
আগেই বলেছি পার্থক্য রয়েছে গল্প ও চলচ্চিত্রে। ঠাকুরের বয়ান থেকে আলোর প্রতিসরণের মতো বেকে গিয়ে একই গল্প ভিন্ন ঢঙে শুনিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রতিসরণ কোথায় ঘটেছে? যেমন গল্পে মণিমালিকার দূর সম্পর্কের আত্মীয় মধুসূদন আগে থেকেই নিযুক্ত ছিলেন স্বামী ফণিভূষণের ব্যবসায়িক কর্মে। আর চলচ্চিত্রে দেখা যায় মধু গ্রাম থেকে এসেছে কাজের খোঁজে মণির কাছে। বেকারত্ব নির্দেশ করছেন সত্যজিৎ? ঠাকুরের গল্পে তো মধুকে বেকার দেখা যায় না? বরং সেখানে সে ফণিভূষণের কুঠিতে গোমস্তার অধীনে কর্মরত।
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ আবার মণির সঙ্গে মধুর পূর্বসম্পর্কের দিকেও একটু ইঙ্গিত করেছেন। মধুর প্রবেশ দৃশ্যে দেখা যায়, মণি ক্ষোভ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে, সে কেন এখানে এসেছে? মধু বলে, কাজ প্রয়োজন, তাই তার কাছে আসা। বিরক্ত হয় মণিমালিকা, ধমকের সুরে বলে ত্রিসীমানায় যেন তাকে আর দেখা না যায়। এমন উত্তপ্ত সংলাপ বিনিময়ের মাঝেই ফুলের কাঁটা বিঁধে মণির আঙুলে। প্রেমের কাঁটা বলে একটি কথা তো বাংলাতেই প্রচলিত আছে। তবে এমন কোনো সম্পর্কের দিকে যাননি রবিঠাকুর।
আরো একটি পার্থক্য হলো ফণিভূষণের ব্যবসা সংক্রান্ত। গল্পে ফণি হরীতকী, রেশমের গুটি এবং কাঠের ব্যবসা করেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে ফণি করেন পাটের ব্যবসা।
গল্পে দেখা যায়, রাচি থেকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য ফণিভূষণ সস্ত্রীক নদীতীরের ভবনে থাকতে শুরু করেছেন। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, এই দম্পতি এসেছেন কলকাতা থেকে এবং সেটা ফণির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মণির বনিবনা না হওয়ায়। যেহেতু ১০ বছরেও মা হতে পারেনি মণি, তাই শ্বশুড়বাড়ির লোকজন কথা শুনাচ্ছিল তাকে। এমন কাহিনীই দেখা যায় বড়পর্দায়।
আর এভাবেই ঠাকুরের গল্প থেকে একটু একটু করে বেঁকে গেছেন রায়। তাই বলছি, দুজনের বয়ানে গল্পটি হুবহু এক নয়, সত্যটিও আলাদা।
২
গল্পে এবং চলচ্চিত্রে দুই জায়গাতেই আমরা দেখেছি যে মণির স্বামী ফণি নব্য পুঁজিপতি বা ধনিকশ্রেণীর প্রতিনিধি। এবং সে স্ত্রীকে ভালোবাসে, স্ত্রীর ওপর জোর করে না, তাদের মানসিক দূরত্বের কথাও আমাদের অজানা থাকে না। অন্যদিকে মণি হলো নব্য ধনীর স্ত্রী, সে না চাইতেই অলংকার পেয়ে যায়। চলচ্চিত্রে দেখি, একা গুনগুন করে গান গাওয়ার পুরস্কার হিসেবেও স্বামীর কাছ থেকে স্বর্ণালংকার পেয়ে যায় মণি। এতেই বোঝা যায়, কীভাবে ভরে উঠেছিল মণির গয়নার বাক্সটি।
কাহিনীর একপর্যায়ে দেখা যায়, ধারদেনা থাকায় বাজারে নতুন কাঁচা টাকা দেখানোর প্রয়োজন পড়ে ফণিভূষণের। চলচ্চিত্রে অবশ্য পাট পুড়ে যাওয়ার ঘটনা দেখি আমরা। যাই হোক, সে সময় নগদ অর্থ পাওয়া খুব সহজ ছিল না। কাজেই স্ত্রী মণি সন্দেহ করে, স্বামী বোধহয় তার গহনার দিকেই হাত বাড়াবে এবং অর্থের ব্যবস্থা করতে না পেরে কেড়ে নেবে। গল্পে এই ধারণার পালে হাওয়া দেয় মণির দূর সম্পর্কের ভাই মধু। তবে স্বর্ণালংকার কেড়ে নেওয়ার কোনো মানসিকতাই ফণির ছিল না। তারপরও এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মণি বাপের বাড়ি পাড়ি জমায়, গহনাসমেত, মন্ত্রদাতা মধুর সঙ্গে। ঘটনা বুঝতে বাকি থাকে না, পথেই মৃত্যুকে বরণ করতে হয় মণির। এবং সন্দেহের তীর ঘুরে যায় মধুর দিকেই। এই গোয়েন্দাগিরিতে আমরা যাব না, আমাদের প্রশ্ন হলো, মণির কাছে গয়না এত প্রিয় হয়ে উঠল কেন?
ফ্যাটিসিজম অব কমোডিটি বা পণ্যপূজা ব্যাখ্যার ছলে স্বর্ণজাতীয় পদার্থের প্রতি মানুষের লোভ ও এসব পণ্যের রহস্যজনক আচরণ, সেটার সঙ্গে সমাজের নানা স্তরের মানুষের সম্পর্ক নিয়ে কার্ল মার্কস অবশ্য কথা বলেছেন পুঁজির প্রথম খণ্ডেই। পণ্যের রহস্যময় হয়ে ওঠা কিন্তু পণ্যের গুণে নয়, সেটা হয় মানুষের গুণেই। একটু ভিন্ন দিক থেকে একই কথা বলার চেষ্টা করেছেন, আরেক মহাত্মা জাক লাকাঁ। তিনি বলছেন, মানুষ কখনোই নিজের বাসনার পিছ ছাড়ে না। মানুষই এই বাসনার নির্মাতা।
১৯৫৬-৫৭ সালের সেমিনারে লাকাঁ ফেটিশ অবজেক্ট ও ফোবিক অবজেক্টের ভেতরকার পার্থক্য ব্যাখ্যা করেন। লাকাঁ মনে করেন, ফ্যালাস না থাকার শূন্য অনুভূতিতে সিম্বলিক সাবস্টিটিউট বা আকারগত প্রতিস্থাপন হয় ফ্যাটিশের, পড়তে পারেন গহনার। মণির অলংকারই হলো সেই ফ্যাটিশ। ফ্যালাস বলতে এখানে আমরা পেনিস নয় বরং বুঝব স্বাধীন নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মণি ভালো করেই জানে, সে ব্যবসায়ী নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার নেই, অর্থাৎ সে উপার্জন করে না। ফলে তার একমাত্র সম্বল ঐ স্বর্ণালংকার। ভুলে গেলে চলবে না, মণি নিঃসন্তানও বটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বিষয়টিকে চমৎকার করে ব্যাখ্যা করেছেন :
“সংসারে তাহার (মণির) সন্তান নাই; স্বামী আছে বটে কিন্তু স্বামীর অস্তিত্ব সে অন্তরের মধ্যে অনুভব করে না, অতএব যাহা তাহার একমাত্র যত্নের ধন, যাহা তাহার ছেলের মতো ক্রমে ক্রমে বৎসরে বৎসরে বাড়িয়া উঠিতেছে, যাহা রূপকমাত্র নহে, যাহা প্রকৃতই সোনা, যাহা মানিক, যাহা বক্ষের, যাহা কণ্ঠের, যাহা মাথার- সেই অনেক দিনের অনেক সাধের সামগ্রী এক মুহূর্তেই ব্যবসায়ের অতলস্পর্শ গহ্বরের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে, ইহা কল্পনা করিয়া তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া আসিল।”
ঠাকুর ওপরের বর্ণনা থেকে আমরা দেখি সোনাদানা হচ্ছে মণির কাছে ‘একমাত্র যত্নের ধন’, এখন এই ‘ধন’ শব্দটি বাংলা ভাষায় দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়, চমৎকার এই মেটাফোরের সঙ্গে আপনি যদি ফ্যালাসের যোগ খোঁজেন তো বলতে হবে আপনি ঠিক পথেই এগুচ্ছেন। সোনাদানা হচ্ছে মণির কাছে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার সমান, তার নিজের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। যেহেতু সে উপার্জনক্ষম নয় তাই অনিশ্চয়তা রয়েছে তার জীবনে আর এই অনিশ্চয়তাই হলো ফ্যালাসের না থাকার অনুভূতি, এজন্যই শূন্যস্থানটি পূরণ করে নেয় গহনার মতো ফ্যাটিশ অবজেক্ট। এ কারণেই মণির ফেটিসিজম কাজ করে গহনার প্রতি। এ কারণেই গহনাকে অন্য সব কিছুর চাইতেও নিজের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে মণি।
কিছুক্ষণ আগেই আমরা বলছিলাম, লাকাঁ জরুরি বিভেদরেখা টেনেছেন ফ্যাটিশ অবজেক্ট বা জীবনধারণের জন্য অপ্রয়োজনীয় পূজনীয় বস্তু এবং ফোবিক অবজেক্ট বা ভীতিকর বস্তুর ভেতর। লাকাঁর মনোবিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পারি, সিম্বলিক ক্যাসট্রেশন বা আকারের জগতে কর্তন হলে সেটা সাকারে বদলি বস্তু বা ইমাজিনারি সাবস্টিটিউট হয় ফোবিক অবজেক্ট বা ভীতিকর বস্তু।
গল্পের ফণিভূষণের কাছে এই ক্যাসট্রেশন বা কর্তন হলো ব্যবসায়িক ক্ষতি। সিম্বলিক অর্ডারে বা আকারের দুনিয়ায় নিয়মকানুন মেনে, ধারদেনা ইত্যাদি সামলেই ব্যবসা করতে হয় ফণিভূষণের। এখন এই আকারের দুনিয়ায় যদি তার ক্ষতি হয়, সেটা এক অর্থে একটুখানি চামড়া কেটে ফেলার মতোই বেদনার সঞ্চার করে, আর একেই আমরা বলছি কর্তন। অর্থকড়ি হারিয়ে ফণি যখন কর্তিত, তখন সেখানে ফোবিক অবজেক্ট হিসেবে হাজির হয় দারিদ্র্য। অর্থাৎ সে তো পথে বসতে চায় না। পথে বসতে হতে পারে- এমন আশঙ্কাই ফণির কাছে ভীতিকর, এটাকেই বলছি ফোবিক অবজেক্ট। আবারও ফেরা যাক সেই মেটাফর বা রূপান্তরে, শব্দটি হলো ‘ধন’। ফণির যখন ব্যবসায়িক ক্ষতি হলো, ধরুন চলচ্চিত্রে যে পাট পুড়ে ছাই, তখন তো আক্ষরিক অর্থেই ধনসম্পদে কর্তন হলো মানে ক্যাসট্রেশন, এ থেকে তার ভয় চেপে বসল এবং স্ত্রীর গহনা চাইবে কি চাইবে না এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। তখন ফণির সাকারে মনির ফ্যাটিশই হয়ে উঠছে ‘ধন’। কিন্তু না এই ‘ধন’ মণি দেবে না, কারণ এই ‘ধন’ মণির কাছে ফ্যালাস বা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, এটাকে সে ছাড়তে নারাজ। ঘটনার পরম্পরায় মণির ভবিষ্যৎ কী হয় সেটা আমরা জানতে পারি, ভূত হয়ে যায় সে। এরপর ফণির কাছে ফিরে আসে। চলচ্চিত্রে দেখি গয়নার লোভেই ফিরে আসছে মণি আর গল্পে সেরকম কোনো ব্যাখ্যা আমরা দেখি না, তবে অদৃশ্য মায়াজালে ফণিকে নদীর জলে ডুবিয়ে দেয় সে। এরপর ফণিও পরিণত হয় ভূতে। চলচ্চিত্রে মণি ভূতের ফ্যাটিশের প্রতি আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমে না। আর গল্পে কি মণি ভূত বুঝতে পেরেছিল ফণিই তার ফ্যালাস, আসল নিশ্চয়তা? যাই হোক, এই হলো মোটামুটি ‘মণিহারা’র মূল গল্প। এবার আসা যাক শেষ অঙ্কে।
৩
গল্পের একেবারে শেষে ইশকুলমাস্টার যখন বলে সে এই ভূতের গল্প বিশ্বাস করে না। যদিও গল্পটা সেই বলেছে। তারপরও সে এই গপ্প বিশ্বাস করে না। ফণি তখন উত্তরে বলে সেই ফণিভূষণ। এ কথা শুনে “ইশকুলমাস্টার কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া কহিলেন, ‘আমি তাহা হইলে ঠিকই অনুমান করিয়াছিলাম। আপনার স্ত্রীর নাম কী ছিল’।” ফণি উত্তরে বলল, ‘নৃত্যকালী।’
ইশকুলমাস্টার যে কিছুমাত্র লজ্জিত হল না, এই কথা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ধাঁধা তৈরির চেষ্টা করেছেন। পাঠক ভাবতে পারেন এই ইশকুলমাস্টার আসলে বোকা, সে ফণির ভূতকে চিনতেই পারেনি তাই ইয়ার্কি মারছে। আবার এটা হতে পারে লোকটি নিজেকে মিথ্যা ফণিভূষণ বলে জাহির করছে। আমরা তো জানি, শিবের আরেক নাম ফণিভূষণ, তো তার স্ত্রী তো নৃত্যকালী হতেই পারে। গল্পের এই টোনটি ইয়ার্কি মারছে ধরনের হলেও ধাঁধার মধ্যে পড়তে হয় পাঠককে। ভূত থেকে শেষপর্যন্ত দেবদেবীতে এসে থামেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অন্যদিকে, সত্যজিতের ইশকুলমাস্টার যার সাথে কথা বলে সে সত্যি সত্যিই ফণির ভূত ছিল, কারণ শেষে তাকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখা যায় আর ইশকুলমাস্টারও বিষয়টি বিশ্বাস করে এবং লজ্জিত না হয়ে বরং ভীত হয়ে কাহিনী লেখার খাতা ও গঞ্জিকা সেবনের কল্কে ফেলে পড়িমরি করে এক দৌড় দেয়।
ঠাকুরের বয়ান শুরু হয় ফণি নামের নব্য ধনীর বর্ণনা দিয়ে, শেষও হয় তার সংলাপ দিয়ে। নয়া বুর্জোয়া ফণি গল্পের “স্বল্পাহারশীর্ণ” ইশকুলমাস্টারের সঙ্গে যেন ইয়ার্কির ঢঙে কথা বলছে। আবার শেষে যখন বলে তার স্ত্রী নিত্যকালী, তখন মনে হয় এই বুঝি ঘাড় মটকে দেবে “ভাগ্যলক্ষ্মী কর্তৃক নিতান্ত অনাদৃত” ইশকুলমাস্টারটিকে। সে রকম অবশ্য কিছু হয় না। তবে একটা কটাক্ষ বা চোখ রাঙানি থাকে।
সত্যজিৎ রায়ের বয়ানে শেষ পর্যন্ত ফণি ভূত সাব্যস্ত, এবং ইশকুলমাস্টার তাকে ভয় পেয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সত্যজিতের এই ফণি ভূত ১৯৬১ সালের, ততদিনে বুর্জোয়াদের প্রগতিশীলতা আর অবশিষ্ট নেই, আছে শুধু কঙ্কাল, এই কঙ্কাল ভূত মুনাফার অশ্বে সওয়ার হয়ে কতল করছে সাধারণ, ‘স্বল্পাহারশীর্ণ’ মানুষের সুস্থির জীবন, অবিরত তাই তারা ছুটছে আর ছুটছে, অভাব অনটন পিছু ছাড়ছে না। পুঁজিবাদের এই কুৎসিত ভয়ঙ্কর রূপ আমরা দেখি সত্যজিতের বয়ানে। কীভাবে? মণি যেমন নিজের ফ্যাটিশ স্বর্ণালংকার ছেড়ে যেতে পারে না, তেমনি নিজের অট্টালিকা ছেড়েও ফণি চলে যেতে পারছে না, সে অশরীরী হয়ে নিজের সম্পত্তিকে আগলে রাখতে চাইছে, হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে সে জীবিতকালের আঙিনায়। সত্যজিৎ এই একসময়কার এই নব্য ধনীকে ভূত সাব্যস্ত করে নিজে অথবা দর্শককে ওই সাধারণ ইশকুলমাস্টারের কাতারেই দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন যেন। ঠাকুর যেখানে নব্য ধনীর মুখ দিয়ে ‘নৃত্যকালী’র ভয় দেখাচ্ছে, তখন রায় ফণিকে ভূত বলে প্রমাণ করছে এবং ইশকুলমাস্টারকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে দেখাচ্ছে। এটা কি পরিষ্কার নয়, ঠাকুর জমিদারের ছেলে আর রায় ওই গল্প লেখক ইশকুলমাস্টারের মতোই সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্র? মার্কসের সেই বিখ্যাত কথা আমরা কে না জানি, দুনিয়া বিভক্ত দুই ভাগে, একভাগ শোষিত আর অন্যভাগ শোষক। ঠাকুরের বয়ান শেষতক শোষক ফণির দিকেই ঝুঁকে থাকে। আর সত্যজিতের বয়ান দেখা যায় উল্টোদিকে, শোষিতের পক্ষে।
‘মণিহারা’ গল্পে ফণিভূষণ ও ইশকুলমাস্টার কি পর্যায়ক্রমে শোষক ও শোষিতেরই প্রতিভূ নয়?
৪
গল্প ও চলচ্চিত্রে নারী সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা নিয়ে দু-চার কথা না বললেই নয়। গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফণিকে স্ত্রীর প্রতি বেশ সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, স্ত্রীকে সম্মান করে চলা, স্ত্রীর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং স্ত্রীকে খুশি রাখাই ফণির ধর্ম, এমনটাই দেখানো হয়েছে। চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে সত্যজিৎ ইশকুলমাস্টারের মুখ দিয়েই বলাচ্ছেন ফণি নরমসরম ‘কলাগাছের’ মতো ছিল বলেই স্ত্রী তাকে বিশেষ ভালোবাসে নাই। ঠাকুরের ভাষায় :
“যাহার যা প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা সেটার চর্চা না করিলে সে সুখী হয় না। শিঙে শান দিবার জন্য হরিণ শক্ত গাছের গুঁড়ি খোঁজে, কলাগাছে তাহার শিং ঘষিবার সুখ হয় না। নরনারীর ভেদ হইয়া অবধি স্ত্রীলোক দুরন্তপুরুষকে নানা কৌশলে ভুলাইয়া বশ করিবার বিদ্যা চর্চা করিয়া আসিতেছে। যে স্বামী আপনি বশ হইয়া বসিয়া থাকে তাহার স্ত্রী-বেচারা একেবারেই বেকার, সে তাহার মাতামহীদের নিকট হইতে শতলক্ষ বৎসরের শান-দেওয়া যে উজ্জ্বল বরুণাস্ত্র, অগ্নিবাণ ও নাগপাশবন্ধনগুলি পাইয়াছিল তাহা সমস্ত নিষ্ফল হইয়া যায়।”
ভূতের কাহিনীর আড়ালে রবীন্দ্রনাথ যেন পুরুষদের মন্ত্রণা দিলেন- একটু অধিকার চর্চা করার, স্ত্রীর ওপর। মন্ত্রণা না আক্ষেপ? তো ঠাকুর আক্ষেপই করুন অথবা যে পরামর্শই দেন না কেন, সেটা আমরা আর এখানে বিশদ করব না, এমনকি নারীবাদীরা এটা নিয়ে কী বলবেন সেটাও ভিন্ন জায়গায় আলাপের সুযোগ আছে, এই রচনায় আমি শুধু ভাবনা উসকে দিচ্ছি মাত্র। উপরের উদ্ধৃতি সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও ব্যবহার হয়েছে। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আলাপ শেষ করছি ঠাকুরের গল্প থেকে আরেকটু উদ্ধার করে।
“পুরুষমানুষ বিধাতার ন্যায়-, তাহার মধ্যে তিনি বজ্রাগ্নি নিহিত করিয়া রাখিয়াছেন, নিজের প্রতি অথবা অপরের প্রতি অন্যায়ের সংঘর্ষে সে যদি দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতে না পারে তবে ধিক তাহাকে। পুরুষমানুষ দাবাগ্নির মতো রাগিয়া উঠিবে সামান্য কারণে, আর স্ত্রীলোক শ্রাবণ মেঘের মতো অশ্রুপাত করিতে থাকিবে বিনা উপলক্ষে, বিধাতা এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন...”
দোহাই
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মণিহারা, গল্পগুচ্ছ, বিশ্বভারতী গ্রন্থ বিভাগ (শ্রাবণ ১৪১৫), কলকাতা।
২. সত্যজিৎ রায়, তিন কন্যা (চলচ্চিত্র, ১৯৬১), ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড (২০১১), মুম্বাই।
৩. Karl Marx, Capital: A Critical Analysis of Capitalist Production (Volume 1), Translated from the third German edition by Samuel Moore and Edward Aveling, edited by Frederick Engels, Progress Publishers (1965), Moscow.
৪. Dylan Evans, An Introductory Dictionary of Lacanian Psychoanalysis, Routledge (1996), USA and Canada